ফিচার I দেশি ধানের হালচাল
দেশি ধানই আমাদের দেশের জলবায়ুর সঙ্গে জুতসই। বন্যা-খরা সয়েও সেগুলো টিকে থাকতে পারত। তবে হাইব্রিড ধানের উচ্চফলনশীল গুণের কাছে খুব একটা টিকতে পারেনি। সংকর ধানগুলো বাড়াচ্ছে বাড়তি ব্যয়
বাংলা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ধান। এ দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য হওয়া ছাড়াও শস্যটি যুক্ত আছে এই অঞ্চলের লোকায়ত কৃষ্টিতে। ফসলটি এই ভূখণ্ডে এনেছিল অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি-অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠী। আর্য আগমনের আগে থেকেই এখানে বসবাস করত তারা। এই ভূখণ্ড দখল করতে অস্ট্রিকরা আদিবাসী ‘নেগ্রিটো’দের তাড়িয়ে দিয়েছিল। বিতাড়িতরা কৃষিকাজ জানত না। ফলে অনুমান করা হয়, অস্ট্রিকরা চাষকৌশল সঙ্গে এনে ছড়িয়ে দিয়েছিল বাংলাসহ আশপাশের অঞ্চলে। কিন্তু সেই ৫ হাজার বছর আগে তারা যেসব ধান বুনত, সেসব জাত বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়।
প্রাচীন বাংলায় ঠিক কত প্রকার ধান ছিল, সেই সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে বিগত ১০০ বছরের একটি হিসাব মেলে। ১৯১১ সালে এই অঞ্চলে ১৮ হাজার জাতের ধানের রেকর্ড আছে বলে তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। এরপর ধীরে ধীরে কমতে থাকে ধানের জাতের সংখ্যা। ১৯৮৪ সালে আরেকটি জরিপ চালায় কৃষি মন্ত্রণালয়। দেখা যায়, সে সময় অবশিষ্ট ছিল ১২ হাজার ৪৮৭ জাতের ধান। ২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৮ হাজার জাতের ধান অবশিষ্ট আছে।
ধানের জাত বিলুপ্ত হওয়ার নানান কারণ রয়েছে। সাধারণত প্রাচীনকাল থেকেই অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন ধান চাষ করতেন চাষিরা। ফলে বেশি ফলন হয়, খরা ও বন্যা সহ্য করতে পারে, সুস্বাদু, সুগন্ধিযুক্ত, চাষে খরচ কম এবং পোকামাকড়ে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কম—এ ধরনের ধানের জাতগুলোই টিকে যায়। বাকিগুলো চাষ না হওয়ায় বিলুপ্ত হতে থাকে। তা ছাড়া দেশি অনেক ধান আছে, যেগুলোর পেছনে দেওয়া শ্রমের তুলনায় উৎপাদন কম। তাই কৃষকেরা সেগুলো চাষ করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লোকের চাহিদা, পরিবেশদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হারিয়ে গেছে অনেক ধানের জাত। গত ১০০ বছরে প্রায় ৯০০ জাতের ধানের বিলুপ্তি ঘটেছে।
দেশি ধানের অভিযোজন ক্ষমতা অনেক। নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহে ‘কুমড়ি’ জাতের ধান চাষ হতো। বন্যা হলেও শস্যটি টিকে থাকতে পারত। পানি যত বাড়ত, ধানগাছ ততই লম্বা হতো। বন্যা কমলে আবার নিজ থেকেই খাটো হতো। এরপর আবারও বেড়ে ফসল দিত। এই ধানও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মাত্র ২৪ বছর আগেও কুমড়ি ধানের চাষ হতো ওসব অঞ্চলে। শস্যটি ওই এলাকার জলবায়ুর সঙ্গে মানিয়ে গিয়েছিল। তবু বিলুপ্ত হলো। এই বিলুপ্তির কারণ হতে পারে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা। বেশি মানুষের জন্য অল্প সময়ে চাই বেশি ধানের জোগান। সে ক্ষেত্রে হাইব্রিড জাতেই ভরসা। কিন্তু এসব সংকর ধান কি দেশি ধানের মতো জলবায়ু-সহিষ্ণু? সেগুলো কি পারে বন্যা কিংবা খরায় টিকে থাকতে?
