ছুটিরঘণ্টা I ভুটানে রঙিন উৎসবের দিনে
মংক ড্যান্সে মেতেছেন ভিক্ষুরা। বিভিন্ন রঙের লম্বা পোশাক আর মুখোশ পরে। এই নৃত্যের, এই উৎসবের রয়েছে পরমার্থিক তাৎপর্য। লিখেছেন ফাতিমা জাহান
ভুটান এক শ্যামলিমার দেশ। চোখ শীতল করা সবুজের মাঝে নানা আকারের পাহাড়ের আঁকিবুঁকি। এ ভূখণ্ডের পুনাখা আশ্রমে ঢুকে দেখি, ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ার মতো বাদ্যযন্ত্র বাজছে চারদিকে। সিমবাল, ঢোল, ড্রাম, সানাই—আরও কত যে বাদ্যযন্ত্র, নামও জানি না সব কটির। পুনাখা যং বা পুনাখা আশ্রমে দূরদূরান্ত থেকে গ্রামবাসী এসেছেন। সবাই নিজেদের সেরা পোশাক পরে সেজেগুজে সকালেই এই কনকনে ঠান্ডার মধ্যে চলে এসেছেন মনাস্টেরিতে। আজ এখানকার উৎসবের দিন। এ দেশি ভাষায় বলা হয় সেচু। প্রতিবছর প্রথম চান্দ্রমাসের বিশেষ এই দিনে ভুটানের পুনাখায় উৎসবে মেতে ওঠেন গ্রামবাসী। রঙিন পোশাক আর রঙিন খুশি ভরে থাকে পুনাখা যংয়ের চারপাশে, তিন দিন।
শুধু গ্রামবাসীই নন, পুনাখা উৎসব এখানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক—সব ভিক্ষুর জন্যই একটি আনন্দঘন সময়। সমস্ত আশ্রম সারা বছর অপেক্ষায় থাকে দিনটির। উৎসবের দিনকে আরও মধুর করে তুলতে কয়েক মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয় পুনাখা আশ্রম বা মনাস্টেরিতে।
মনাস্টেরির ভিক্ষুরা সবাই পরেন খয়েরি পোশাক। উৎসবের দিনে সেখানে গিয়ে দেখি, খুদে ভিক্ষুরা গুটি গুটি পা ফেলে সারা মনাস্টেরি ঘুরে বেড়াচ্ছে। মেতে উঠছে খুনসুটিতে! একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিচ্ছে, পোশাক ধরে টানছে। প্রায় নয়তলা সমান উঁচু ভবনের দোতলার কাঠের বারান্দায় দাঁড়িয়ে, কাঠের কারুকাজ আর সূক্ষ্ম চিত্রকর্মের রেলিংয়ে মাথা গলিয়ে নিচের দিকে দেখছে কেউ কেউ। আরেকটু বড় বয়সের কিশোর ভিক্ষুরাও দল বেঁধে রেলিং থেকে উঁকি দিচ্ছে। মূল অনুষ্ঠান তখনো শুরু হয়নি।
আশ্রম ধোয়ামোছা, সাজানো, নিজেদের রান্নার কাজ ভিক্ষুরাই করে থাকেন এখানে। এই আশ্রম তৈরি করা হয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীতে। সাদা দেয়াল আর লাল, খয়েরি চৌকো ছাদ। এর মাঝে কত যে কারুকাজ গেঁথে রয়েছে থরে থরে! সাধারণত আশ্রম ভবনের নিচের দিকের দেয়ালে কোনো কারুকাজ নেই। ওপরের দিকে পর্যটক চোখ যখন রংতুলির মতো নজর বোলায়, তখন দরজা, জানালা, বারান্দায় দেখা মেলে তিব্বতি নকশার ছড়াছড়ি। ভুটানের সব মনাস্টেরি আসলে একই আদলে গড়া। কোনোটা আকারে ছোট, কোনোটা বড়; কোনোটা পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত, কোনোটা সমতলে। কিন্তু সৌন্দর্য কোনোটারই এতটুকু ম্লান নয়।
