ফিচার I মেলার মিষ্টান্ন
মেলার কথা মনে হলেই সবার আগে মনে পড়ে হরেক রকম মিষ্টির কথা। বাংলাদেশে হেন মেলা নেই, যেখানে মিষ্টি বা মিষ্টিজাতীয় কিছু না কিছু নেই। মেলা ও মিষ্টি একে অপরের পরিপূরক। বাংলাদেশে মেলার যেমন বৈচিত্র্য আছে, তেমনি মেলাভেদে মিষ্টির পার্থক্য দেখা যায় স্বাদ-গন্ধ-বর্ণে। আবার একই মিষ্টির নানা আঞ্চলিক নাম আছে। সেই সঙ্গে মিষ্টি তৈরির কৌশল অঞ্চলভেদে ভিন্ন। তবে মেলাভেদে মিষ্টির প্রকরণ যতই আলাদা হোক না কেন, মেলার মিষ্টান্নের স্বাদ ও বর্ণ অসাধারণ। এসব মিষ্টি যিনি চেখেছেন, তিনি তা বারবার নিতে চাইবেন। এ জন্যই তো সবাই মেলায় গিয়ে পরিচিত বা ভালো লাগা মিষ্টিটাই প্রথমে খোঁজেন। অসংখ্য মেলা আর মেলার মিষ্টির সন্ধান দিয়েছেন উদয় শংকর বিশ্বাস
বাংলাদেশের লোকজ মেলায় কত ধরনের মিষ্টি পাওয়া যায়, সে সম্পর্কে সুর্নিদিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে, এমন কিছু মিষ্টি আছে, যা শুধু মেলাতেই পাওয়া যায়। মেলা ছাড়া অন্য সময় মিষ্টির দোকানে সেসবের দেখা পাওয়া ভার। মেলার মিষ্টি কিছু শুকনো, আর কিছু রসের। যে যেমন পছন্দ করে, সে তেমন মিষ্টি বেছে নেয়। গ্রামীণ মেলার এক বড় অংশ ধর্মীয় কৃত্যানুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত, তাই মিষ্টিই প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে মেলাতে বিকোয়। কিছু সাধারণ মিষ্টি আছে, যা দেশের সব মেলাতেই পাওয়া যায়। আবার কিছু কিছু মিষ্টি আছে, যা বিশেষ বিশেষ মেলায় পাওয়া যায়। বাংলাদেশকে মেলার দেশ বলা যায়। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) ১৯৯৬ সালে দেশব্যাপী লোকজ মেলার একটি সরেজমিন অনুসন্ধান করেছিল। সে সময় সারা দেশের ১ হাজার ৩৮৭টি মেলার নাম, স্থান, কত তারিখ থেকে কত তারিখ পর্যন্ত হয়, কী কী পণ্য বিক্রি হয়, সেসবের বিবরণ আছে। কাজটি করেছিলেন ফোকলোর গবেষক মোহাম্মদ সাইদুর। এই তালিকাকে প্রামাণ্য ধরে বলা যায়, মেলার দেশ বাংলাদেশে যেমন মেলার বৈচিত্র্য আছে, আছে তেমনি মেলার মিষ্টিরও বৈচিত্র্য। তেমনই কিছু মিষ্টির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে আপনাদের স্মৃতিকাতর করে দেয়ার লোভ সামলানো যাচ্ছে না।
বাতাসা: বাতাসা মেলার সব থেকে পরিচিত মিষ্টি। চিনির তৈরি বাতাসার সঙ্গে সব বাঙালিরই পরিচয় আছে। এমন মেলার দেখা পাওয়া ভার যেখানে বাতাসার বিকিকিনি নেই। বাতাসার এত পরিমাণ আনাগোনা, মেলা ছাড়া দেখা যায় না। বাতাস হালকা ও বহন করা সুবিধা হওয়ায় এর জনপ্রিয়তা এতটুকু কমেনি। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বাতাসার বহুল ব্যবহার দেখা যায়। চিনির তৈরি বাতাস বাঙালির অতীব প্রিয়। বাতাসা সব মেলায় বিক্রি হলেও এর বহুল ব্যবহার দেখা যায় গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দি গ্রামে অনুষ্ঠিত মতুয়া মেলায়। চৈত্র মাসের বারুণী স্নান উপলক্ষে বিশাল মেলা বসে এখানে। মতুয়া হলো হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের অনুসারী একটি লোকসম্প্রদায়। বরিশাল-গোপালগঞ্জ-বাগেরহাট-যশোর-খুলনা-ফরিদপুর অঞ্চলে কয়েক লাখ মতুয়া ভক্ত আছে। এরা প্রতিবছর ওড়াকান্দির মেলায় সমবেত হন। মতুয়া ভক্তরা দলে দলে মেলায় আসেন এবং সবার উদ্দেশে বাতাসার লুট দেন। এ জন্য শত শত মণ বাতাসা বিক্রি হয় ওড়াকান্দির মেলায়।