বন্যা ছাড়াও দেশি ধানগুলো টিকতে পারত লবণাক্ত পরিবেশে। তা ছাড়া ওসব ধানে ছিল ঔষধি গুণ। অসুস্থ লোকদের কালিজিরা ধান খাওয়ানোর চল ছিল। গর্ভবতীদের জন্যও রাখা হতো বিশেষ চাল। দেশি ধানের ভাতের মাড় খেয়েও দিন কাটিয়ে দিতে পারত গ্রামবাংলার মানুষ। তা পুষ্টিকর ছিল। এমনকি ভাত সংরক্ষণও ছিল সহজ। দেশি ধানের ভাত দু-তিন দিন রেখে দেওয়া যেত পান্তা করে। সেসব খেয়ে কৃষকেরা মাঠে যেতেন।
পানিসংকটে ভোগা বরেন্দ্র এলাকায় ভালো উৎপাদিত হতো জামাইভোগ, গোবিন্দভোগ, রূপকথা, মোগাইবালাম, রাঁধুনিপাগল ইত্যাদি জাতের ধান। পর্যাপ্ত সেচ না পেলেও সেগুলো বাড়ত নিজ গুণেই। দেশি জাতের ধানগুলো বেশ লম্বা হয়। এর পাতাও পুরু। ফলে এ ধরনের ধানগাছকে কেন্দ্র করে জমিতে গড়ে উঠত আলাদা ইকোসিস্টেম। ধানখেতে আশ্রয় নিত নানান প্রাণী। মাছ, ব্যাঙ, কাঁকড়া, শামুক, এমনকি পাখির আবাসস্থলও হয়ে উঠত একেকটি শস্যক্ষেত্র। জলাভূমিতে গজানো দেশি ধানগাছের গোড়ায় শেওলা জমলে তা খেতে জড়ো হতো মাছেরা। সেসব মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে পারতেন গৃহস্থেরা। পাকা ধানের খড় হতো চাষিদের গবাদির খাবার। প্রাপ্ত ভুসি খেতে পারত হাঁস ও মুরগি। ধানখেতেই মিলত সেগুলোর ডিম। তা এনে খেতে পারত পরিবারের লোকজন। মিটত পুষ্টির অভাব। জলা ধানখেতের শামুকগুলো হাঁসের পেট ভরাত। অর্থাৎ, দেশি জাতের ধানখেত নিছক একটি খেতই নয়, তা গড়ে তুলত আলাদা বাস্তুসংস্থান। কিন্তু হাইব্রিড ধানখেতে সেই পরিবেশ কি মেলে?
ভাতজাত-খাদ্য তৈরিতেও ছিল বৈচিত্র্য। চিড়ার ধান আলাদা, আবার মুড়ি তৈরির ধান ভিন্ন। কোনোটি নির্ধারিত ছিল পায়েসের জন্য, আরেকটি কেবলই পিঠা বানানোর কাজে লাগত। কিছু ধানের ভাত হতো সামান্য মিষ্টি স্বাদের। এমনকি দুধ-কলা দিয়ে খাওয়ার জন্যও চাষ হতো বিশেষ জাতের দেশি ধান।
দেশি ধানের ফলন কম হলেও এসবের ভাত অল্প খেলে তৃপ্তি মিটত। এখন একই জমিতে হাইব্রিড ধান চাষের ফলে তিন গুণ ফলন বেশি পাওয়া যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ভাতে সেই আগের স্বাদ নেই। দেশি ধানের স্থান দখল করে নিয়েছে হাইব্রিড ধান। এ ধরনের ধান চাষে অধিক সেচ দিতে হয়। কারণ, হাইব্রিড হওয়ায় এগুলোর অভিযোজন ক্ষমতা কম। বন্যা কিংবা খরায় টিকে থাকতে পারে না। অনুকূল পরিবেশে টিকিয়ে রাখতে বাইরে থেকে সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে শুধু সেচের কারণেই ধানের দাম বাড়ে ৬০ শতাংশ। এসব ধান ফলাতে বেশি পানি লাগে। এই পানির জোগান আসে ভূগর্ভ থেকে। ফলে যুগ যুগ ধরে এসব হাইব্রিড ধান চাষ করার ফলে মাটির নিচে পানির জোগান কমে আসছে। এতে অদূর ভবিষ্যতে পুরো দেশেই পানির অভাবের আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। তা ছাড়া কীটনাশক প্রয়োগের ফলে হাইব্রিড ধানের খেতে ইকোসিস্টেম তৈরি হয় না। এতে দেশি ধানখেত থেকে চাষিরা যে বাড়তি খাদ্যসুবিধা পেতেন, তা আর হচ্ছে না। এসব ধানের পাতার দৈর্ঘ্য ও পুরুত্ব হয় দেশি ধানের তুলনায় কম। এসব ধানের ভুসি গবাদি কিংবা হাঁস-মুরগিতে খেতে চায় না। ফলে মাছ ও মুরগি চাষ করতে হচ্ছে আলাদা খামারে। বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে পশুখাদ্য। এতে ব্যয় বাড়ছে। শুধু দেশি ধান চাষে মনোযোগী হলে এসব খরচ কমানো যেত। তবে দেশি ধানের চাষ করে তা দিয়ে যেন ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ভাতের চাহিদা মেটে, সেদিকেও খেয়াল রাখা চাই।
দেশি ধানের বিপরীতে ঠাঁই করে নিয়েছে ৫৬ জাতের উফশী এবং ৮-১০ জাতের হাইব্রিড ধান। এসব ধানের কারণে চাষ হচ্ছে না দেশি বান্দরজটা, উড়িচেঙড়া, লেতপাশা, ধলাকান্দি, গৌরকাজল, কলারমোচা, করচামুড়ি, কাপুড়াদীঘা, খড়াদীঘা, খৈয়ামুরগী, রাজামোড়ল, বাঘরাজ, মারচাল, কালাহোরা ইত্যাদি ধান। অবশ্য দেশের বিভিন্ন সংস্থা বিলুপ্ত ধান সংরক্ষণের প্রয়াস চালাচ্ছে। গোপালগঞ্জের একটি সংস্থা ১০০ প্রজাতির দেশি জাতের ধান সংগ্রহে রেখেছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশি জাতের গুণাবলি সংযোজন করে নতুন জাত উদ্ভাবন করছে। তা ছাড়া জলবায়ু ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ সইতে পারে এমন জাতের উচ্চফলনশীল ধান উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে।
ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট