ফিচার I পাহাড়ে বৈশাখ
বৈশাখকে স্বাগত জানানো হয় পাহাড়েও। এর নাম ‘বৈসাবি সংক্রান্তি’। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী এটি উদ্যাপন করে থাকে। অন্যান্য জনগোষ্ঠীও উৎসবের ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে বৈশাখকে বরণ করে নেয়।
খুব বেশি দিন হয়নি ‘বৈসাবি’ শব্দের প্রচলন শুরু হয়েছে। কয়েক দশক আগে চাকমাদের ‘বিজু’ নামক শব্দটির প্রকাশ ঘটেছিল মাত্র। জানা যায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এবং পরে সরকারিভাবে ‘বিজু’ শব্দটি প্রচলিত ছিল। ১৯৮৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংগঠনের সম্মিলিত উদ্যোগে ‘বৈসাবি’ শব্দের নামকরণ হয়। গঠিত হয় বৈসাবি উদ্যাপন কমিটি।
বৈসাবি সংক্রান্তির উদ্ভবকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এর শাব্দিক উৎপত্তি ব্যাখ্যাযোগ্য। চৈত্রসংক্রান্তির দিনটিকে পঞ্জিকার ভাষায় বিষুবসংক্রান্তি বলা হয়। অনেকে মনে করেন, সংস্কৃত শব্দ ‘সংক্রান্ত’ (পরিবর্তন) থেকে ‘সংক্রান্তি’ শব্দের উদ্ভব। বিষুব শব্দের অর্থ যে সময়ে দিন ও রাত্রি সমান হয়। সৌর পঞ্জিকা অনুযায়ী, সংক্রান্তি মানে মাসের শেষ দিন (চৈত্রসংক্রান্তি)। ধারণা করা হয়, একসময় ভারতীয় উপমহাদেশেও বর্ষবিদায় এবং বর্ষবরণের উৎসবকে ‘বিষুব সংক্রান্তি’ বলা হতো।
ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’ বা ‘বৈসু’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ এবং চাকমাদের ‘বিজু’ শব্দের প্রথম আদ্যাক্ষর নিয়ে ‘বৈসাবি’ গঠিত। বাংলা বছরের শেষ দুই দিন এবং নববর্ষের প্রথম দিন এই উৎসব উদ্যাপিত হয়। চাকমা জনগোষ্ঠীর কাছে উৎসবের প্রথম দিন ‘ফুল বিজু’, দ্বিতীয় দিন ‘মূল বিজু’ এবং তৃতীয় দিন ‘গোজ্যাপোজ্যা’ নামে পরিচিত। অন্যদিকে, মারমারা উৎসবের প্রথম দুই দিনের নাম দিয়েছে ‘পাইং ছোয়াই’ ও ‘সাংগ্রাইং’। তৃতীয় দিন ‘সাংগ্রাইং আপ্যাইং (তাকখীং)’। তাকখীং হলো মারমা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বৈসাবি উৎসবের নামগুলো হলো: হারি বৈসুক, বৈসুকমা ও বিসিকাতাল। নাম ভিন্ন হলেও উৎসবের রূপ অভিন্ন।
উৎসবের প্রথম দিনে পাহাড়ের ছেলেমেয়েরা খুব ভোরে উঠে ফুল সংগ্রহ করে আনে বিভিন্ন জায়গা থেকে। বাড়িঘর বিভিন্ন রকমের ফুল, পাতা দিয়ে সাজানো হয়। মূলত অতিথিকে বরণের জন্যই এই আয়োজন। পাহাড়িরা দল বেঁধে নদীতে স্নান করে। এ ছাড়া গৃহপালিত পশুপাখিদের খাবার দেয়া হয়। কিয়াঙে (বৌদ্ধবিহার) প্রদীপ প্রজ্বালন করা হয়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেমন- গান, কবিতা আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ত্রিপুরাদের ভাষায় বৈসুক মানে