এডিটরস কলাম I নিরাপদ জীবনের ডাক…
আপনি চালক হোন কিংবা যাত্রী অথবা পথচারী—নিজের কিংবা অন্য কারও জীবনকে বিপদে ফেলার কোনো অধিকার আপনার থাকতে পারে না, কিছুতেই না
‘অনন্ত জীবন যদি পাই আমি তাহ’লে অনন্তকাল একা/ পৃথিবীর পথে আমি ফিরি যদি দেখিবো সবুজ ঘাস ফুটে উঠে/ দেখিবো হলুদ ঘাস ঝরে যায় দেখিবো আকাশ শাদা হয়ে উঠে ভোরে—/ ছেঁড়া মুনিয়ার মত রাঙা রক্ত—রেখা লেগে থাকে বুকে/ তার সন্ধ্যায়—বারবার নক্ষত্রের দেখা পাবো আমি;/ দেখিবো অচেনা নারী আলগা খোঁপার ফাঁস খুলে ফেলে চলে যায়/ মুখে তার নাই আহা গোধূলির নরম আভাস…’—জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো করে, দীর্ঘ জীবনের নির্মল আকাক্সক্ষা খুব সহজাতভাবেই দোলা দিয়ে থাকে যেকোনো মানুষের ভাবনাজগতে। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, নানাবিধ বেদনার বোধ কখনো কখনো কাউকে কাউকে আচ্ছন্ন করে ফেলে ঠিকই; তবু সে সময়েও বোধ করি, শেষ মুহূর্তে হলেও ঘুরে দাঁড়ানোর, জীবনকে আরেকটু ঝালিয়ে দেখার তৃষ্ণা দেয় উঁকি। কেননা, ‘জন্মিলে মরিতে হবে’—এই অমোঘ সত্য জেনেও ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’র বোধে এগিয়ে চলে একেকটি মানবজীবন। এ জীবনে স্বয়ং জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু আর নেই—এমন সত্য তাই অস্বীকার করা যায় না; অস্বীকার করা উচিতও নয়। তাই বলা যেতে পারে, এই অমূল্য জীবনের অপচয়ের চেয়ে বড় অপচয় আর কিছুই হতে পারে না। অথচ আমাদের দৈনন্দিন ব্যস্তময় জীবনযাত্রায় কতভাবেই না ঝরে পড়ে কত জীবন! দুর্ভাগ্যক্রমে নাগরিক জীবনে তার বড় একটি কারণ—সড়ক দুর্ঘটনা।
দুই
মস্তিষ্কের সুচারু বিকাশ ও ব্যবহার ঘটিয়ে এই গ্রহের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ প্রাণসত্তা হিসেবে ধাপে ধাপে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে মানুষ। আদিকাল থেকে দারুণ ধারাবাহিকতায় প্রযুক্তির জয়গানে মুখর এই আধুনিক সময়ে করেছে পদার্পণ। মানুষের জীবনগতিকে দ্রুত চলমান করার অন্যতম মাধ্যম যানবাহন। বেশির ভাগ ইতিহাসবিদের তথ্য থেকে জানা যায়, ১৭৬৯ সালে ফ্রান্সের নিকোলাস-জোসেফ নট সর্বপ্রথম একটি সত্যিকারের মোটরচালিত গাড়ি তৈরি করতে সক্ষম হন। তার আবিষ্কৃত অত্যন্ত ভারী, বিশালাকার ও বাষ্পচালিত সেই ত্রিচক্রযানের গতি ছিল ঘণ্টায় ৩ দশমিক ৬ কিলোমিটার। চারজন মানুষকে নিয়ে সেটি চলতে পারত একটানা ২০ মিনিট। আর এখন তো চোখের পলকেই বহুদূর পাড়ি দেওয়ার মতো অত্যাধুনিক যানবাহনের ছড়াছড়ি। কতটা ও কীভাবে এমন উন্নতি হলো মোটরযানের, সেই প্রসঙ্গ ভিন্ন। আমরা বরং আনন্দের উল্টো পিঠে থাকা বেদনার আলাপে ফিরি! গতি উদ্যাপনের বিপরীতে জীবননাশের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার সামনে দাঁড়াই, চলুন!
তিন
প্রাত্যহিক জীবনের যেসব দুঃসংবাদ অনেকটাই গা-সওয়া হয়ে গেছে, সেগুলোর মধ্যে বোধ করি শীর্ষে রয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখলে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও বড়-ছোট-মাঝারি দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। কোনো কোনো দুর্ঘটনা দেশের আপামর মানুষকে এক করে দেয়, প্রতিবাদ জানাতে নামিয়ে আনে রাস্তায় কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পড়ে যায় তোলপাড়; কোনো কোনোটা আবার ‘একান্তই ব্যক্তিগত’ হয়ে চাপা পড়ে থাকে—পারিবারিক গন্ডি। ব্যাপারটি এমন দাঁড়িয়েছে, প্রায় প্রতিটি পরিবার-পরিমন্ডলের কেউ না কেউ সড়ক দুর্ঘটনার হয়েছেন শিকার, যাদের কেউ অল্পের ওপর দিয়ে রক্ষা পেলেও কাউকে মেনে নিতে হয়েছে পঙ্গুত্ব, আবার অনেকেই হারিয়েছেন প্রাণ। পথে নামলেই জীবন যেন ভীষণ সস্তা হয়ে ওঠে! আহা, কী অপচয়—অমূল্য জীবনের!