মিছরি: মিছরিও খুব পরিচিত মিষ্টিদ্রব্য। সাধারণত পায়েস ও শরবতে মিছরি ব্যবহার করা হয়। কেউ কেউ অবশ্য খালি মিছরিও খান। গরমকালে অনেকেই মিছরির শরবত পছন্দ করেন। মিছরির ব্যবহার বহুবিধ। চিনির মিছরি থেকে তালমিছরির চাহিদাই বেশি। গ্রামীণ মেলায় সচরাচর মিছরি বিক্রি হয় না। তবে, ব্যতিক্রম বলা যায় নারায়ণগঞ্জের বারদীর মেলাকে। প্রতিবছর ১৯ জ্যৈষ্ঠ লোকনাথ ব্রহ্মচারীর তিরোভাব উপলক্ষে বারদীর লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমে নানা কৃত্যানুষ্ঠান হয় এবং এ উপলক্ষে আশ্রম প্রাঙ্গণে বসে বিশাল লোকজ মেলা। এ মেলায় আগত লোকনাথ ভক্তরা মিছরি কেনেন। কারণ, লোকনাথ বাবার প্রধান ভোগ হলো মিছরি। ভক্তরা লোকনাথ বাবার প্রিয় মিছরি ভোগ হিসেবে দান করেন। এ মেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন মেলায় মিছরি বিক্রি হয়।
কদমা: বাতাসা-মিছরির মতো আরেকটি পরিচিত মিষ্টান্ন হলো কদমা। এটিও চিনির তৈরি। সাদা ধবধবে কদমার আকর্ষণে মোহিত না হয়ে কেউই পারেন না। ছোট-বড়-মাঝারি বিভিন্ন আকারের কদমা লোকজ মেলায় পাওয়া যায়। কদমা দিয়ে মুড়ি খেতে ভারি মজা। প্রাচীন লোকজন এখনো কদমা খান। অবশ্য বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা কদমা খুব একটা পছন্দ করে না। তবে, তাই বলে কদমার বিক্রি কমে গেছে, এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। কদমা বহাল তবিয়তে এখনো লোকজ মেলায় নিজের জায়গা ধরে রেখেছে। মেলা ছাড়া কদমার বিক্রি তেমন হতে দেখা যায় না। ঠাকুরগাঁওয়ের নেকমরদের মেলায় কদমার বিক্রি চোখে পড়ার মতো। ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল থানার ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে নেকমরদ নামে একটি প্রাচীন জনপদ আছে। এখানে সৈয়দ নাসিরুদ্দিন শাহের মাজার আছে, যা ভক্তদের কাছে নেকমরদ নামে পরিচিত। প্রতিবছর নেকমরদের মেলায় অন্যান্য মিষ্টির পাশাপাশি শত শত কেজি কদমা বিক্রি হয়। রঙিন কদমারও দেখা মেলে এই মেলায়।
নকুলদানা: চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দে মিলিত হন অষ্টমী স্নানের জন্য। পুণ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে তারা ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান করেন। এ উপলক্ষে বিশাল মেলা বসে, যা লাঙ্গলবন্দের মেলা নামে পরিচিত। এ মেলার সঙ্গে ধর্মীয় যোগ থাকায় অন্যান্য মিষ্টান্নের সঙ্গে নকুলদানা বিক্রি হয়। নকুলদানা হলো চিনির তৈরি একধরনের ছোট মিষ্টি। অনেকে একে খাগড়াই বলেন। চিনির প্রলেপের ভেতরে