ফিচার I পয়সার গয়না
একসময় ধাতব মুদ্রা হয়ে উঠেছিল গয়নার প্রধান উপকরণ। পরে তাতে যোগ হলো পুঁতি। আজও সেই ধারা টিকে আছে আদিবাসীদের মধ্যে
প্রাচীন মিসরীয়রা তাদের সৈন্যদের মুদ্রা আকারের সোনার মেডেল দিয়ে সাজাতো। মেডেলগুলো দেখতে ওই সময়ের মুদ্রার মতোই। মনে করা হয়, তখন থেকেই মানুষ মুদ্রার গয়না পরতে শুরু করে।
১৯ শতকের শেষ ভাগে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মুদ্রার গয়না খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তখন তাতে ফুলের মোটিফ বা আদ্যাক্ষর দিয়ে নকশা খোদাই করা হতো। এই ধরনের গয়না সেই আমলে ‘সুইট হার্ট’ গয়না নামে প্রচলিত ছিল। কারণ, নাবিক ও সৈন্যরা যুদ্ধে যাবার প্রাক্কালে এই গয়নাগুলো তাদের স্ত্রী বা প্রেমিকার কাছ থেকে উপহার হিসেবে গ্রহণ করতো।
এটি প্রচলনের কাল থেকে মূলত দুই ধরনের গয়না মানুষ ব্যবহার করতো। এক. আস্ত মুদ্রার গয়না এবং দুই. কাটা মুদ্রার গয়না। কারিগরি দিক দিয়ে কাটা মুদ্রার গয়নার খুব কদর ছিল। কারণ, কাটা মুদ্রার গয়নায় প্রকাশ পেত কারিগরদের সৃষ্টিশীলতা, স্বকীয়তা ও দক্ষতা। যিনি পরতেন তিনি হয়ে উঠতেন অনন্য। এই মুদ্রার গয়না সোনা, রুপা ইত্যাদি ধাতু দিয়ে তৈরি হতো। হার, লকেট ছাড়াও তৈরি হতো কানের দুল, ব্রেসলেট, কাফলিং, হাতের রিং প্রভৃতি।
পরবর্তী সময়ে আফ্রিকা ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন ধরনের মুদ্রার গয়নার ব্যবহার দেখা যায়। যেমন দক্ষিণ ভারতের ‘কাসু মালা’। এই মালা ১০০টি সোনার মুদ্রা দিয়ে তৈরি হয়। যেগুলোতে দেবদেবীর মূর্তি খোদাই করা থাকে।
ভারতের আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল, সিমলা, মানালি, তথা উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের আদি জনগোষ্ঠী মুদ্রার গয়না আজও ব্যবহার করে।
বাংলাদেশে যেসব আদি জনগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের সংস্কৃতিতে মুদ্রার গয়না ছাড়া মেয়েদের বিয়ে অকল্পনীয়। কোনো কোনো সমাজব্যবস্থায় বিয়ের অনেক আগে থেকেই নিজের জন্য মুদ্রা জমা করে আদিবাসী নারীরা। অন্যদিকে কোনো কোনো সমাজে বর ১৩০টি মুদ্রা দিয়ে মালা বানিয়ে বিয়ের কনেকে সাজিয়ে ঘরে তুলে আনে। এই মুদ্রাগুলো দিয়ে নিজের পছন্দমতো পুঁতির ফাঁকে ফাঁকে বসিয়ে মালা তৈরি করা হয়। তৈরির আগে মুদ্রাগুলোতে আংটা লাগানো হয়। যার যতটুকু ইচ্ছে, বড় করে বানিয়ে নেয় মুদ্রার মালা।
অতীতে আদিবাসী নারীরা গয়নায় ব্রিটিশ মুদ্রা অথবা তামা ও রুপার মুদ্রা বেশি ব্যবহার করতো। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুদ্রার এই মালাগুলোর বিভিন্ন নাম রয়েছে। যেমন একে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ ‘ট্যাগার ছড়া’, চাকমা জনগোষ্ঠী ‘পয়জে মালা’, গারোরা ‘দাঙাছড়া’, ত্রিপুরারা ‘রাংবতাং’, ম্রো জনগোষ্ঠী ‘পাকড়ি পুটি মালা’ বলে থাকে। বর্তমানে নেত্রকোনা জেলার সুসং-দুর্গাপুর, কলমাকান্দা এবং সুনামগঞ্জের কিছু এলাকায় বালাই আধিবাসীদের বসবাস রয়েছে। ভারতের মতো বাংলাদেশের বালাই জনগোষ্ঠীরাও মুদ্রার ‘বয়লা’ ব্যবহার করে। ‘ট্যাগার ছড়া’ ছাড়াও আরও দুধরনের মুদ্রার গয়না তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর নারীরা ব্যবহার করে। এগুলো হলো ‘আল্যাচুরি’ এবং ‘চন্দনা হার’। মুদ্রার এই গয়না কেবল গলার হার হিসেবেই ব্যবহৃত হয় না। খোঁপার কাঁটায়, আংটিতে এমনকি কোমরের বিছায়ও তারা এই মুদ্রা পুঁতির সঙ্গে গেঁথে নিজেদের সাজায়।
মাধুরি সঞ্চিতা স্মৃতি
মডেল: প্রিয়াম
মেকওভার: পারসোনা
গয়না: লেখক
ছবি: মর্তুজা আলম
আদিবাসী ছবি: কমল দাশ