পুনাখা আশ্রমের চারদিকে জাকারান্ডা গাছ। আজ খুদে ভিক্ষুদের পড়ার কিংবা রুটিনমাফিক কাজের চাপ নেই। সবাই মনাস্টেরির আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চারপাশের ছোট জলাশয় ঘিরে রেখেছে এই মনাস্টেরিকে। আগেকার দিনে মনাস্টেরি ছিল রাজাদের শাসনকার্য পরিচালনা এবং রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ দলিল সংরক্ষণের স্থান। জলাধার দিয়ে ঘিরে রাখার কারণ, যেন শত্রুপক্ষ সহজে আক্রমণ করতে না পারে। বর্তমানে সামনের দিকে একটি কাঠের ছোট সেতু বানিয়ে দেওয়া হয়েছে চলাচলের সুবিধার জন্য। সেতু পার হয়ে আঙিনা, এক পাশে মনাস্টেরির বিশালাকৃতির প্রধান প্রবেশদ্বার। ওই প্রবেশদ্বারে ঐশ্বর্যের চাদরে লাল, সোনালি, সবুজ, হলুদ রঙের কারুকাজের উন্মুক্ত প্রদর্শনী চলছে এখন। এমনিতে চাইলে উৎসবের দিন ছাড়াও আমার মতো সাধারণ দর্শনার্থী এখানে আসতে পারেন, ঘুরে বেড়াতে পারেন, ভিক্ষুদের প্রার্থনা, পাঠ গ্রহণ বা কাজের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে। আর উৎসব সামনে রেখে অসংখ্য বিদেশি অতিথি আসেন এই বিশেষ অনুষ্ঠান দেখতে।
যেকোনো মনাস্টেরিতে বছরের একটি বিশেষ দিনেই ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা হয় আর অন্যান্য মনাস্টেরি চান্দ্রমাসের সঙ্গে মিলিয়ে অন্য মাসে ক্রমান্বয়ে ফেস্টিভ্যালের তারিখ নির্ধারণ করে। পুনাখায় দেখি, মূল প্রার্থনাকক্ষে দোতলা সমান গৌতম বুদ্ধের সোনালি রঙিন মূর্তি। বুদ্ধের সামনে অন্যদিনের চেয়েও রাজকীয় নৈবেদ্য রাখা আছে। বিভিন্ন ধরনের ফল ও খাবারের সঙ্গে রুপোর বাটিতে পানি। চারতলার ছাদ থেকে নিচতলা অবধি ঝুলে পড়ছে সিল্কের কাপড়ের রঙিন ঝালর। একেকটির একেক নকশা। ঝংখা ভাষায় লেখা আছে ধর্মগ্রন্থের বাক্য সারি সারি।
মনাস্টেরির মূল ভবনের দরজা প্রমাণ আকারের। বর্ডারে আঁকা তিব্বতি নকশা। ভেতরে অনেক উঁচু, বড় সোনালি রঙের প্রেয়ার হুইল, বাম থেকে ডানে ঘোরাতে হয়। ঘোরাতে ঘোরাতে বলতে হয়, ‘ওম মানি পাদ্মে হুম’। যার মানে হলো, পদ্মফুলের অন্তস্তলে থাকা মণি বা রত্নের প্রশস্তি।
মূল প্রার্থনাকক্ষের ভেতরের দেয়ালে বুদ্ধের এবং সে সময়কার জনসাধারণের জীবনযাত্রার চিত্র আঁকা নানান রঙে। সামনের দিকে সারি সারি আসন পাতা। আসনের সামনে কাঠের ছোট টেবিল। টেবিলে ধর্মগ্রন্থ, জপমালা, কাঁসার ঘণ্টা। কক্ষের এক পাশে বড় বড় ঢোল রাখা। প্রার্থনার মাঝে যা বাজানো হয়। মূল কক্ষের একদম শেষ প্রান্তে বুদ্ধ বসে আছেন নিশ্চুপ নৈবেদ্য সামনে নিয়ে।
এখনই ভিক্ষুদের প্রার্থনা শুরু হবে বলে আমাকে বেশিক্ষণ মূল কক্ষে ঘোরাফেরা করতে দেওয়া হলো না। এরই মাঝে স্থানীয় দুই মেয়ের সঙ্গে জমিয়ে ফেলেছি ভাব! চেনি আর ইয়াংডেন নাম তাদের। ওরা এ গাঁয়েরই মেয়ে। সম্পর্কে ননদ-ভাবি। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে বান্ধবী। ওরা আমাকে মনাস্টেরির তিনতলায় নিয়ে গেলেন, যেখান থেকে ভিক্ষুদের প্রার্থনা দেখা যায়। ওপর তলায় এখন জনসাধারণ আসতে শুরু করেছে। এই প্রার্থনার পরই শুরু হবে মূল অনুষ্ঠান। চেনির স্বামী নিচের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে আমাদের জন্য জায়গা রেখেছেন। চেনি, ইয়াংডেন—দুজনই ঝলমলে পোশাক পরে এসেছেন। সিল্কের কাপড়ের কিরা পরেছেন। কিরা সাধারণত তিন খণ্ডের হয়। না হয়ে উপায় আছে, যা ঠান্ডা পড়ে এ দেশে! ভেতরের জামার ওপরে র্যাপারের মতো স্কার্ট কোমর থেকে পায়ের পাতা অবধি জড়ানো আর তার ওপরে কয়েক স্তরের মোটা কাপড়ের কোট বা জ্যাকেট। প্রার্থনালয়ে আসতে হলে নারী-পুরুষ উভয়কেই নিজ পোশাকের ওপরে ওড়না জড়িয়ে নিতে হয়। পুরুষেরা আজ সবাই ঘো পরে আছেন। অবশ্য এ দেশের জাতীয় পোশাক এটিই। অফিস আদালতেও সবাই কিরা, ঘো পরেন। ঘো দেখতে কিরার মতোই, শুধু লম্বায় হাঁটুসমান। আর কিরার মতো এত রংবাহারি হয় না; শুধু স্ট্রাইপ ডিজাইন থাকে।
