skip to Main Content

ফিচার I ভাষা-খাদ্যে দোস্তি

খাদ্য ও ভাষা হাত ধরাধরি করে চলেছে। যেকোনো ভাষাকেই সমৃদ্ধ করেছে খাদ্যদ্রব্যের উপমা। ‘ফুড ফ্রেজ’ কিংবা দেশি বাগধারাগুলো তার প্রমাণ। সুনামে, দুর্নামে কিংবা বিশেষণ হিসেবে খাদ্যের নাম মানুষের মুখে মুখে রটেছে, ভাষার মাধ্যমে

খাদ্যের সঙ্গে ভাষার সংযোগ আদিম। গুহাবাসী মানুষের শিকারকালে ‘ইশারা ভাষা’ কিংবা টুকটাক শব্দ তৈরির বিভিন্ন কারণের মধ্যে খাদ্যান্বেষণও একটি। খাবার সংগ্রহের নিমিত্তে যেমন কিছু ভাষা তৈরি হয়েছে, ঠিক সেভাবেই ভাষার ক্রম-অগ্রগতিতেও খাদ্যবস্তুর উপমা বা রূপক ব্যবহৃত হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। কিছু উদাহরণ দেখে নিলে বিষয়টি খোলাসা হবে। যেমন, ধারণা করা হয় ‘ডিনার’ শব্দটি এসেছে পুরোনো ফ্রেঞ্চ শব্দ ‘ডিসনার’ থেকে। তবে সেটিই আদি শব্দ নয়। তা আবার গ্যালো-রোমানস শব্দ ‘ডিসজুনার’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ‘উপবাস ভঙ্গ করা’। আবার বিভিন্ন খাদ্য উপাদানযোগে ‘সিরিয়াল’ নামের যে খাবার খাওয়া হয়, সেটির নামের উৎপত্তি ‘সেরেস’ থেকে। যিনি কিনা শস্যের একজন গ্রিক দেবী। প্রাচীন যুগে শস্য উৎপাদনের স্বার্থে বেশ কিছু দেবদেবীর অর্চনা হতো।
মধ্যযুগেও ভাষার সমৃদ্ধিতে খাদ্যবস্তুর উপমা কিংবা রূপক ব্যবহারের নজির মেলে। যেমন ‘বিলো দ্য সল্ট’। এই বাক্যের সাধারণ অর্থ ‘তলানির লবণ’। কিন্তু তলানির লবণ বলতে সেকালে নিকৃষ্ট অতিথিকে বোঝানো হতো। সল্ট শব্দটির উৎপত্তির কথাই ধরা যাক। ল্যাটিন শব্দ ‘স্যালারিয়ামের’ মানে হচ্ছে ‘পারিশ্রমিক’। সে যুগে সৈনিকদের ‘স্যালারি’ হিসেবে লবণ দেওয়া হতো। তাই লবণের নাম হয়েছে সল্ট। কিংবা পারিশ্রমিকের নাম হয়েছে ‘স্যালারি’। এ ধরনের আরও কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন ‘আ গুড এগ’ বলতে অনেকের মধ্যে ভালো ব্যক্তিকে বোঝায়। বিপরীত দিকে ‘আ ব্যাড এগ’ বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝায়, যিনি বাইরে থেকে দেখতে সাধু হলেও তার মনে রয়েছে মন্দস্পৃহা।
চিজের সরল বাংলা পনির। কিন্তু উৎপত্তিগত দিক থেকে পারসিয়ান এই শব্দের মানে হলো ‘ভালো জিনিস’। সেই অর্থে যেকোনো ভালো জিনিসের বিশেষণই হতে পারে ‘চিজ’। উনিশ শতকে আমেরিকায় কোনো ধনকুবেরকে চিজ বলে বিশেষায়িত করা হতো। ‘দ্য বিগ চিজ’ বলতে বোঝাত সবচেয়ে সেরা ব্যক্তি কিংবা বস্তুকে। চিজকে অনেক সময় মুদ্রার উপমা হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। ‘আমাকে অনেক চিজ কামাই করতে হবে’—এর মানে হলো ‘আমাকে অনেক অর্থ উপার্জন করতে হবে’। এভাবেই ভাষার বিবর্তনে বিভিন্ন খাবার উপমা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। সারা বিশ্বেই নানান ভাষায় তিরস্কার, গুণ, আকাক্সক্ষা প্রকাশে খাদ্যদ্রব্যের উপমার নজির রয়েছে। নিচে সবচেয়ে প্রচলিত কয়েকটিতে ইংরেজি বাক্যে চোখ বোলানো যাক।
