skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I দক্ষিণের চর, ক্যাম্প ও বন ফায়ার

রাজধানী থেকে ১৭ ঘণ্টার যাত্রা শেষে প্রকৃতির নিবিড় কোল—চর কুকরিমুকরি। হিমেল আবহাওয়ায় সেখানে রোমাঞ্চকর অভিযাত্রার গল্প লিখেছেন মাহীনূর ফাতিমা বিনতে হোসেন

শহরের কোলাহলে ক্লান্ত আর বিরক্ত হয়ে শীতের এক বিকেলে আমাদের ছয় শহরবাসীর চর কুকরিমুকরির উদ্দেশে যাত্রা শুরু। ঢাকার সদরঘাটে রাত আটটার লঞ্চে করে আমরা রওনা দিই ভোলা জেলার সর্ব দক্ষিণের দ্বীপ চর কুকরিমুকরির উদ্দেশে। এক ঘণ্টা না যেতেই রাজধানীর কোলাহল থেকে অনেকটা দূরে চলে আসি।
লঞ্চের ডাল, ভাত আর মুরগি দিয়ে একটা জম্পেশ ডিনার সেরে, লঞ্চের দুলুনিতে দুলতে দুলতে কুকরিমুকরি চরের স্বপ্নে বিভোর হয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে ঘুম ভাঙে লঞ্চের ভ্যাঁপু শুনে। শীতের সকালে জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে বাইরে উঁকি দিতেই দেখি, বেতুয়া ঘাটে পৌঁছে গেছি। বলে রাখি, এটি চরফ্যাশন উপজেলার একটি ছোট্ট লঞ্চঘাট।
নিজেদের ব্যাগ, টেন্ট আর হ্যামক নিয়ে ঘুম জড়ানো চোখে লঞ্চ থেকে নামতে নামতে সকাল সাড়ে সাতটা। ক্ষুধায় পেটে তখন ইঁদুরদৌড় চলছে! ঘাটে নেমেই চা, পরোটা আর ভাজি দিয়ে নাশতা সেরে নিলাম।
এরপর আমাদের গন্তব্য চর কচ্ছপিয়া ঘাট। অটোতে করে বেতুয়া ঘাট থেকে কচ্ছপিয়া ঘাটে যেতে সময় লাগে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। আমরা একটা অটো রিজার্ভ নিয়ে সেই ঘাটের উদ্দেশে রওনা দিলাম।
রাস্তায় আমাদের অটোর চালক পরামর্শ দিলেন জ্যাকব টাওয়ার ঘুরে যেতে। এটা কচ্ছপিয়া ঘাটে যাওয়ার পথেই পড়ে। তিনি আরও জানালেন, এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ওয়াচ টাওয়ার। এসব কথা শুনতে শুনতে জ্যাকব টাওয়ারে পৌঁছে গেলাম। টাওয়ারটি দেখে আমরা আসলেই অবাক—বাংলাদেশে এত বড় টাওয়ার কখনো দেখিনি! এই টাওয়ারের ওপর থেকে পুরো চরফ্যাশনকে দারুণভাবে দেখা যায়।
১৫ মিনিটের মতো টাওয়ারে কাটিয়ে আবার অটোতে উঠে বসি আর প্রায় দুই ঘণ্টা পর পৌঁছে যাই কচ্ছপিয়া ঘাটে।
কচ্ছপিয়ায় পৌঁছে আমরা দুই দিনের ক্যাম্পিংয়ের চাল, ডাল, মসলাসহ যাবতীয় বাজার সেরে নিই; কারণ, এরপর আর কোনো বাজার নেই। বাজার সেরে কুকরিমুকরির স্থানীয় ও পরিচিত মাঝি জাকির ভাইয়ের নৌকায় চেপে মূল গন্তব্যে রওনা দিই।
এই ফাঁকে বলে রাখি, আপনি এই ক্ষেত্রে ঘাট থেকে ভাড়ায় রিজার্ভ নৌকা নিতে পারবেন অথবা এখন অনেক শেয়ার্ড নৌকা পাওয়া যায়, সেটাতেও চর কুকরিমুকরি যেতে পারবেন।
মেঘনার বুকে আমাদের ছোট ট্রলার এগোতে থাকে একটু একটু করে। চর কুকরিমুকরিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘড়ির কাঁটায় বেলা দুইটা।