নবজন্ম। তাদের মতে, এই দিনে ত্রিপুরা বর্ষপঞ্জিকা প্রবর্তিত হয়। পঞ্জিকাটি সৌরবর্ষ নামে পরিচিত। এই দিনে পৃথিবীতে দেবতাদের মহাদেব গরয়ার আগমন ঘটে বলে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস। তাই তারা এই সময় গরয়ার উদ্দেশে পূজা করে। এই পূজায় বাঁশের কঞ্চি কেটে তৈরি করা হয় গরয়া দেবতার প্রতীক। তাতে জুড়ে দেয়া হয় সুতা, তুলার মালা, পৈতা ও জুমের ফসল। তারপর সেই কঞ্চি দিয়ে চলে গরয়া নৃত্য। তাতে ফুটে ওঠে পাহাড়ের জীবনচিত্র। জুম চাষ, ফসল ঘরে তোলা, ধান বোনা, পাখি তাড়ানো, পিঠা তৈরি- সবকিছুই উপস্থাপিত হয় এই নৃত্যে। এই পূজার লক্ষ্য গরয়া দেবতাকে নেচে-গেয়ে তুষ্ট করা। ত্রিপুরারা বিশ্বাস করে, গরয়া দেবতার আশীর্বাদে শান্তি বিরাজ করে।
দ্বিতীয় দিনেই আয়োজিত হয় মূল উৎসব। খুব ভোরে উঠে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর নারীরা জুম থেকে তুলা সংগ্রহ করে। চালার পানিতে ঘিলা, কাঁচা হলুদ মিশিয়ে তৈরি করা হয় কোঁচা পানি। তারপর ঘরে ছিটানো হয়। এদিনে সবাই নতুন জামাকাপড় পরে। আয়োজন করা হয় ঐতিহ্যবাহী খেলা, যেমন- ডাংগুলি, গুদু ইত্যাদি। হরেক রকমের সবজির মিশ্রণে রান্না হয় পাজন বা পাজোন। পাজন শব্দটি মূলত চাকমা নৃগোষ্ঠীর। ৩০-৩২ রকমের ভিন্ন সবজি দিয়ে পাজন রান্নার চেষ্টা চলে। এই দিনে কমপক্ষে সাত বাড়িতে খাওয়ার প্রচলন আছে। চাকমাদের বিশ্বাস, এতে পারস্পরিক বন্ধন দৃঢ় হয়।
ত্রিপুরাদের কাছে এটি পাচন নামে পরিচিত। একসময় তারা ১০৮ রকম সবজি দিয়ে খাবারটি রান্না করত। সবজির এই মিশ্রণকে ঔষধি মনে করে তারা। যদিও এখন সব ধরনের সবজি সংগ্রহ করা কঠিন। তাই হাতের নাগালে যা পাওয়া যায়, সেগুলো নিয়েই রান্না হয় পাচন। এ ছাড়া খাদ্যের তালিকায় পায়েস, পিঠা, সেমাই ইত্যাদিও থাকে। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তৈরি হয় মদ। চাকমা ভাষায় মদকে দো চোয়ানি, এক চোয়ানি, জগরা বলা হয়।
পাচন মারমাদের কাছে হাঙর নামে পরিচিত। ধরন একই। বয়োজ্যেষ্ঠদের স্নান করানো হয়। ফুল তুলে কিয়াঙে (বৌদ্ধমন্দির) পূজা দেয়া হয়। চন্দনমিশ্রিত জলে বুদ্ধকে তারা স্নান করায়। এই উৎসবে জলকেলি মারমা ঐতিহ্যের অংশ। তারা একে বলে রিলং বোয়ে। যাকে বাংলা ভাষায় মৈত্রীপানি বর্ষণ বলা হয়। এই খেলায় দুই পাশের এক সারিতে থাকে মেয়ে, অন্য সারিতে ছেলে। মাঝখানে থাকে নৌকা। তরুণ-তরুণীরা যে পানি পরস্পরকে ছিটিয়ে দেয়, সেটি নৌকায় জমা হয়ে যায়। তারা বিশ্বাস করে, এই জমে থাকা পানির সঙ্গে সব ধরনের কলুষতা দূর হয়ে যায়। উল্লাসময় এই দিনে জড়ো হয় ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষ। মজার ব্যাপার হলো, অনেক সময় দেখা যায় এই জলকেলির মধ্য