আমি চেনিদের সঙ্গে মনাস্টেরির উঠোনে চলে এলাম। সারা মনাস্টেরির বহিরাঙ্গ সাজানো হয়েছে রঙিন কাপড়ের ঝালর দিয়ে। সবাই চারকোনা উঠোনের কোণা ঘিরে সারিবদ্ধভাবে মাটিতে বসেছেন। বিদেশি ট্যুরিস্টরাও আছেন এ দলে। তাদের উৎসাহ আরও বেশি। লম্বা লম্বা লেন্সের ক্যামেরা নিয়ে বসেছেন কিংবা কেউ এক কোনায় দাঁড়িয়ে। কোথাও এতটুকু বিশৃঙ্খলা নেই।
অনুষ্ঠান শুরু হলো একদল বাদ্যযন্ত্রীর বাজনা দিয়ে। রঙিন লম্বা ব্রোকেডের পোশাক, মাথায় মুকুট পরে সানাই, মন্দিরা, সিমবাল, ঢোল বাজিয়ে চারকোনা উঠোনে কয়েকবার পাক খেলেন তারা। এরপর এই আশ্রমের প্রধান ভিক্ষু প্রার্থনা করে মূল অনুষ্ঠান শুরু করলেন। মূল অনুষ্ঠান বলতে আমরা যা জানি, তা হলো মংক ড্যান্স। ভিক্ষুরা বিভিন্ন রঙের লম্বা পোশাক আর বিভিন্ন ধরনের মুখোশ পরে উঠোনজুড়ে নেচে বেড়ান। কয়েকটি কারণে এই নাচের আয়োজন করা হয়: রাজ্যের সমৃদ্ধি, অশুভ শক্তিকে দূর করা, জাগতিক ও পারলৌকিক অনন্ত শান্তি লাভ। আর এটিই হাজার হাজার মাইল দূর থেকে পর্যটকদের টেনে আনে নির্ভার, শান্তিপূর্ণ, অমিয় আবহাওয়ার এই দেশের কোলে।
মুখোশ আর পোশাকের আড়ালে রয়েছেন একেকজন ভিক্ষু—যেন বোঝার উপায় নেই। আমার সামনে এখন যেন শুধু রং উড়ে বেড়াচ্ছে! একক ও দলবদ্ধভাবে নেচে যাচ্ছেন রঙিন মানুষেরা। কখনো উড়ছেন হাওয়ার মনে রং ধরানোর জন্য, কখনো নাচের তালে নিচু হয়ে মিশে যেতে চাইছেন ধরিত্রী মাতার আঁচল তলে। সঙ্গে বাজছে বাদ্যযন্ত্র। যন্ত্রশিল্পীরা মূল ভবনের নিচতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাজাচ্ছেন আপন মনে। আশ্রমের সব ভবনের সব তলার বারান্দায় এখন সব বয়সী মানুষ আর ভিক্ষুদের ভিড়। নিচের উঠোনে স্থান সংকুলান হওয়ার কথা নয়।
রাক্ষসের মতো দেখতে মুখোশ; কিন্তু ঘুরে ঘুরে সিল্কের বর্ণিল জামায় গোল গোল ঘূর্ণিপাক খেতে খেতে এই রঙিন রাক্ষস মুখ দেখতে আমার একটু ভয় লাগছে না। বরং মনে হচ্ছে, আমার বন্ধুরাই নেচে নেচে উজাড় করে দিতে চাইছেন নিজেদের অস্তিত্ব—জনকল্যাণে। দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য নিজের যা কিছু আছে বিলিয়ে দিতে চাইছেন। জনসাধারণও আজ আর ‘সাধারণ’ নেই। তারা হয়ে উঠেছেন যেন স্বর্গের স্বাধীন দূত! আপেলরঙা গালে হেসে হেসে ভিক্ষুদের নাচ দেখছেন নিশ্চুপ। বাজনার তালে মেলাচ্ছেন তাল।
অনেক দিনের অপেক্ষার অবসান আজ। এ দেশে উৎসবের দিন। আনন্দের রঙিন দিন।
ছবি: লেখক ও ইন্টারনেট
চমৎকার দৃশ্য বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন। প্রতিটি লাইন পড়ে মনে হচ্ছে চোখের সামনেই সব ভাসছে, দেখছি। ইংরেজি কোন মাসের কত তারিখ থেকে উৎসব টা শুরু হয়, সেটা লেখায় উল্লেখ থাকলে অনেক পর্যটকের জন্য ভালো হতো। কারন সময় টা জানা থাকলে অনেকেই ট্যুর প্লান টা সেভাবে সাজাতে পারেন। ধন্যবাদ।