ফিচার I বাটার অব গডস
ঈশ্বর কি মাখন খান? ঈশ্বরের মাখন বলুন আর ঐশ্বরিক মাখনই বলুন, সেটা এখন মর্ত্যরে মানুষের মুখে মুখে! আদি হোমিনিডদের খাবার আবারও ফিরেছে—স্টেক হাউসগুলোয়। ইউরোপের অনলাইন-অফলাইন শপেও বিকোচ্ছে দেদার। কেউবা ঘরেই বানিয়ে নিচ্ছে। সেই মাখন নিয়ে লিখেছেন আল মারুফ রাসেল
নৃতত্ত্ববিদেরা বলেন, হোমিনিডরা মাংস খাওয়া শুরু করেছিল যখন, তখন থেকেই মানবসভ্যতার গতিপথ বিশাল এক বাঁক নিতে শুরু করে। আজকের দিনের মানুষ হওয়ার পেছনে যে মাংসাশী স্বভাবটাই দায়ী, সেটা তারা বিভিন্ন তত্ত্ব দিয়ে প্রমাণের চেষ্টাও করেছেন। তাদের দাবি, মানুষের খাদ্যতালিকায় প্রথম প্রধান বিবর্তনীয় পরিবর্তন ছিল বড় বড় প্রাণীর মাংস ও মজ্জার অন্তর্ভুক্তি, যেটা ঘটেছিল ২৬ থেকে ৪০ লাখ বছর আগের কোনো এক সময়ে। ১৯২০-এর দশকে রেমন্ড ডার্টের আবিষ্কার করা তাউং চাইল্ডের হাড় দেখে তিনি দাবি করেছিলেন এই অস্ট্রালোপিথেসিন্সরা হাড়, দাঁত আর শিং দিয়ে তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করত প্রাণী শিকারে, আর নিজেদের ভেতরের লড়াইয়ে। পরে দেখা গেছে, ডার্টের আবিষ্কার করা কঙ্কালগুলোর ক্ষত তৈরি হয়েছিল চিতাবাঘের মতো কোনো প্রাণীর আক্রমণে, নিজেদের ভেতরকার হানাহানিতে নয়; আর ক্ষতগুলোয় সবচেয়ে বেশি রয়েছে পাথরের ছুরির আঘাত, তা ছিল অস্থি-মজ্জা আর মস্তিষ্কে। বলা হয় অস্থি-মজ্জা আর মস্তিষ্ক থেকেই সবচেয়ে বেশি প্রোটিন সংগ্রহ করত হোমিনিডরা, যখন পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তারা খাবারের জন্য নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল অন্য প্রাণী শিকারের ওপরে। লিন্ডা সিভিতেল্লো অবশ্য তার কুজিন অ্যান্ড কালচারে দাবি করেছেন, কেবল খাবারের অভাব নয়, মানুষ হাড় ভেঙে মজ্জা বের করে খেত; কারণ, এটা তাদের কাছে সুস্বাদু ছিল। আরও পরে দেখা যায়, অস্ট্রালোপিথেসিন্সদের উত্তরসূরি হোমো গোষ্ঠীর মস্তিষ্কের আকার বেশ বড় বড়; এই অতিরিক্ত ওজনের বিবর্তিত মস্তিষ্ক বহনের জন্য প্রয়োজন হতো অতিরিক্ত শক্তির, আর সেটার জোগানদাতা ছিল মাংস ও মজ্জা।
আমাদের গল্পটা অস্থির ভেতরে থাকা মজার মজ্জা নিয়েই, সেটাকেই বলা হচ্ছে ঈশ্বরের বা ঐশ্বরিক মাখন তথা বাটার অব গড। ইসরায়েলের তেল আবিবের কাসিম কেভে সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে চার লাখ বছর আগে মানুষ মজ্জাকে হাড়ের ভেতরে কয়েক সপ্তাহ রেখে সংরক্ষণ করে খেত আমাদের মতোই। হাড়গুলো ব্যবহৃত হতো এখনকার ক্যানের মতো। তারা নল্লি নিহারি বানিয়ে খেত, না পায়া খেত—তা নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে; তবে যেটা নিয়ে আমরা নিঃসন্দিহান, তা হলো মজ্জার ব্যবহার। প্রোটিনের উৎস হিসেবে এখনো প্রাণিজগতের অন্যান্য প্রাণীর পছন্দের তালিকার ওপরের দিকেই থাকে এই মজ্জা। এরপর মস্তিষ্ক আর চর্বি। ভিয়েতনামের জাতীয় খাবার ফো স্যুপ, ইন্দোনেশিয়ার কারি গুলাই ও স্যুপ সামসাম, আমাদের উপমহাদেশের