skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I সামার প্যালেসে গ্রীষ্ম

বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রাসাদ-বাগানে আলো-হাওয়া, জল-ফুল আর চিত্রকর্মের যেন পৌরাণিক খেলা! গ্রীষ্ম এখানে জাগতিক সৌন্দর্যের এক অন্য মাত্রা জাহির করে। লিখেছেন ফাতিমা জাহান

চেরি ফুলে ছাওয়া, গোলাপি হয়ে যাওয়া সিঁড়ি আর গোলাপি ছোট ছোট চেরি ফুলগাছের ছায়ায় খানিক ওপরে উঠলে চীনের প্রাচীন আমলের তৈরি একটি ছাউনি। ঐতিহ্যবাহী ছাউনির চৌকো ছাদে হলুদ টাইলস বসানো আর ছাদ থেকে ভেতরের ছাদে নানান কারুকাজ করা নকশা যেন গড়িয়ে পড়ছে! লাল কাঠের থাম, চারপাশ খোলা। এই ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে কুনমিং লেকের অনেকখানিই দেখা যায়। আরেকটু দূরে চিং রাজবংশের সামার প্যালেসের মূল ভবন।
আমার এক আমেরিকান বন্ধু বলেছিল, চায়নিজদের সব স্থাপনাই বিশাল আকার আর দৈর্ঘ্যের। ১৭৫০ সালে নির্মিত সামার প্যালেস ছড়িয়ে আছে প্রায় তিন বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে, যার তিন-চতুর্থাংশ নিয়ে কুনমিং লেক। যে কারণে চায়নিজদের স্থাপনাকে বিশাল বলা, প্রবেশদ্বারের ধারেকাছেও মূল ভবন খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের দেশে যেমন অলিগলি-তস্য গলি আছে, চায়নিজদের আছে খোলা সবুজ উদ্যান, বাগান আর একটার পর আরেকটা ভবন, তারপর আরও ভবন এবং প্রায় অনেকটা পথ হেঁটে মূল ভবন।
বেইজিং শহরে এখন গ্রীষ্মকাল। সাধারণত সামার প্যালেসে চীন দেশের সম্রাটেরা গ্রীষ্মকালে চলে আসতেন শহরের কোলাহল থেকে দূরে অবকাশ যাপন করতে। যদিও বেইজিংয়ে আমাদের দেশের মতো গরম পড়ে না, তবু কুনমিং লেক গরমকে চিং সম্রাটদের জন্য অনেকখানি স্তিমিত করে রেখেছিল।
সামার প্যালেস চিং রাজবংশের রাজাদের রাজকীয় ভবন। প্রবেশদ্বার দেখতে বিশাল তোরণের মতো। তোরণের মাথায় মুকুটের মতো নীল, সবুজ, সোনালি, লাল কারুকাজ করা ছাদ। এ প্রাঙ্গণের সব ভবন ও তোরণের স্তম্ভের রং লাল কিংবা সবুজ। সম্রাট চিয়ান লং নির্মাণ করেছিলেন এই বিশাল বাগান আর জলাধারের প্রাসাদ। এরপর থেকে গ্রীষ্মের প্রারম্ভে বেইজিংনিবাসী সব সম্রাট চলে আসতেন সামার প্যালেসে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপন করতে।