থাকা খই বা মটর দানা খুঁজে পেয়ে ছোটরা খুব মজা পায়। বেশি মিষ্টি হওয়ায় খালি এ মিষ্টি খাওয়া দুরূহ। সে জন্য মুড়ি বা খইয়ের সঙ্গে নকুলদানা খাওয়া হয়। একসময় এ মিষ্টি হিন্দুদের নামযজ্ঞসহ ধর্মীয় বিভিন্ন পরবে অনুষঙ্গ ছিল। এখন মেলা ছাড়া তেমন দেখা মেলে না। লাঙ্গলবন্দের মেলায় আগত ভক্তরা দেবতাকে নকুলদানা নৈবেদ্য হিসেবে প্রদান করেন এবং মেলা শেষে বাড়ির জন্যও তা কিনে নিয়ে যান। একই চিত্র অন্যান্য লোকজ মেলাতে এখনো দেখা যায়।
গজা: গজা বেশ মুখরোচক মিষ্টি। প্রবাদে বলে, ‘রাজা খায় গজা’। ময়দার তৈরি গজা চিনির প্রলেপে হয়ে ওঠে লোভনীয় এক মিষ্টি। গজা বিভিন্ন আকারের হয়। সাধারণত আঙুল প্রমাণ আকারের গজাই বেশির ভাগ মানুষ পছন্দ করেন। এ ছাড়া চৌকোনাকার গজারও দেখা মেলে। চিনি ও গুড়- দুই ধরনের গজাই বাঙালিকে মোহিত করে রেখেছে। রুচি অনুযায়ী কেউ চিনির আবার কেউ গুড়ের গজা পছন্দ করেন। পছন্দ যেমনই হোক মেলায় গিয়ে গজার স্বাদ নিতে কেউই ভুল করেন না। এখন রঙিন গজাও দেখা যায় বিভিন্ন মেলায়। তবে এসব গজার স্বাদ সনাতনী গজা থেকে ভিন্ন। হালকা মিষ্টি বলে বয়স্করা রঙিন গজা পছন্দ করেন না। অনেকে একে খুরমাও বলেন। গজার জনপ্রিয়তার মূল কারণ, এটি কয়েক দিন রেখে খাওয়া যায়। দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দিরের রাস উপলক্ষে যে মেলা বসে, সে মেলায় হরেক রকম গজার দেখা মেলে। গজা না নিয়ে এ মেলা থেকে কেউ বাড়ি ফেরেন না।
চিনির পুতুল: মেলায় চিনির পুতুল দেখা যাবে না, এটা হতেই পারে না। শুধু মেলাতেই দেখা মেলে চিনির পুতুল বা ছাঁচের পুতুলের। খেতে তেমন ভালো না হলেও দেখতে ভালো হওয়ায় ছোটরা এ মিষ্টি খুব পছন্দ করে। চিনির তৈরি ছাঁচের হাতি-ঘোড়া-হরিণ-নৌকা-দাবার গুটি- এমন সব বিচিত্র পুতুল ছোটদের মন নিমেষে হরণ করে নেয়। দোকানিদের কাছে গিয়ে অনেকেই কে কয়টি পুতুল বেছে নিতে পেরেছে, সে প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। ছাঁচের পুতুলের চাহিদা এখনো মেলার মিষ্টির মধ্যে শীর্ষে। দেশের অন্য লোকজ মেলার মতো জামালপুরের হজরত শাহ কামাল (র.) মাজারে বৈশাখ মাসে অনুষ্ঠিত ‘দুরমুট’ মেলায় এ মিষ্টি বিকিকিনি হতে দেখা যায়। ছাঁচের পুতুলের সঙ্গে মেলার স্মৃতি অনেকের স্মৃতিপটে জ্বলজ্বল করে।
খাজা: খাজাও খুব মুখরোচক মিষ্টি। অল্পবিস্তর লোকজ মেলায় খাজা দেখা গেলেও সব থেকে বেশি খাজার দেখা মেলে কুষ্টিয়ার লালনের মেলায়। লালন শাহ ফকিরের তিরোধান ও ফাল্গুনের দোল উৎসবে অনুষ্ঠিত কুমারখালীর কালিগঙ্গা নদীর তীরের ছেঁউড়িয়ার লালন মেলা মানে খাজা বিক্রি হবেই। তিলের তৈরি কুষ্টিয়ার খাজার সুখ্যাতি দেশের সর্বত্র। চিনি ও গুড়- দুই ধরনের খাজাই বিক্রি হয় এ মেলায়। লালনের মেলায় গেছেন কিন্তু খাজা নিয়ে ফেরেননি এমন লোকের সংখ্যা নগণ্য।
