এই শহর এই সময় I সময়ের মুখচ্ছবি
শিল্পের বই, টেক্সটভিত্তিক শিল্পকর্ম এবং একটি ক্ষণস্থায়ী পড়ার কক্ষ নিয়ে বেঙ্গল আর্টস প্রোগ্রাম আয়োজন করে ভিন্নধর্মী প্রদর্শনী সাব-টেক্সট। যাতে স্থান পেয়েছে শিল্পবিষয়ক প্রায় ১৫০টি বই। এই ভিন্নধর্মী আয়োজনের মূল ভাবনা ফুটে উঠেছে নয়জন শিল্পীর ভিডিও, ড্রয়িং আর ইনস্টলেশনের মাধ্যমে। এখানে লিখিত বার্তাকে শুধু ভাব প্রকাশের বাহন হিসেবে নয়, বরং আর্টের বিভিন্ন আকৃতি বা রূপ হিসেবে দেখানো হয়েছে। প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা হলেন আবির সোম, বিশ্বজিৎ গোস্বামী, ইমরান সোহেল, মার্জিয়া ফারহানা, মোস্তফা জামান, পলাশ ভট্টাচার্য, রাজীব দত্ত, ওয়াকিলুর রহমান ও জিহান করিম। বিশ্বজুড়ে শিল্পীদের অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাওয়া ইতিহাস, জীবনী, তাত্ত্বিক, ঘোষণাপত্রভিত্তিক বিভিন্ন বই সাব-টেক্সটে শোভা পায়। এই অনুষ্ঠানের কিউরেটর তানজিম ওয়াহাব বলেন, ‘লিখিত বার্তা এবং শিল্পের মধ্যকার সম্পর্ককে পুনরায় অন্বেষণের জন্য ভাষা, শব্দ, বর্ণ এবং শিল্পকর্মের সম্মিলন ঘটানো হয়েছে এই প্রদর্শনীতে। এখানে একটি কাল্পনিক লাইব্রেরিকে ক্ষণস্থায়ী রূপ দেয়া হয়। যেখানে শিল্পী ও শিল্পের দর্শক সবাই ভাষার বিভিন্ন উপাদানের ফর্ম এবং অর্থের পারস্পরিক সম্পর্ককে অন্বেষণ করতে পারবে।’
‘আমার ছবিই আমার অস্তিত্বের একমাত্র প্রমাণ। আমি আঁকি, কারণ এই কাজে নিজেকে কখনো জোর করতে হয় না। শিল্প আমাকে অভিভূত করে এবং ভাসমান আবেগ ও আমার অস্তিত্বহীন ভাবনার সমাধিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। সময়ের উপলব্ধি আমার কাছে অস্পষ্ট, কিন্তু সুখ পাই এই ভেবে যে আমার বর্ণগুলো মনে ধরে আছে’, কথাগুলো তরুণ শিল্পী আফ্রিদা তানজিম মাহির। নিজের প্রথম একক প্রদর্শনী ‘লস্ট ইন ট্রানজিশন’-এর শুরুর দিন এভাবেই নিজের শিল্পভুবন ও শিল্পকর্ম নিয়ে কথা বলেন তিনি।
মাহির আঁকার বিষয় ছিল পরিবর্তনশীল আকৃতি। তিনি পছন্দ করতেন তাতে তীব্র উত্তেজনা প্রকাশ করতে। মনে করতেন, সব রঙই ছুঁয়েছেন তিনি, কিন্তু কিছুই আঁকা হয়নি। তার রঙগুলো রাখা হতো জুতা রাখার জায়গার পাশেই। যেখানে শূন্য ক্যানভাসগুলো থাকত। প্রদর্শনী শুরুর ঠিক চার দিনের মাথায় ১৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় তিনি নিজ জীবনের সমাপ্তি ঘটান।
৯ ফেব্রুয়ারি কলাকেন্দ্রে শিল্পী আফ্রিদা তানজিম মাহির শিল্পভাবনা ও শিল্পকর্ম নিয়ে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। যেখানে উপস্থিত ছিলেন আনু মুহাম্মদ, মানস চৌধুরী, চঞ্চল আশরাফ, ফারুক ওয়াসিফ, সন্দীপ চৌধুরী, আলোকচিত্রী লতিফ হোসেন, প্রদর্শনীর কিউরেটর ওয়াকিলুর রহমান, শিল্পীর মা রহিমা আফরোজ মুন্নী। অনুষ্ঠানে কিউরেটর ওয়াকিলুর রহমান বলেন, মাহি নিজেকে অবজেক্ট হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং ছবি এঁকে তা ফিরিয়ে দিয়েছেন। আপোসকামিতা, ঐতিহ্যগত পরম্পরায় আচ্ছাদিত সামাজিক আচার, বিশ্বাস অস্বীকার করে তা সরাসরি প্রকাশ করেছেন। ‘লস্ট ইন ট্রানজিশন’ শিরোনামে মাহির প্রদর্শনী অনেকটাই আত্মজৈবনিক এবং আত্মনিবেদনমূলক। আমি যা একটি বিশেষ সময়ের, প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বমূলক হিসেবে দেখেছি। প্রদর্শনী শুরু করে দিয়ে মাহি এভাবে নিজেকে হারিয়ে নেবে ভাবতে পারিনি।