প্রবেশদ্বার পার হয়ে আশপাশে অনেকখানি খোলা জায়গা আর বাগান। এরপর যে ভবন চোখে পড়ল, তার নাম ‘হল অব বেনেভোলেন্স অ্যান্ড লনজিভিটি’। সম্রাটের নিজস্ব দপ্তর। অবকাশকালীন সম্রাট এখানেই দেশ-বিদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিটিং করতেন, বিভিন্ন ধরনের দাপ্তরিক কার্যকলাপ চালাতেন।
সামনের উদ্যানে মূল ভবনের দুপাশে ব্রোঞ্জের দুটো সিংহ রাখা, মুখটা ড্রাগনের মতো—একটি পুরুষ, অপরটি নারী। ভবনটি একতলা। হলুদ টাইলসের চৌকো ছাদ। সামনের বারান্দায় লাল থাম আর ভেতরের দেয়াল, ছাদ সব জায়গায় শিল্প দখল করে রেখেছে। সমস্ত দেয়াল আর ভেতরের ছাদে মিনিয়েচার চিত্রকর্ম আঁটোসাঁটো করে জায়গা করে নিয়েছে। মিনিয়েচার চিত্রকর্মে কোথাও ড্রাগন, কোথাও নকশা, কোথাও অপ্সরা, কোথাও দেবতা। আর সব চিত্রকর্মে নীল, সবুজ, সোনালি, হলুদ, লাল রঙের ব্যবহার। এত সূক্ষ্ম ও রঙিন চিত্রকর্ম অন্য কোনো দেশে দেখিনি। এ এক বিস্ময়! ভেতরের আসবাব মহামূল্যবান আবলুস কাঠ, মাদার অব পার্ল, রুপা দিয়ে তৈরি। এদের গায়েও সূক্ষ্ম খোদাই ও কারুকার্য।
চীনের প্রায় সব প্রাচীন ভবনেই নির্মাণের সময় আগাগোড়া মজবুত কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। সামার প্যালেসের সব ভবন নির্মাণেও ব্যবহৃত হয়েছে কাঠ। ভবনের দেয়াল, ছাদের চিত্রকর্মে অপ্সরাদের নৃত্য আর জাদুকরের জাদুর মোহ যেন কাটতে চায় না। আরও কয়েকটা বাগান আর সম্রাট-সম্রাজ্ঞীদের প্রাসাদ পেরোলে একটি তিনতলা ভবন, নাম ‘গ্র্যান্ড স্টেজ, গার্ডেন অব ভার্চু অ্যান্ড হারমোনি’। কাঠের তিনতলা ভবনের আগাগোড়া মিনিয়েচার চিত্রকর্মে ছাওয়া। বাইরে থেকে দেখলে রাজপ্রাসাদের অংশ মনে হবে; কিন্তু ভেতরে রয়েছে সুসজ্জিত মঞ্চ আর সব দিকের দেয়ালে হীরা, মোতি, স্বর্ণ ঘটা করে ছটা ছড়িয়ে যাচ্ছে।
এই ভবন সম্রাট, বিশেষত সম্রাটের মা বা রাজমাতা ব্যবহার করতেন। অপেরা, নাচগান ইত্যাদির আয়োজন হতো এখানে। এটি বর্তমানে চীনের সবচেয়ে প্রাচীন মঞ্চ। এই রাজকীয় মঞ্চ পেরোলে লম্বা কাঠের করিডর। এর স্তম্ভ সবুজ আর দুপাশ খোলা, যেখান দিয়ে প্রাসাদের হাওয়া কুনমিং লেকে গিয়ে মেশে। ছাদে সেই অনন্যসাধারণ মিনিয়েচার চিত্রকর্ম। এই চিত্রকর্মগুলো প্রাসাদের চিত্রকর্মের চেয়েও বৈচিত্র্যময়। কোথাও চীন দেশের দেবতাদের গল্প আঁকা, কোথাও পুরাণ। প্রায় ১৪ হাজার মিনিয়েচার চিত্রকর্ম দিয়ে সাজানো এই করিডরের ভেতরের ছাদ। এত বছরে রোদে, জলে এতটুকুও মলিন হয়নি।