বাদামবাহার: লোকজ মেলার একটি অতি পরিচিত মিষ্টি হলো বাদামবাহার। চিনির শিরার মধ্যে খোসা ছড়ানো বাদাম ছড়িয়ে ঠান্ডা করে তৈরি করা হয় বাদামবাহার। সাধারণত মেলায় যারা চিনাবাদাম বিক্রি করেন, তাদের কাছে পাওয়া যায় এটি। এ ছাড়া বাতাসা-কদমা বিক্রেতাদের কাছেও বাদামবাহারের দেখা মেলে। ছোটদের কাছে এটি বেশ লোভনীয় খাবার। ছোটরা বাদামবাহার খেতে খেতে বেলুন হাতে মেলায় ঘুরে বেড়ায়। বাদামবাহারের জনপ্রিয়তা প্রথম শুরু হয় মেলাতেই। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে বাদাম বিক্রেতাদের হাত ধরে সারা দেশে। অসম্ভব মিষ্টি বলে বাদামবাহার বেশি খাওয়া যায় না। চট্টগ্রামের ‘সীতাকুণ্ডের মেলা’ বা ‘চন্দ্রনাথের মেলা’য় বাদামবাহার পাওয়া যায়। প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশ তিথিতে অর্থাৎ শিবরাত্রিতে চন্দ্রনাথ মন্দিরে বসে এ মেলা। পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দির প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে সীতাকুণ্ডের বিশাল এলাকায়। সীতাকুণ্ডের মেলার মতো সব লোকজ মেলায় বাদামবাহার দেখা যায়।
কটকটি: প্রতিবছর বৈশাখ মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার বগুড়ার মহাস্থানগড়ের শাহ সুলতানের মাজারে অনুষ্ঠিত হয় বার্ষিক ওরস। দেশবরেণ্য সাধুসন্তদের মিলনমেলায় পরিণত হয় মহাস্থানগড়ের এই ওরস। এ উপলক্ষে বসে বিশাল এক মেলা। মাজার কমপ্লেক্স ছাড়িয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। এ মেলার প্রধান আকর্ষণ গাজা, মিষ্টি নয়। গাজার এত আমদানি আর কোনো ওরসে দেখা যায় না। গাজার পাশাপাশি এ মেলায় ‘কটকটি’ নামে বিচিত্র এক মিষ্টির দেখা মেলে। বগুড়ার কটকটির খ্যাতি দেশব্যাপী। বিশেষত মহাস্থানগড়ের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে কটকটি নামক মিষ্টিটি। এটি অনেকটা গজাজাতীয়, তবে চৌকোনা ও শক্ত। রঙিন কটকটি তৈরিতে ব্যবহার করা হয় ময়দা, বেসন, গুড় ও রং। লাল ও হলদে রঙের কটকটি তৈরির প্রধান উপাদান হলো গুড়। কটকটির গা গুড়ে এমনভাবে মাখো মাখো থাকে যে আলাদা করা যায় না। কেজি দরে কটকটি বিক্রি করা হয়। সারা বছর বিক্রি হলেও ওরসের সময় এখানকার কটকটির বিক্রি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। মহাস্থানগড়ের মেলা ও কটকটি যেন একই সূত্রে গাঁথা। সারা বছর এখানকার দোকানিরা অপেক্ষা করেন এ মেলার জন্য। কারণ, তাদের এ মেলায় যে পরিমাণ কটকটি বিক্রি হয়, তা বছরের অন্য সময় হয় না। আবার অনেকেই অপেক্ষায় থাকেন মহাস্থানগড়ের মেলা থেকে কটকটি নিয়ে আসার জন্য। বগুড়ার জামাইদের মহাস্থানগড়ের মেলা থেকে কটকটি নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার ঐতিহ্য অনেক পুরোনো।