এই চরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলাম, এ এক আলাদা দুনিয়া! এক পাশে বিশাল ম্যানগ্রোভ জঙ্গল, অন্য পাশে মেঘনার মোহনা। আমরা ছাড়া খুব অল্পসংখ্যক মানুষ ছিলেন পুরো চরে। নৌকা থেকে নেমেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম নিজেদের টেন্ট গোছানোর কাজে। ঘাট থেকে বেশ দূরে, জঙ্গলের গা ঘেঁষে একটা সুন্দর খোলামেলা জায়গায় ঠাঁই হলো আমাদের টেন্টের। রাজধানীর ইট-সিমেন্ট আর এসির ভেতরে থাকা মানুষগুলো নিজের মতো নিজ নিজ টেন্ট আর হ্যামক ঝোলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
কোনোরকমে টেন্ট গুছিয়ে খাবারের ব্যবস্থা শুরু করি। আমাদের কয়েকজন শুকনা ডালপালা জোগাড় করে, মাটিতে একটা ছোট গর্তের মতো করে চুলা বানিয়ে ফেলল। আর যেসব চাল, ডাল নেওয়া হয়েছিল কচ্ছপিয়া বাজার থেকে, তা একসঙ্গে মিশিয়ে ঝটপট খিচুড়ি বসিয়ে দিলাম। সঙ্গে ডিমভাজি। খেতে বসে মনে হলো, এর চেয়ে মজার খাবার যেন পৃথিবীতে আর নেই!
খাবার শেষ করে সব গুছিয়ে উঠতেই বিকেল প্রায় বলছে বিদায়! সেদিনকার মতো কাজ শেষ করে আমরা পুরো চরটা ঘুরে দেখা শুরু করলাম। যদিও একবারে পুরো চর ঘুরে দেখা অসম্ভব ছিল; কেননা, কিছুদূর যেতেই জঙ্গল আর নদী খুব কাছে চলে আসে।
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই চর কুকরিমুকরি শিয়ালের ডাকে মুখর হয়ে ওঠে। চরে মানুষের আনাগোনা কম থাকায় এবং আশপাশে শিয়ালের দৌরাত্ম্য বাড়ায় আঁধার ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ক্যাম্পের কাছে ফিরে এলাম।
রাত নয়টা নাগাদ দুপুরের বাকি খাবারটা দিয়েই ডিনার সারলাম। এরপর শুরু হলো গানের আসর। যে চুলায় রান্না হয়েছিল, তার আগুন আরেকটু উসকে দিয়ে আমরা একটা ছোটখাটো বনফায়ার করে ফেলি।
শীতের রাতে মাথার ওপর অজস্র তারা। তারার নিচে আমাদের ছোট্ট ঘর আর এর সঙ্গে মিলিয়ে চলছে গিটারের টুংটাং, হালকা আওয়াজে কণ্ঠ সাধনা! মনে হচ্ছিল, জীবন আশ্চর্য সুন্দর! মানসিক যে শান্তি শহরের অট্টালিকায় বিরল, রেস্তোরাঁর দামি কফির চুমুকে যেখানে প্রাণ জুড়ায় না, সেই শান্তি ও তৃপ্তি তো এখানে, এই মাটিতে, এই নদীতে আর এই জঙ্গলে ছড়িয়ে রয়েছে দারুণ মুগ্ধতাসহকারে।
রাত ১১টার দিকে এই রকম আগডুমবাগডুম আরও অনেক ভাবনা মাথায় নিয়ে আমরা যে যার টেন্টে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকাল সাড়ে পাঁচটায় পাখির ডাকে যখন ঘুম ভাঙল, বাইরে এসে দেখি পুব আকাশে কেবল গোলাপি আভার একটা রেখা টানা! অবাক হয়ে একটা গাছে হেলান দিয়ে আমি সূর্যোদয় দেখলাম, দূরে কিছু মাছ ধরার নৌকা দেখা যাচ্ছিল। বিশাল মেঘনার বুকে ওই বিরাট নৌকাগুলোও দেখতে ছোট্ট খেলনার মতো লাগছিল!