প্রদর্শনীতে সাতটি পৃথক অংশে সাজানো হয়েছে আফ্রিদার চিত্রকর্মগুলো। যে চিত্রকর্মগুলোর ভাষা শিল্পীর স্বেচ্ছামৃত্যুর মধ্য দিয়ে হয়তো অনেকের কাছেই বদলে গেছে। আত্মপ্রতিকৃতি থেকে শুরু করে বিচিত্র কোলাজ কিংবা অ্যাক্রিলিকে আঁকা রাজধানী ঢাকার জীবনচিত্র; এমনকি তার ড্রইংগুলোতেও আমাদের সমাজযন্ত্রণার ছবি স্পষ্ট হয়ে আছে। বিদ্বেষ, ক্রোধ, লিপ্সা ও বর্তমান পৃথিবীর অসহায়তার নানা অভিব্যক্তিই যেন মাহির চিত্রকর্মে ধরা পড়ে। ৯ ফেব্রুয়ারি প্রদর্শনীর সমাপনী ঘোষণা করা হয়।
খ্যাতিমান এবং তরুণ ছাপচিত্রীদের কাজ নিয়ে দেশের সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ, কলেজের চারুকলা বিভাগ, ছাপচিত্র স্টুডিও এবং দেশের বাইরের পাঁচ প্রতিষ্ঠানসহ মোট ২২টি প্রতিষ্ঠান নিয়ে সপ্তমবারের মতো আয়োজন করা হয় কিবরিয়া আন্তর্জাতিক ছাপচিত্র মেলা। মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেশবরেণ্য শিল্পী ও ছাপচিত্রী কালিদাস কর্মকারকে তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘আজীবন সম্মাননা’ দেয়া হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে এ মেলা উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি ছিলেন বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিল্পী আবুল বারক আলভী।
আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকার লা গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয় আলোকচিত্রী জিএমবি আকাশের একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘ক্ষমতায়নের মুখগুলো’। ডেনিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (ডানিডা) উদ্যোগে প্রদর্শনী শুরু হয় ২০ ফেব্রুয়ারি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বাংলাদেশে নিযুক্ত ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত মিকেইল হেমনিতি উইনথার ছিলেন বিশেষ অতিথি। আরও অতিথি ছিলেন রাজশাহীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের ২৯ বছরের রত্না। বছরের পর বছর রত্না তার স্বামী ও শ্বশুরালয়ের মানুষদের মাধ্যমে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন। স্থানীয় সরকারি হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে তিনি পালিয়ে এসে আশ্রয় নেন। তার অত্যাচারী স্বামীকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয় সেই ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের মাধ্যমে, যা ডানিডার সহায়তায় চলছে। আজ নিজ গ্রামে রত্না একটি বিউটি পার্লার পরিচালনা করেন। তার সন্তানেরাও এখন স্কুলে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে।
‘ক্ষমতায়নের মুখগুলো’ প্রদর্শনীতে আলোকচিত্রী জিএমবি আকাশ সেই সব চেহারা তুলে ধরেন। যারা জীবনের সবচেয়ে সংকটাপন্ন সময়ে টিকে থাকেন সংগ্রামের মাধ্যমে। এ গল্পগুলো অবিচারের, নির্যাতনের, পরিবারের ভেঙে যাবার, কিন্তু একই সঙ্গে পরিত্রাণ পাবার। জিএমবি আকাশ এসব মানুষকে দেন একটি কণ্ঠস্বর। ছবিগুলো সেই সব মানুষের সংগ্রামমুখর জীবনের সঙ্গে আমাদের পরিচিত হবার সুযোগ করে দেয়।
স্টাফ রিপোর্টার