সন্দেশ: মেলার আরেকটি পরিচিত মিষ্টি সন্দেশ। শুকনো মিষ্টি বলে অনেকেই সন্দেশকে পছন্দের প্রথমে রাখেন। সাধারণত মেলার সন্দেশ স্বাদে-গুণে খুব উন্নত মানের হয় না। অধিকাংশ সময় চিনির ঢেলা বলে মনে হয়। সন্দেশ দেবদেবীকে প্রসাদ হিসেবে দেয়া হয়। চিনির সন্দেশের পাশাপাশি শীতের সময় গুড়ের সন্দেশও দেখা যায় মেলায়। ভালো মানের সন্দেশ তৈরি করার জন্য ভালো কারিগর দরকার। আবার দুধের মানের ওপর সন্দেশের মান নির্ভর করে। দ্রুত বিক্রি করার তাগিদ থাকে বলে মেলার সন্দেশের স্বাদ ভালো করা হয় না। তারপরেও সব মেলায় সন্দেশ পাওয়া যায়। সন্দেশের স্বাদ বিচার করে বলা যায়, মেলার মিষ্টির মান কেমন আছে। ভালো মানের সন্দেশ পাওয়া যায় পাবনার বোঁথড়ের মেলায়। চাটমোহরের বোঁথড় গ্রামে চড়ক উপলক্ষে বিশাল মেলা বসে প্রতিবছর চৈত্রসংক্রান্তিতে। এ মেলায় দেশের দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসেন। পাবনার দুধের খ্যাতি সবার জানা। এখানের গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে যা কিছু তৈরি করা হয়, তারই স্বাদ অতুলনীয় হয়ে ওঠে। যেমন সন্দেশ।
জিলাপি: লোকজ মেলার সবচেয়ে পরিচিত মিষ্টির হলো জিলাপি। বাঙালিকে জিলাপির সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করানোর কিছু নেই। মেলায় গিয়ে সবাই প্রথমেই জিলাপি খোঁজেন। জিলাপি খেতে-খেতে মেলা দেখার আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার নয়। জিলাপির রসে হাত-গা মাখাননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভার। সাধারণত যে অঞ্চলে রসের মিষ্টি পাওয়া যায়, সেখানেই জিলাপির দোকান দেখা যায়। অন্যান্য রসের মিষ্টির সঙ্গে জিলাপি সমান তালে বিক্রি করা হয়। আবার শুধু জিলাপির দোকানও দেখা যায়। মেলার জেলাপির স্বাদ দোকানের জিলাপির থেকে ভিন্ন। নিজ হাতে কিনে গরম-গরম জিলাপি খাওয়ার মজাই আলাদা। একমাত্র জিলাপির ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এ মিষ্টি গরম-গরম ভেজে বিক্রি করা হয়। লোকজ মেলায় অস্থায়ী দোকানে সব সময় জিলাপি ভাজার তোড়জোড় দেখা যায়। কারিগর জিলাপি ভেজে ওঠাতে না-ওঠাতে ক্রেতার হাতে চলে যায়। জিলাপি ভাজা ও রসে ডোবানোর ফুরসতও কখনো কখনো পাওয়া যায় না। এমন কোনো মেলাফেরত দর্শনার্থীকে দেখা যায় না যিনি জিলাপি ছাড়া খালি হাতে মেলা থেকে ফিরে এসেছেন। মেলায় দুই ধরনের জিলাপি দেখা যায়। চিনির জিলাপি দেখতে কিছুটা হলদে, আর গুড়ের জিলাপির রং কালচে ধরনের। অনেকেই গুড়ের জিলাপি পছন্দ করেন। দামও গুড়ের জিলাপির বেশি। চিনির পরিমাণ বেশি থাকায় অনেকেই চিনির জিলাপি আর খেতে চান না। কোথাও কোথাও গুড়ের জিলাপির স্বাদে ভিন্নতা আনার জন্য তিল ব্যবহার করা হয়। মচমচে জিলাপির উপস্থিতি মেলার উচ্ছলতা অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। অনেককেই দেখা যায়, বাজি ধরে মেলায় জিলাপি খান। যদিও জিলাপির স্বাদ কারিগরের উপরই নির্ভর করে। বাগেরহাটের ‘খাঞ্জেলীর’ মেলায় মণকে মণ জিলাপি বিক্রি হয়। প্রতিবছর অগ্রহায়ণ মাসের ২৫ তারিখ এ মেলা বসে। তিন দিনের মেলাটি হজরত খানজাহান আলীর (র.) মাজারের পাশে এবং তাঁরই খনন করা ‘খাঞ্জেলী’ দীঘির উত্তর পাশে বসে। অনেকেই দেখা যায়, এ মেলা থেকে জিলাপি কিনে খানজাহান আলীর মাজারে দেন মনোবাসনা পূরণে।