দিয়ে তরুণ-তরুণীরা নিজেদের জীবনসঙ্গীও বেছে নেয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী বাংলা বর্ষপঞ্জিকার বৈশাখ মাসের প্রথম যে দিনটিতে উচ্ছ্বাসে মেতে থাকে, সেটি উৎসবের তৃতীয় দিন। এটি হলো বর্ষবরণের দিন। এই উপলক্ষে আয়োজিত হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, র্যালি, বইমেলা। পট্টি, ঘিলে, গুদু, বলি, ধিনুক, পিচ্ছিল কলাগাছ বেয়ে ওঠা, রশি টানা নামের ঐতিহ্যবাহী খেলার প্রতিযোগিতা হয়। আদিবাসীরা নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে রেং (আনন্দধ্বনি) দিয়ে র্যালিতে অংশ নেয়। এই দিনে বয়োজ্যেষ্ঠদের স্নান করানোর পর প্রণাম জানানো হয়। উপহার দেয়া হয় নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ। ত্রিপুরা বয়োজ্যেষ্ঠরা চাল, তুলা দিয়ে আশীর্বাদ জানান। তাঁরা তুলাকে দীর্ঘায়ুর প্রতীক মনে করে। চাল হলো শান্তির প্রতীক। এদিনে তারা নিজস্ব ঐতিহ্যের পোশাক পরে। চাকমা নারীরা কোমর তাঁতে বোনা পিনোন-খাদি এবং পুরুষেরা ধুতি ও ফতুয়া, খবং (পাগড়ি) পরে। মারমা নারীর সেদিনের পরিধেয় তবুইন নামক একধরনের সুতি বা রেশমি বস্ত্র। পুরুষেরা তাঁতে বোনা একধরনের কাপড় পরে থাকে, যার নাম ধুয়ক। এর সঙ্গে পুরুষদের পোশাক হিসেবে যুক্ত থাকে রাঁজি নামক এক প্রকার খাটো জ্যাকেট (গলায় বোতাম থাকে)। আর পাগড়ি। মারমারা পাগড়িকে গংবং বলে। ত্রিপুরা পুরুষেরাও ধুতি, ফতুয়া, পাগড়ি পরে। তাদের মাথার পাগড়ি বিভিন্ন নামে (রীসা, পরতা, আতার) পরিচিত। নারীরা কোমর তাঁতে বোনা রিনাই (নিচের অংশ) এবং রিসাই বা রিয়া (বক্ষস্থলে) পরে। রিনাইয়ের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য নাম হলো রিনাই চাংগ্রই, রিনাই কেখফ, রিনাই পেশক ইত্যাদি। ত্রিপুরা নারীরা অলংকার হিসেবে বেছে নেয় নাকফুল, বাংগ্রি, বং বাতাং, তয়া, সুরাম সাংগো ইত্যাদি। এসব অলংকার রুপা দিয়ে তৈরি হয়। তবে, সব নারীর কাছে প্রিয় অলংকার হিসেবে প্রাধান্য পায় রুপার পয়সার মালা। ত্রিপুরারা একে টঙ্কহার বলে। এই দিনে চাকমা, মারমা নারী-পুরুষ বিহারে গিয়ে বৌদ্ধভিক্ষুদের জন্য সিয়োং (ভিক্ষুদের খাবার) দান করে। এদিন বিশ্বে শান্তির প্রত্যাশায় দানকার্যাদি সম্পাদন হয়। ত্রিপুরারাও সবার মঙ্গল কামনায় দিনশেষে নদীতে প্রদীপ প্রজ্বালন করে।
উৎসবের এই তিন দিন চেনা-অচেনা সবার জন্য প্রত্যেকের গৃহ উন্মুক্ত থাকে। সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে আপ্যায়ন করা হয়। সব মিলিয়ে বৈসাবি পাহাড়ি জনপদের মিলনোৎসব। এতে পুরোনো বছরকে বিদায় জানানো এবং নতুন বছরকে বরণের যেসব আয়োজন চলে, তা শেষ পর্যন্ত মানব ঐক্যের বার্তাই বহন করে।
রেন্টিনা চাকমা
ছবি: কমল দাশ