চার
সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আলোচনা-সভা-সমাবেশ কম হয়নি; মৌন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত অশান্ত প্রতিবাদও হয়েছে নেহাত কম নয়। চলছে এখনো, কোথাও না কোথাও, কোনো না কোনো ধরনে। বিভিন্ন সময়ে নানা গবেষণা থেকে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অভিজ্ঞ চালকদের চেয়ে অল্প বয়সী ও অনভিজ্ঞ চালকেরা বেশি দায়ী। কেননা, গাড়ি চালানোর সময় তাদের মধ্যে ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা বেশি। চালকের আসনে বসে অমনোযোগিতা, দৃষ্টিশক্তির সমস্যা, গতি ঠিক রাখতে না পারা, সামনের দুর্ঘটনা ঘটার প্রবণতা বুঝতে না পারাটাও কারণ। তা ছাড়া দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চালানোর কারণে চালকের মধ্যে ক্লান্তি, অবসাদ ও চোখে ঘুম চলে আসার কারণেও ঘটে থাকে ভয়ানক বিপদ। চালকের মাদক ও অ্যালকোহল গ্রহণের মতো বদ-অভ্যাস এবং অপরাধমূলক প্রবণতার দায়ও কম নয়। আর, তার সঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে পথচারীর অসতর্কতাও দায়ী। অন্যদিকে, ট্রাফিক জ্যামে স্থবিরপ্রায় নগররাস্তায় তো বটেই, এমনকি আদিগন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে রাখা গ্রামীণ পথেও দ্রুত সময়ে চলাচলের উপযোগী হিসেবে তুমুল গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে মোটরবাইক। আর পরিসংখ্যান বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার বেশির ভাগের সঙ্গেই রয়েছে এই দ্বিচক্রযানের সংযোগ।
দুর্ঘটনা এড়ানো ও যাত্রাপথে নিরাপদ থাকার উপায় নিয়ে গবেষণা ও প্রচার-প্রচারণা কম হয়নি। চলছে এখনো। গাড়িতে সিট বেল্ট বাঁধা, মোটরবাইকে হেলমেট পরা, মনোযোগ দেওয়া, অদক্ষদের চালাতে না দেওয়া, রাস্তার বিশ্লেষণ বা রোড স্ক্যানিং, গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে রাখা, কথা বলা থেকে বিরত থাকা, অন্য বাহনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা না করা, সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় যানবাহন চালানো ইত্যাদি উপায় এ ক্ষেত্রে ভালো ফল এনে দেয়, এ কথা আমাদের সবারই কম-বেশি জানা। তবে তা না মানার কারণে অনেক অপমৃত্যুর সাক্ষ্য হতে হচ্ছে আমাদের। বলি, আপনি চালক হোন কিংবা যাত্রী অথবা পথচারী—নিজের কিংবা অন্য কারও জীবনকে বিপদে ফেলার কোনো অধিকার আপনার থাকতে পারে না, কিছুতেই না।
পাঁচ
করোনাভাইরাস বাস্তবতা ব্যস্ত জনজীবনের এই পৃথিবীর এক অকল্পনীয় রূপ আমাদের দেখিয়েছে। বৈশ্বিক এ অতিমারির শুরুর দিনগুলোতে যখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আরোপ করা হয়েছিল কঠোর লকডাউন, তখন সদা ব্যস্ত পরিচিত অনেক রাস্তা হয়ে পড়েছিল যানবাহনশূন্য। কোভিড-১৯-এর প্রাথমিক ধাক্কা সামলিয়ে আবারও চিরচেনা রূপে অনেকটাই ফিরে এসেছে সবকিছু। আধুনিক এই সময়ে যান্ত্রিক যানবাহনবিহীন জীবনের কথা ভাবাও যায় না। তা ছাড়া মানবসভ্যতার কল্যাণেই ঘটেছে যানবাহনের আবিষ্কার; প্রতিনিয়ত যাচ্ছে আরও আধুনিকায়নের ভেতর দিয়ে। বাহন যেন হন্তারক কিংবা মৃত্যুর যন্ত্র না হয়ে ওঠে, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব বস্তুত প্রত্যেক মানুষের।
সড়ক পরিণত না হোক মৃত্যুকূপে। নিরাপদ জীবন হোক সবার।