আমৃতি: জিলাপির মতো আরেক ধরনের তেলে ভাজা মুখরোচক মিষ্টান্ন হলো আমৃতি। বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন মেলায় তা সহজেই দেখা যায়। জিলাপির যেমন আড়াই প্যাঁচ, আমৃতির অবশ্য কোনো প্যাঁচ থাকে না। জিলাপির তুলনায় আমৃতি আকার বড় ও মোটা এবং তৈরির কৌশল খানিকটা আলাদা। বরিশালের বানারীপাড়ার বেতাল গ্রামের সূর্যমণির মেলায় আমৃতি সব থেকে বেশি বিক্রি হয়। মেলাটির বয়স দু শ বছরের ওপর। ১৭৯৫ সালে এ মেলার প্রচলন হয়েছিল। প্রতিবছর মাঘ মাসের ২০ তারিখে শুরু হয় প্রাচীন মেলাটি, চলে দিন তিনেক। এখানকার লোকজন আমৃতি বলতে অজ্ঞান। দেশের সেরা আমৃতি পাওয়া যায় এ মেলায়। মণকে মণ আমৃতি বিক্রি হয় এ মেলায়। জিলাপির থেকেও আমৃতির প্রতি এখানকার মানুষদের চাহিদা বেশি। আমৃতির আকার যে কারও মন হরণ করার জন্য যথেষ্ট। প্রথম ঝলকেই যে কেউ আমৃতির প্রেমে পড়ে যাবেন। আর স্বাদ নিলে তো কথাই নেই। মেলার আমৃতির স্বাদ দোকানের থেকে অনেক গুণ বেশি- এ কথা হলফ করে বলা যাবে।
ছানার জিলাপি: জিলাপির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ আরেক ধরনের মিষ্টি হলো ছানার জিলাপি। এটি রসজাতীয় মিষ্টি। দেখতে কালচে রঙের, আকার সাধারণ জিলাপির তুলনায় অনেকটা মোটা। পিচ হিসেবে বিক্রি হয়। মেলাভেদে প্রতি পিচের দাম ৫-১০ টাকা। ছানার জিলাপির তৈরিকৌশল সাধারণ জিলাপির থেকে খানিকটা ভিন্ন। প্রথমে ছানা ভালো করে প্রস্তুত করে নেয়া হয় এবং শেষে চিনির হালকা সিরায় ডুবিয়ে রেখে তা পরিবেশন করা হয়। কালো মিষ্টির চাহিদা কারও কারও কাছে সাদা মিষ্টির তুলনায় বেশি। এদের কাছে ছানার জিলাপি চাহিদাই প্রথম। আবার কেউ কেউ অন্য মিষ্টির সঙ্গে ছানার জিলাপি চেখে দেখেন, ভিড় করেন যে দোকানে পাওয়া যায় সে দোকানে। ছানার জিলাপির ব্যবহার কবে থেকে মেলায় শুরু হয়েছে, তা দিনক্ষণ নিরূপণ করে বলা যাবে না। তবে, এ মিষ্টির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। সাধারণত এক দিনের মেলায় দোকানিরা আগে থেকে তৈরি করা ছানার জিলাপি নিয়ে যান। আর দ্ইু বা ততোধিক দিনের মেলায় কারিগরেরা রাতে ধীরে-সুস্থে ছানার জিলাপি তৈরি করেন। ঠান্ডা ছাড়া ছানার জিলাপির স্বাদ ভালোভাবে ফোটে না। কমপক্ষে এক দিন চিনির সিরায় ভিজিয়ে রাখতে হয় মিষ্টিটির যথার্থ স্বাদ পাওয়ার জন্য। জিলাপির মধ্যে সিরা যত ঢুকবে তত এর স্বাদ বৃদ্ধি পায়। রাজশাহীর ‘খেতুরী’ বা ‘প্রেমতলী’র মেলায় উৎকৃষ্ট মানের ছানার জিলাপির দেখা মেলে। প্রতিবছর আশ্বিন মাসের চতুর্থ তিথিতে ঠাকুর নরোত্তম দাসের তিরোধাম দিবস উপলক্ষে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বৈষ্ণব ভক্তরা তখন এখানে আসেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ভাবশিষ্য নরোত্তম ঠাকুর বৈষ্ণবদের কাছে পরম পূজনীয় ব্যক্তি। তাঁকে স্মরণ করে অনুষ্ঠিত এ মেলায় মিষ্টির প্রাধান্যই বেশি দেখা যায়। অনেকেই লুচি বা পুরির সঙ্গে ছানার জিলাপি খান। উত্তরবঙ্গের সেরা ময়রারা এখানে দোকান দেন। তিন দিনের এ মেলায় ছানার জিলাপির বিক্রিই শীর্ষে।