‘ইটস অল গ্রেভি’ বাক্যটির ভাবার্থ ‘যার সবই ভালো’। এখানে ‘গ্রেভি’কে ভালোর উপমা হিসেবে ভাবা হয়েছে। আমাদের বাংলাদেশেও ‘তেলে-ঝোলে খাওয়া’ বলতে ভালো খাবার খাওয়াকে বোঝানো হয়। ঝোল এখানে ভালো-এর নির্দেশক। ‘কুল অ্যাজ আ কিউকাম্বার’-এর মানে হলো ‘একেবারেই শীতল’। এখানে শীতল বলতে কিন্তু বস্তুর তাপমাত্রাকে বোঝানো হচ্ছে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের স্বভাব কিংবা মেজাজের অবস্থা বোঝাতে এই ‘কুল’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। সেই শীতলতা হলো শসার মতো। শসা এখানে শীতলতার উপমা। ‘পিস অব কেক’ বাক্যটি শাব্দিক অর্থে ‘এক টুকরো কেক’ বোঝালেও এর ভাবার্থ হলো, সহজে করা যায় এমন কাজ। এক টুকরো কেককে খুব সহজেই আলাদা করা যায়। তাই যে ধরনের কাজ অনায়াসে করা যায়, সেটিকে এক টুকরা কেকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ‘ইউজ ইয়োর নুডল’ মানে ‘মগজ খাটাও’। নুডলসকে কেন ইংরেজরা মগজের উপমায় ব্যবহার করল, তা সত্যিই এক রহস্য। ‘আ বান ইন দ্য আভেন’, এর মানে কি চুলার ভেতর বান রুটি? না। ইংরেজিভাষীরা মূলত গর্ভাবস্থাকে বলে ‘আ বান ইন দ্য আভেন’। এখানে বান হলো ভ্রূণের উপমা। ‘ওয়েক আপ অ্যান্ড স্মেল দ্য কফি’—কোনো একটি ঘটনার বাস্তবতা পরখ করার জন্য কফির উপমা টানা। এই বাক্য দিয়ে মূলত সত্য উদ্ঘাটনের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
উদাহরণগুলো যে শুধু ইংরেজি ভাষা থেকেই দেওয়া যায়, তা নয়। ফ্রেঞ্চ ভাষাকেও সমৃদ্ধ করেছে খাদ্যবস্তু। যেমন C’est pas la fin des haricots-এর মানে হলো এখানেই পৃথিবীর শেষ নয়। অর্থাৎ মন যাতনায় ভেঙে পড়া কোনো ব্যক্তিকে সান্ত¡না হিসেবে এটি বলা যেতে পারে। বাংলায় আমরা যেমন বলি, জীবনের কোনো শেষ নেই, প্রতি মুহূর্তেই জীবনের শুরু। ওপরের ফ্রেঞ্চ বাক্যটিতে haricots-এর মানে হলো মটরশুঁটি। বাক্যটির আক্ষরিক মানে দাঁড়ায়, ‘এটিই মটরশুঁটির শেষ দানা নয়’। এখানে মটরশুঁটিকে কোনো একটি ঘটনার রূপক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এমনই আরেকটি বাক্য ‘Va te faire cuire un oeuf’-এর মানে হলো ‘জাহান্নামে যাও’। বাক্যে ‘cuire’ মানে রান্না করা। oeuf মানে ডিম। বাক্যটির শাব্দিক অর্থ—‘যাও, নিজেকে ডিমের মতো রান্না করো’। কিন্তু ভাবার্থে নিজের সত্তাকে ডিমের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ইতালীয় ভাষার সমৃদ্ধিতেও খাদ্যদ্রব্যের ব্যবহার রয়েছে। দেশটির কুজিন গোটা বিশ্বেই সমাদৃত। সেই দেশি একটি বাক্য পড়া যাক: ‘‘Conosco i miei polli’—এই বাক্যে ‘polli’ মানে মুরগি। শাব্দিক অর্থে বাক্যটি দাঁড়ায়—‘আমি আমার মুরগি চিনি’। কিন্তু ভাবার্থ হলো, ‘জানি আমি কী বলছি’। এখানে মুরগিকে ‘কথা’ অর্থে উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
বাংলা ভাষার বাগধারাতেও কিছু খাদ্যবস্তুর উপস্থিতি লক্ষণীয়। যেমন ‘অকালের তাল’, মানে হলো ‘অসময়ে প্রাপ্ত দ্রব্য’। ‘অগাধ জলের মাছ’ মানে ‘সুচতুর ব্যক্তি’। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে এখানে মাছ মূলত মানুষের উপমা। তা ছাড়া রয়েছে ‘দুধের মাছি’। দুধ এখানে সুসময়ের উপমা। বাগধারা খুঁজলে এমন আরও অনেক উপমা বেরোবে। মূলত যেকোনো দেশের ভাষার বিবর্তন ও ক্রমবিকাশে প্রতি যুগেই খাদ্যদ্রব্যের নাম নিয়ামক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তা ছাড়া খাবার নিজেই একটি ভাষা, নিজেই একটি সংস্কৃতি। একটি দেশের কুজিন সেই দেশের লোকের স্বাদেন্দ্রিয়ের পরিচয় দেয়।

 শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top