পাতে পরিমিতি I লিকুইড ডায়েট
কখনো কখনো ভরসা রাখতে হয় জলীয় আহারে। কিন্তু তা ঠিকঠাক হওয়া চাই। পরামর্শ দিচ্ছেন নিশাত শারমিন নিশি
বেঁচে থাকার জন্য খাবার হলো মৌলিক চাহিদার প্রথম ধাপ। বিভিন্ন কারণে খাবারকে রেসট্রিকটেড করা হয়। সাধারণত রোগের ধরন বা শারীরিক বিশেষ অবস্থার কথা মাথায় রেখে খাবারের প্যাটার্ন নির্ধারিত হয়, যাকে বলে ডায়েট। এর ধরন বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন: নরমাল ডায়েট, সফট বা সেমি সলিড ডায়েট, ব্লান্ড ডায়েট, লিকুইড ডায়েট ইত্যাদি।
যে কারণে লিকুইড ডায়েট
বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে লিকুইড ডায়েট গ্রহণের ক্ষেত্রে। ওজন কমানোর জন্য অনেকে এটি অনুসরণ করেন। ওজন দ্রুত কমানোর জন্য শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে অনেক পুষ্টিবিদ নির্দিষ্ট কয়েক দিনের জন্য অনেককে লিকুইড ডায়েট সাময়িকভাবে গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া বড় ধরনের সার্জারি বা অপারেশনের পর রোগী সরাসরি স্বাভাবিক খাবার গ্রহণ করতে না পারলে অনেক সময় লিকুইড ডায়েটের নির্দেশনা দেওয়া হয়। যেমন গলার বা পেটের অপারেশন, কোলনের জটিলতাসংক্রান্ত সমস্যায় সাধারণত এ ধরনের লিকুইড ডায়েট গ্রহণের প্রয়োজন হতে পারে।
গ্রহণকাল
লিকুইড ডায়েট দীর্ঘ মেয়াদে গ্রহণ করা যায় না। এটি তিন থেকে সাত দিন অথবা সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ পর্যন্ত গ্রহণ করা যেতে পারে।
লিকুইড ডায়েটে নানা রকমের খাদ্য উপাদান দেওয়ার প্রয়োজন হয়। কেননা একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি উপাদান যদি খাদ্যতালিকায় না থাকে, সে ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধরে এ ডায়েট ফলো করলে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও মিনারেলসের ঘাটতি হতে পারে। ফলে দেখা দিতে পারে বিভিন্ন উপসর্গ; যেমন স্কিনের ইলাস্টিসিটি কমে স্কিন ঝুলে যাওয়া, নখ সহজে ভেঙে পড়া, চুল পড়া, অ্যাসিডিটি বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, ওজন কমে যাওয়া প্রভৃতি।
ওজন কমাতে যারা লিকুইড ডায়েট ফলো করতে চান, তাদের খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন এই রেসিপিগুলো:
টমেটো স্যুপ
ওজন কমানোর জন্য টমেটো স্যুপ রাখা যেতে পারে ডায়েটে। এতে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট; যেমন লাইকোপেন, ফ্লাভোনয়েড, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই ইত্যাদি। টমেটোর এই পুষ্টি উপাদানগুলো সঠিকভাবে পেতে চাইলে স্যালাড হিসেবে কাঁচা খাওয়ার চেয়ে রান্না করে খেলে বেশি উপকার।
উপাদান: টমেটো পেস্ট আধা কাপ, পাকা টমেটো কিউব করে কাটা আধা কাপ, পেঁয়াজকুচি পরিমাণমতো, রসুনকুচি পরিমাণমতো, ধনেপাতা, আদা স্লাইস, লবণ, তেল, লেবুর রস, সামান্য মরিচগুঁড়া।
প্রক্রিয়া: একটি ফ্রাইপ্যানে এক চা-চামচ তেল নিন। গরম হয়ে গেলে তেলের মধ্যে রসুনকুচি হালকা ভেজে তারপর পেঁয়াজ, লবণ এবং পরিমাণমতো মরিচগুঁড়া দিয়ে সঙ্গে সামান্য পানি দিন। হালকা কষানো হয়ে গেলে টমেটো পেস্ট এবং এক কাপ পানি দিয়ে অল্প আঁচে চার-পাঁচ মিনিট চুলায় রাখুন। এরপর কুচি করা টমেটো ও আদার স্লাইস দিন। একটু ঘন হয়ে গেলে নামানোর আগে অল্প লেবুর রস ও ধনেপাতা দিয়ে নামিয়ে ফেলুন।
চিকেন ক্লিয়ার স্যুপ
রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানো থেকে শুরু করে সেল রিপেয়ার পর্যন্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে প্রোটিনের। তাই যে ধরনের ডায়েটই ফলো করুন না কেন, খাদ্যতালিকায় যেন পর্যাপ্ত প্রোটিন থাকে। সে ক্ষেত্রে যারা লিকুইড ডায়েট ফলো করতে চান, তারা ডায়েটে রাখতে পারেন চিকেন ক্লিয়ার স্যুপ।