হাসিখুশি: এখন কিছু কিছু মেলায় হাসিখুশি মিষ্টি দেখা যায়। ছোট ছোট কালো-সাদা-লাল রঙের মিষ্টি হাসিখুশি, যা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের ভীষণ পছন্দ। রস বেশি থাকে না বলে বেশ কয়েকটা খাওয়া যায়। শহরের এ মিষ্টি অল্প সময়ে মেলায় দ্রুত জায়গা করে নিয়েছে। যারা মিষ্টি বিক্রি করেন তারা রসগোল্লা-চমচম-কালোজাম প্রভৃতি মিষ্টির সঙ্গে হাসিখুশি মিষ্টিও বিক্রি করেন।
বুন্দিয়া: বাংলার অতিপরিচিত মিষ্টি হলো বুন্দিয়া বা বোঁদে। একসময় দেশের সব মিষ্টির দোকানে এটি পাওয়া যেত। এখন কালেভদ্রে পুরোনো মিষ্টির দোকানে বুন্দিয়া পাওয়া যায়। চাপা মিষ্টি হওয়ায় বুন্দিয়ার জনপ্রিয়তা আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। একসময় মেলার প্রধান মিষ্টান্নই ছিল এটি। এখন কোনো কোনো মেলায় বুন্দিয়া দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে নাম নিতে হয় নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার ‘ভূতনাথের মেলা’র। এ মেলায় ভাজা জাতীয় জিনিস বেশি বিক্রি হয়। তবে, মিষ্টির মধ্যে বুন্দিয়ার বিক্রি চোখে পড়ার মতো। মেলায় আগত এখানকার লোকজন বুন্দিয়া দিয়ে পাউরুটি খান। বড় বড় গামলায় সাজানো বুন্দিয়া দেখে জিভের জল সামলানো দায়। হলুদ বুন্দিয়ার মাঝে রংবেরঙের লাল-সবুজ বুন্দিয়ায় মন ভোলে সবার। অনেকে নিমকি দিয়েও বুন্দিয়া খান।
রসগোল্লা: বাঙালির প্রধান মিষ্টি বোধ হয় রসগোল্লা। এত জনপ্রিয়তা আর কোনো মিষ্টির ভাগ্যে ঘটেনি। হেন জায়গা নেই যেখানে রসগোল্লা নেই। নামের সঙ্গে সাযুঞ্জপূর্ণ রসগোল্লার স্বাদ। ছানার এ মিষ্টি বাঙালির হৃদয় হরণ করে বহির্বিশ্বে নিজেকে পরিচয় করিয়েছে। প্রতিটি মেলায় রসগোল্লার জন্য আলাদা দোকান থাকে। মেলায় আসা দর্শনার্থীরা চেয়ার পেতে বসে নিজেদের ইচ্ছামতো রসগোল্লা খান। অনেকেই পাল্লা দিয়ে রসগোল্লা খান। পাল্লা দিয়ে রসগোল্লা খাওয়ার স্মৃতি অনেকেরই আছে। সাধারণ মান, মধ্যম আর বড় আকারের রসগোল্লা বিক্রি হয়। একসময় রাজশাহী অঞ্চলে রসগোল্লা কুটুম বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষ একধরনের মাটির হাঁড়ি ব্যবহার করা হতো, যা ‘সখের হাঁড়ি’ নামে পরিচিত। এই শখের হাঁড়ি বাংলাদেশের সমৃদ্ধ কারুশিল্প ঐতিহ্যের অন্যতম চিত্রিত মৃৎশিল্পের অনবদ্য উদাহরণ। ভালো মানের রসগোল্লা পাওয়া যায় সাতক্ষীরার গুড়পুকুরের মেলায়। প্রতিবছর ভাদ্রসংক্রান্তিতে বিশ্বকর্মার পূজার দিন এ মেলা শুরু হয়। চলে অর্ধমাসব্যাপী।