নল্লি নিহারি ও পায়া, হাঙ্গেরির গরুর স্যুপ, ইতালীয় অসোবুকো, ফরাসি পত-অ-ফু, পুদিং আ লা’মেরিকান, পুদিং আ লা মোয়াল, ইরানীয় কারি ছাড়াও নেপালের সাপু মিশা আর আলাস্কার খাবারে পাওয়া যায় এই মজ্জার ব্যবহার; আফ্রিকার যেকোনো মাংসের কারিতে তো থাকেই। তবে এগুলো ছাপিয়ে বিশ্বজুড়ে টক অব দ্য স্টেক হাউসেসে পরিণত হয়েছে এই মজ্জা। কারণ, স্টেকের ওপরে এই মজ্জা ছড়িয়ে দিলে তার স্বাদ নাকি বেড়ে যায় বহুগুণে। ফরাসি রান্নার বাইবেলখ্যাত লাহুস গ্যাস্থোনোমিকে মজ্জার সংজ্ঞা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘মজ্জা-হাড়ের ভেতরে থাকা নরম, চর্বিযুক্ত পদার্থ।’ আগ বাড়িয়ে বলা হয়েছে, ‘ফুটন্ত জলে ডোবা গরম ছুরি দিয়ে মজ্জা মোটা টুকরো করে কেটে লবণজলে ভিজিয়ে (সেদ্ধ না করে) পানি ঝরিয়ে স্টেক পরিবেশনের সময় ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া কেটে, সেদ্ধ করে, পানি ঝরিয়ে এটা অন্য ব্রাউন সসেও ব্যবহৃত হয়।’ এরপর আরও বেশ কিছু পদের কথা বলা হয়েছে, যেমন ক্যানাপেস আ লা মোয়াল, ফ্রিতো আ লা মোয়াল, স্যালপিকোঁ দে মোয়াল, সস আলা মোয়াল, বুশে আলা মোয়াল।
ইতিহাস বলে, মধ্যযুগ থেকেই ইউরোপে স্টেকের সঙ্গে মোয়াল তথা মজ্জা দিয়ে পরিবেশন করার রীতি ছিল। তবে ইউরোপ আর ইউরোপ থেকে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে কাজিয়া করা সাদা চামড়ার লোকেরা আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার মতো জায়গায়ও সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল এই মজ্জার ব্যবহার। কিন্তু সময়ের স্রোতে তা হারিয়ে গিয়েছিল। তবে কথায় আছে, টাইম সাইকেলে পুরোনো জিনিসের কদর আবার ফিরে আসে—যেমন বেল বটম প্যান্ট, বড় কলারের শার্ট বা ভারতীয় আংরাখা ফিরে এসেছে ফ্যাশনে, ফিরে এসেছে প্রাকৃতিক রং, তেমনি খাবারের জগতে পুরোনো রেসিপি, মেনু নিয়েও ঘাঁটাঘাঁটি শুরু হয়েছে। এর ফলেই শেফ ফার্গাস হ্যান্ডারসন এটাকে ফিরিয়ে এনেছেন লন্ডনে তার রেস্তোরাঁ—সেইন্ট জনে। তারপর থেকেই শুরু হয়েছে অনলাইন-অফলাইন হাইপ। বিভিন্ন রেস্তোরাঁ তাদের নিজেদের মতো করে বাটার অব গডস পরিবেশন করছে। যদিও সেটা ঢাকাকে ছুঁতে পারেনি এখনো, ছোঁয়ার আশঙ্কা বা সম্ভাবনাও কম। তবে এটার বিকল্প কিছু বাটার ব্যবহার করা হচ্ছে ঢাকার স্টেক হাউসগুলোয়।
মজ্জার স্বাদ কেমন, সেটা ঢাকার লোকগুলোকে অন্তত মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। পুরান ঢাকার বিভিন্ন ঠেক থেকে মিরপুরের চান্দু—সব চেখে দেখা ঢাকাবাসী ভালোই জানে কেমন হয় এর স্বাদ আর শীতের কুয়াশার সকালে গরম নান দিয়ে সেটার ঝোল খেতে কেমন লাগে। তারপরও বলি, রান্নার পর এটা ঘন, নরম আর মাখনের মতো হয়ে ওঠে। কিন্তু এটা মাখনের থেকে হালকা, আরও সূক্ষ্ম, প্রায় গলে যাওয়া ধরনের। এর স্বাদ খানিকটা টক, সামান্য মিষ্টি, আর শেষে বাদামের মতো স্বাদ রেখে যায়। যদি এককথায় এর স্বাদ আর গঠনের কথা বলতে হয়, সেটা