উপাদান: চিকেন দুই পিস (৬০ গ্রাম), আদা পেস্ট, রসুন পেস্ট, আস্ত দারুচিনি, কয়েকটা আস্ত গোলমরিচ ও বাটার।
পদ্ধতি: প্রথমে দুই পিস চিকেন নিয়ে সামান্য লবণ দিয়ে সেদ্ধ করে নিন। এরপর একটি ফ্রাইপ্যানে এক চা-চামচ বাটার দিয়ে তাতে সামান্য রসুন ও আদার পেস্ট দিন। এরপর অল্প পানি দিয়ে আস্ত দারুচিনি ও কয়েকটি গোলমরিচ আস্ত দিয়ে দিন। হালকা কষানো হয়ে গেলে চিকেন স্টক ঢেলে দিন। প্রয়োজনে সামান্য লবণ দিন। দু-তিন মিনিট তাপে ফুটে গেলে পাত্রে ঢেলে নিলেই স্যুপ খাওয়ার উপযোগী।
যারা লিকুইড ডায়েট ফলো করতে চান, তাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, যেহেতু খুব কম ক্যালরি গ্রহণ করা হচ্ছে, তাই দীর্ঘ সময় খালি পেটে থাকা যাবে না। অবশ্যই প্রতি আড়াই থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে খাবার গ্রহণ করতে হবে। নয়তো মাথা ঘোরানো, দুর্বল লাগা, মেজাজ খিটখিটে লাগা প্রভৃতি সমস্যা দেখা দিতে পারে। কেননা দেহে পর্যাপ্ত গ্লুকোজ না থাকলে ব্রেন সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না এবং শরীরে ক্লান্তি ভাব দেখা দেয়।
তরলের জয়
লিকুইড ডায়েটে ন্যাচারাল ফলের শরবত বা জুস, সবজির স্যুপ বা জুস, স্মুদি, ব্রোথ, চা, কফি, দুধ ইত্যাদি থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে খাদ্যতালিকা এমনভাবে সাজাতে হবে, যেন বিভিন্ন রঙের ভ্যারিয়েশন থাকে। সে ক্ষেত্রে রইল কিছু টিপস:
সাদা রঙের খাদ্য খাওয়া যেতে পারে। পাতলা সুজি বা সাগু রাখা যেতে পারে মেইন কোর্স হিসেবে। এতে রয়েছে পর্যাপ্ত কার্বোহাইড্রেট, যা শরীরে সারা দিনের শক্তি প্রদানে সাহায্য করবে। গরুর দুধ ও সয়া দুধ প্রোটিনের উৎকৃষ্ট উৎস। এ ছাড়া ডিমের সাদা অংশ দিয়ে তৈরি স্যুপও রাখতে পারেন লিকুইড ডায়েটে।
হলুদ বা কমলা রং মানেই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর। সে ক্ষেত্রে যারা লিকুইড ডায়েট ফলো করতে চান, তারা ডায়েটে রাখতে পারেন গাজরের তৈরি জুস বা সুপ। এ ছাড়া মাল্টা বা অরেঞ্জ জুসও রাখা যেতে পারে।
যারা এভারগ্রিন থাকতে চান, তাদের খাদ্যতালিকায় গ্রিনের অবস্থান রাখা জরুরি। সে ক্ষেত্রে রাখতে পারেন গ্রিন টি। ওজন কমানোসহ শারীরিক নানা সমস্যার সমাধানে এর ভূমিকা অসাধারণ।
যদিও আমাদের দেশে বেরি খুব কম পাওয়া যায়, তবে গরমকালে পাওয়া যায় জাম। যা পুষ্টি উপাদানে ভরপুর। তাই বেগুনি রঙের জামের জুস বা বেরির জুস আপনার লিকুইড ডায়েটকে করতে পারে দারুণ।
ডিটক্স ওয়াটার
বর্তমানে ডায়েট শব্দটি অতি জনপ্রিয়। যারা ডায়েট করেন বা করতে চান, তাদের জন্য ডিটক্স ওয়াটার অত্যন্ত কমন একটি শব্দ। লিকুইড ডায়েটে রাখতে পারেন তা। এটি টক্সিন মুক্ত করে দেহকে ডিটক্সিফাই করে। বিভিন্নভাবে তৈরি করা যায় এই ডিটক্স ওয়াটার। যেমন:
এক লিটার পানিতে মেথি ভিজিয়ে রাখুন সারা রাত। দুই টেবিল চামচ মেথি সারা রাত ভিজে দারুণ হলুদ আভার পানিতে পরিণত হবে। সকালে তাতে অল্প শসা স্লাইস, লেমন দিয়ে নিলে সারা দিনে বারবার ক্ষুধা লাগার যে প্রবণতা, সেটি কমে গিয়ে ওজন কমাতেও সাহায্য করবে।
এ ছাড়া আপেল সিডার ভিনেগার এক গ্লাস পানিতে তিন চা-চামচ যুক্ত করে গ্রহণ করা যেতে পারে। এটিও ওজন কমাতে সাহায্য করে।
মনে রাখতে হবে, ডায়েট যা-ই অনুসরণ করুন না কেন, সেটি যেন সায়েন্টিফিক হয়। ওজন কমাতে গিয়ে এমন কিছু গ্রহণ করা ঠিক হবে না, যার দরুন পরবর্তী সময়ে কোনো সমস্যার আবির্ভাব ঘটে। সত্যি বলতে, সুস্থ থাকাই বড় ব্যাপার। তাই বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে না হলে সে ডায়েট যথাযথভাবে কাজ করতে পারে না বিধায় সঠিক ফল পাওয়াও সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই এক্সপার্টের পরামর্শ অনুযায়ী ডায়েট করুন। সুস্থভাবে বাঁচুন।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ছবি: ইন্টারনেট