চমচম: বৈশাখ মাসে অনুষ্ঠিত চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের কানসাটের মেলায় পাওয়া যেত শিবগঞ্জের বিখ্যাত চমচম। যার স্বাদ ছিল অতুলনীয়। মেলা উপলক্ষে তবল সাহাসহ অন্যান্য ময়রা আগেভাগেই চলে যেতেন কানসাটের এ মেলায়। তবে শিবগঞ্জ বাজারে যদিও তবল সাহার মিষ্টির দোকান এখনো আছে, কিন্তু চমচমের মেলার স্বাদ সেখানে পাওয়া যায় না। একসময় এ মেলা থেকে চমচম সখের চুকাইতে (অলংকৃত শখের হাঁড়ি) নিয়ে কুটুমবাড়িতে বেড়াতে যেতেন এখানকার লোকজন। বেয়াইবাড়িতে মেলা থেকে মিষ্টি নেয়ার রেওয়াজ ছিল। সে রীতি আজ আর নেই। মিষ্টির দোকানে এখন মিষ্টি দেয়া হয় পলিথিন মুড়িয়ে কাগজের বাক্সে। কিন্তু একসময় মাটির হাঁড়িতে মিষ্টি নেয়ার প্রচলন ছিল শিবগঞ্জে। কুমাররা তাদের সৃজনস্মারক বিক্রির সুযোগ পেতেন এ মেলায়।
কালোজাম: কালো মিষ্টির প্রতি কারও কারও অনুরাগ একটু বেশি দেখা যায়। যারা কালো মিষ্টি পছন্দ করেন তাদের কাছে কালোজামের স্থান সবার শীর্ষে। এ মিষ্টি প্রথমে ভেজে পরে তা রসে ডোবানো হয়। মেলার কালোজাম খেতে খুব ভালো হয় এমনটা দাবি করা মুশকিল। তারপরেও কিছু কিছু মেলায় ভালো মানের কালোজাম পাওয়া যায়। বগুড়ার পোড়াদহের মেলায় বিভিন্ন আকার ও রঙের কালোজাম পাওয়া যায়। সব কালোজামের রঙ কালো নয়, কিছুটা বেগুনি রঙেরও হয়; ভেতরটা আবার লালচে। কী পরিমাণ কালোজাম এ মেলায় বিক্রি হয়, তার হিসাব কেউই জানাতে পারেননি। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার মহিষবাথান ইউনিয়নের ছোট যমুনাতীরে ফাল্গুন মাসের শেষ বুধবার অনুষ্ঠিত হয় এ মেলা। এটি সবার কাছে মাছের মেলা নামে পরিচিত। আবার কেউ কেউ একে জামাই মেলাও বলেন। নাম যা-ই হোক না কেন, এ মেলার প্রধান আকর্ষণ মাছ। এত বড় বড় মাছ পোড়াদহের মেলায় পাওয়া যায় যে তা একজন কিংবা দুজন মানুষ তুলতে পারে না। প্রতিবছর দু-তিন মণ ওজনের রুই-কাতল-বোয়াল-আইড়-বাগাড় জাতীয় মাছ এ মেলায় ওঠে। মাছের পাশাপাশি এখানে বিপুল পরিমাণ মিষ্টি বিক্রি হয়। রসের মিষ্টির মধ্যে রসগোল্লা-চমচম ও কালোজামের বিক্রিই বেশি হয়।
মেলায় মিষ্টি বা মিষ্টান্নের কথা বললে মোয়া, মুড়কির, নাড়ু ইত্যাদির কথা না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। গুড়ের তৈরি হাতে বানানো মুড়ির মোয়ার স্বাদ একবার যে চেখেছে, সে কখনো তা ভুলতে পারে! চিড়ার মোয়াও খেতে ভারি মজা। নারকেলের তৈরি নাড়ুও পাওয়া যায় কোনো কোনো মেলায়। নাড়ু তিন ধরনের হয়। চিনির, গুড়ের ও তিলের। এর মধ্যে চিনির নাড়ুই খেতে ভালো। এখন প্যাকেটেই নাড়ু কিনতে পাওয়া যায়। প্যাকেটের নাড়ু খেতে তেমন সুস্বাদু নয়। তিলের নাড়ু শক্ত তবে খেতে বেশ লাগে। মেলায় পাওয়া যায় গুড়ের মুড়কি, এর স্বাদও ভোলার নয়। ঢাকার ধামরাইয়ের রথের মেলায় ভালো মানের মুড়কি পাওয়া যায়।
আসলে মেলার মিষ্টান্নের কথা বলে শেষ করা যাবে না। কত মিষ্টি হারিয়ে গেছে কালের স্রোতে। আবার কত মিষ্টি যোগ হচ্ছে জনরুচির চাহিদায়, তা কে বলতে পারে! যত কথাই বলা হোক, মেলা মানেই মিষ্টি আর মেলার ইতিহাস আসলে বাংলার মিষ্টির ইতিহাস। মিষ্টি ছাড়া কোনো মেলাই পূর্ণতা পায় না। বাংলায় মিষ্টির ঐতিহ্যের হাত ধরে লোকজ মেলা বহমান।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক এবং গবেষক
ছবি: লেখক