করিডরটি ৭২৮ মিটার লম্বা। অথবা এ-ও বলা যায়, প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা! করিডরের এক পাশ দিয়ে সমান্তরাল বয়ে যাচ্ছে কুনমিং লেক। এখন লেকের জল স্বচ্ছ, সবুজ। সবুজ জলাধার এখন দুহাতে মুঠো করে রেখেছে পদ্মপাতা। চীন দেশে যেখানেই গিয়েছি, সবখানেই জলাধারের দেখা মিলেছে আর মিলেছে জলাধারে পদ্মফুলের বাহার। জানি, এবারও আমাকে এই স্ফটিক জলাধার নিরাশ করবে না। হেসেখেলে, রঙে, পুরোনো রূপকথার গল্পে তিরতির কাঁপছে পদ্মফুলের দল।
এই লেকে দ্বীপ আছে তিনটি। ময়ূরপঙ্খি নাও করে যাওয়া যায় সেসব দ্বীপে। আরেকটা খুব আশ্চর্যজনক নাও আছে তীরে ভেড়ানো। নৌকাটা কাঠের তৈরি নয়, লোহা কিংবা বাঁশেরও নয়। বিশাল এই প্রমোদতরী আগাগোড়া মর্মর পাথর দিয়ে বানানো। খুব অদ্ভুত। অবশ্য এই তরী কোথাও যায় না, তীরে স্থির থাকে। সম্রাট এ দোতলা বজরার মতো তরী বানিয়ে তীরেই ভিড়িয়ে রেখেছিলেন। বসে বসে লেক আর পদ্মপাতার টলমলে জল, জলে ফুলের ছায়া দেখার জন্য সম্রাজ্ঞীর খাস তরী ছিল এটি।
এই জলাধার আর পদ্মদিঘি দেখতে এখন ছোটবেলায় পড়ে আসা রূপকথার বলে মনে হচ্ছে। একটু মেঘ করলে, একটু জল ঝরলে, কেউ না থাকলে জলের ছোঁয়ায় যেন পদ্মফুল হয়ে যাবে কোনো এক অপ্সরা! আর ঘুরে বেড়াবে তীর ধরে। পদ্মপাতার ওপর গোড়ালি ফেলে ফেলে দেখবে স্বচ্ছ জলে রঙিন মাছ।
কুনমিং লেক এখন যত দূর চোখ যায় তত দূরে ছড়িয়ে। জায়গায় জায়গায় লেকের ওপর পাথরের ছোট ছোট সেতু। মজার ব্যাপার হলো, সেতুর ওপর দিয়ে লোকজন হেঁটে পার হতে পারেন, আর নিচ দিয়ে বয়ে যায় নাও। এখনো অনেক ছোট বড় রঙিন নাও জলাধারে ঘুরে বেড়াচ্ছে দর্শনার্থীদের নিয়ে। আরও মজার ব্যাপার, লেকটি প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠেনি; বরং কৃত্রিমভাবে তৈরি করেছিলেন সম্রাট চিয়ান লং।
আরও একটি কৃত্রিম জিনিস আছে এই বিশাল প্রাসাদ প্রাঙ্গণে, তা হলো পাহাড়। একই সময়ে নির্মিত। পাহাড়ের পায়ের কাছে যে ভবন গড়াগড়ি খাচ্ছে, তার নাম ‘হল অব ডিসপেলিং ক্লাউডস’। সত্যিই কি পাহাড়ের জমাটবাঁধা মেঘ এই ভবনে এসে চারদিকে ছড়িয়ে যায়!