হবে—পুষ্টিকর। এখন পর্যন্ত মজ্জা নিয়ে যেটুকু কাজ হয়েছে, তাতে জানা গেছে, এতে সামান্য ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, আয়রন আর ভিটামিন এ, কে; বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন বি ও চর্বিতে দ্রবীভূত হওয়া ভিটামিন রয়েছে। তারপরও যেটুকু জানা যায়, তাতে মজ্জায় রয়েছে ৯৭ শতাংশ স্নেহ, ৩ শতাংশের কম দেহসার আর রীতিমতো শূন্য শতাংশ শর্করা। এতে থাকা কোলাজেন অন্য দুর্লভ প্রোটিন, গ্লাইসিন, গ্লুকোস্যামাইন ত্বক, হাড় ও কোষের সুস্থতা নিশ্চিত করে। মজ্জায় পলিস্যাচুরেটেড ফ্যাট রয়েছে, আর রয়েছে স্টিয়ারিক ও অলিক অ্যাসিড। ফলে শরীরের গঠন উন্নত হয়, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যথা কমে যায়।
ঢাকার রেস্তোরাঁয় পান আর না পান, চাইলে নিজের ঘরেই বানিয়ে নেওয়া যাবে এই ঈশ্বরের মাখন। স্টেকের জন্য অসাধারণ এই বাটার তৈরিতে প্রয়োজন হবে সাত দিন সময়, আর অল্প কিছু উপকরণ।
উপকরণ: ডিম ৪টি, লবণ ২ কাপ, চিনি সোয়া ১ কাপ, মজ্জা ৪৫৩ গ্রাম, পানি ১ কাপ, মাখন ৮ টেবিল চামচ, পার্সলে ১ চা-চামচ, শ্যালোট ২ চা-চামচ, অ্যানকোভি ১ চা-চামচ।
প্রথম দিনে, একটি থালায় লবণ আর চিনির মিশ্রণ তৈরি করতে হবে, আর চারটি গর্ত করতে হবে ডিমের কুসুম রাখার জন্য। তারপর সেখানে ডিমের থেকে কুসুম আলাদা করে ওই জায়গায় রাখতে হবে। খুব সাবধানে কুসুমগুলোকে লবণ আর চিনির সাগরে সমাহিত করতে হবে, যেন কুসুম গলে না যায়। তারপর এই থালাকে নিরুপদ্রবভাবে অন্তত পাঁচ দিন রেফ্রিজারেটরে রেখে দিতে হবে। চতুর্থ দিনে, লবণপানিতে হাড়সহ মজ্জা ভিজিয়ে পরের তিন দিন রেফ্রিজারেট করতে হবে। পঞ্চম দিনে, মিশ্রণের থালা থেকে ডিমের কুসুমগুলো পুনরুত্থিত করতে হবে, আর সাবধানে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে যেন কিছু লেগে না থাকে। এরপর ডিমের কুসুমগুলো পার্চমেন্ট পেপারে জড়িয়ে অল্প আঁচে দুই ঘণ্টা ধরে সেদ্ধ করে ঠান্ডা করতে হবে। এরপর গ্রেটার দিয়ে ডিমের কুসুমগুলো গুঁড়া করে ফেলতে হবে। লবণপানি থেকে মজ্জাসহ হাড় বের করে ১০ মিনিট ফুটন্ত পানিতে সেদ্ধ করে ঠান্ডা করতে হবে। খুব সাবধানে মজ্জা বের করে পাশে একটি পাত্রে ঢেকে রাখতে হবে। এরপর ফুড প্রসেসরে সব উপকরণ দিয়ে একসঙ্গে মিশিয়ে ফেলতে হবে। একটি প্লাস্টিকের শিট বিছিয়ে মিশ্রণটি মাঝ বরাবর রাখতে হবে। এরপর প্লাস্টিক শিটকে খুব শক্ত করে টিউবের আকৃতিতে পেঁচিয়ে দিতে হবে। রেফ্রিজারেটরে দুই ঘণ্টা রেখে টিউব থেকে প্লাস্টিকের আবরণ সরিয়ে ফেলতে হবে, আর মাখনের টিউবকে আধা ইঞ্চি পুরু করে কাটতে হবে। প্রয়োজনমতো ব্যবহার করে আবার রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করা যায় এক থেকে দেড় মাস পর্যন্ত।
এটা যে কেবল স্টেকের সঙ্গেই খাওয়া যায় তা নয়, রুটির স্প্রেড হিসেবে, হট স্যালাডের সঙ্গে বা যেকোনো গরম মিট ডিশের সঙ্গেই দারুণ সঙ্গ দেয়। ঈশ্বরের মাখন তবে মর্ত্যলোকেই বিরাজ করুক।
ছবি: লেখক