সকাল সাতটার দিকে একজন মাঝি টুকরিতে করে বেশ কয়েকটা ইলিশ নিয়ে এলেন। একদম তাজা ইলিশের লোভ সামলাতে না পেরে, দরদাম করে আমরা দুটি কিনে ফেলি। ইলিশ ভাজা আর ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত দিয়ে সেরে নিই সকালের নাশতা।
এরপর আমাদের দুজন সঙ্গী দুটি হ্যামকে ঝুলতে থাকে আর বাকি সবাই বের হই হরিণের খোঁজে। স্থানীয় কয়েকজনের কাছে শুনেছিলাম, চর কুকরিমুকরিতে অনেক হরিণ আছে; আর আমরাও হরিণের পায়ের ছাপ দেখেছি এই দুই দিনে। অথচ হরিণ যেন সোনার হরিণই রয়ে গেল; দেখা দিল না!
কিছুক্ষণ ঘুরে আবার ক্যাম্পে এসে দুপুরের রান্না বসিয়ে দিলাম। এর মধ্যেই আমাদের মাঝি ভাই অনেকগুলো বড় চিংড়ি নিয়ে এলেন। আমরা খুব উৎসাহ নিয়ে, চিংড়ি কেটে-ধুয়ে শুরু করলাম রান্না। দুপুরে আমাদের খাদ্যতালিকায় ছিল চিংড়ির চচ্চড়ি, ডাল ভুনা আর ভাত। জাকির ভাইকে সঙ্গে নিয়ে আমরা ছয়জন খুব আয়েশ করে দুপুরে ভরপেট খেলাম।
বিকেলে ঘুরলাম কুকরিমুকরির ঘাটের দিকটায়। জানলাম, সরকার কিছুদিন আগে চরের ঘাটটা পাকা করেছে; একটা সাইক্লোন শেল্টারও বানানো হয়েছে ঘাটের কাছে। আমরা পুরো বিকেল এর আশপাশের জায়গা ঘুরে দেখলাম; আর গল্প করলাম স্থানীয়দের সঙ্গে। কথা বলতে বলতে জানতে পারলাম, তারা পেশায় মূলত মাঝি। বছর কয়েক ধরে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ায় তারা নিজ উদ্যোগে টেন্ট ভাড়াও দিচ্ছেন। আবার কিছু হোম স্টেও আছে ঘাটের খুব কাছে। কেউ চরে ক্যাম্প করতে না চাইলে হোম স্টেগুলোতে থাকতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে এক রুমের ভাড়া পড়বে ৪০০ টাকা।
পুরো বিকেল ঘুরে, রাতে একটু দেরি করেই আমরা ক্যাম্প সাইটে ফিরলাম। এটা যেহেতু চরে আমাদের এবারের মতো শেষ রাত, তাই অনেকক্ষণ জেগে পার করলাম আড্ডাবাজি আর গানে মেতে। পরদিন সকালে আবার ফিরতি যাত্রায় পা বাড়াতে হবে; কিন্তু জানি, মন পড়ে রবে চর কুকরিমুকরিতে।
পরদিন সকালে উঠে কফি আর বিস্কুট খেয়েই শুরু করলাম টেন্ট গোটানো। রাজধানীতে ফিরতে পাড়ি দিতে হবে ১৭ ঘণ্টার পথ। আবার যেতে হবে যানজটে ঠাসা শহুরে জীবনে।
বলে রাখি, আমরা চর কুকরিমুকরিতে গিয়ে খুবই সচেতন ছিলাম, যেন কোনো ধরনের প্লাস্টিকের বোতল অথবা প্যাকেট ফেলে না আসি। প্রতিটি খালি প্লাস্টিক পণ্য নিজেদের সঙ্গে এনে, ঢাকায় নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলেছি। তাই আপনারা যারা ওই চরে যাবেন ভাবছেন এই শীতে, সবার প্রতি অনুরোধ, কোনো প্রকার প্লাস্টিক সামগ্রী ফেলে এসে বন ও নদীর ক্ষতি করবেন না। বেড়াতে গেলে শুধু নিজের পদচিহ্নই রেখে আসুন, কোনো ময়লা-আবর্জনা নয়।

ছবি: মাসুদ আনন্দ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top