এই রাজসিক ভবনের গায়ে গা লাগিয়ে পেছনের নয়তলা গোলাকার দালানটির নাম ‘দ্য টাওয়ার অব বুড্ডিস্ট ইনসেন্স’। এই ভবনগুলো শুধু কারুকাজ আর ঐশ্বর্যের সব উপকরণ দিয়ে ঢেলে সাজানো। নয়তলা ভবনের কোনায় কোনায় এখনো খুঁজলে বুদ্ধের জন্য সম্রাটের রাখা সুগন্ধি এসে এলোমেলো বাতাসে টালমাটাল করে দিয়ে যাবে। সবচেয়ে ওপরের তলায় পর্যটকদের যেতে না দিলেও তিনতলা থেকে স্ফটিক জলাধারের দৃশ্য দেখে মনে হয়, সামার প্যালেসে গ্রীষ্মকালে, চেরি আর পদ্মফুলে, অবারিত খোলা হাওয়ায় মিলিয়ে যায় মনের দেয়াল, বন্ধ কপাট।
সম্রাজ্ঞীর জন্য রাখা সুরভি ছড়িয়ে যায় আরও দূরে। রংনগরীর প্রতিটি নকশা ফিসফিসিয়ে যেন বলে, ‘প্রাসাদ দেখার আরও অনেক বাকি, আরও আগাও। পার হও মর্মর পাথরের আরও কিছু সেতু আর গাছে গাছে ছায়াঘেরা পথ। এরপর না হয় চলে যেয়ো…।’
আধবেলা ঘুরে আমার অর্ধেক প্রাঙ্গণই দেখা হয়নি। অনেকখানি হেঁটে চলে আসতে হলো সামার প্যালেসের পেছনের দিকে। এদিকটায় কুনমিং লেক সরু হয়ে এসেছে। আগের মতো আর দুকূল ছাপানো নেই। তবে এদিকটাই আমার সবচেয়ে প্রিয়। এতক্ষণ সম্রাটদের রাজকীয় ভবন, অমূল্য মিনিয়েচার শিল্পকর্ম দেখে মুগ্ধ রয়েছি। এখন সাধারণভাবে জল কলকল আর উদ্যান দেখার নেমন্তন্ন পেলাম।
এই প্রাঙ্গণে সরু কুনমিং লেকের দুপাশে বড় বড় গাছের উদ্যান। উদ্যানে লেকের কূলে সারি সারি দোকান। এই দোকানগুলো লেকটির প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই রয়েছে। দোকানের ছাদ, দেয়াল, দরজা, জানালায় প্রাসাদের মতোই মিনিয়েচার চিত্রকর্মে আবৃত। রাজকীয় এই বাজারে রেশমি কাপড়, গয়না, প্রসাধনী বা জুতা কিনতে আসতেন সম্রাজ্ঞী, রাজমাতা ও রাজকন্যারা। বেইজিং খানিক দূরে কেনাকাটা করতে যাবার জন্য। আর অবকাশ যাপনকালে বুঝি কিছু কিনতে ইচ্ছে করবে না তাদের! এখনো অবিকৃত সেই সব দোকানে বিভিন্ন স্যুভেনির পাওয়া যায়। এখানেও পেছনের অংশে অন্যান্য রাজকীয় একতলা, দোতলা ভবনের মতো বেশ কয়েকটি ভবন রয়েছে।
কুনমিং লেকে নাও নিয়ে পার হওয়ার চেয়ে এই সরু বিলের মতো জায়গায় ময়ূরপঙ্খি নিয়ে ঘুরে বেড়ানোই আনন্দদায়ক হবে আমার জন্য। সবুজ স্বচ্ছ জল; জলে উঁকি দিলেই মাছ নড়েচড়ে জানান দেয় উপস্থিতি। কিছু মাছের আবার রাজসিক চালচলন, ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, শুধু দেখা দেয়, আবার দেখা দেয়ও না।
কোথাও সবুজ বনভূমি, কোথাও চেরিগাছের ভিড়, কোথাও পদ্মফুলের জলকেলি আর কোথাও অদেখা, অজানা রহস্যকে দেখে ফেলার উল্লাস, কোথাও শিল্পকর্ম নিজেরাই ঐতিহ্যের একেকটা দরজা খুলে দেয় এখানে। আর সবটা জুড়ে অযুত-নিযুত রঙের রঙিন ভুবন এই সামার প্যালেস, এক আলাদা রাজ্য যেন; যে ইতিমধ্যেই জয় করে নিয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রাসাদ-বাগানের মুকুট।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top