ফিচার I বিশ্বায়নে দেশীয় ফ্যাশন
নিজের সাংস্কৃতিক পরিচয় অক্ষুণ্ন রেখে আমরাও তাল মেলাতে পারি সবার সঙ্গে। পৃথিবী সে পথেই চলছে। ফ্যাশনও। লিখেছেন ফারজানা ইউসুফ
অবাধ বিশ্বায়ন, প্রযুক্তির সহজলভ্যতা, গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে গোটা পৃথিবী প্রবেশ করেছে নতুন এক যুগে। বেশ আগেই তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষকে সর্বশেষ বার্তার সঙ্গে যুক্ত করেছে। মুছে যাচ্ছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সীমারেখা। দিনে দিনে কমে আসছে সামাজিক রীতিনীতির গন্ডি এবং জীবনযাপনের ধরন-ধারণের পার্থক্য।
অন্য সব ইন্ডাস্ট্রির মতো ফ্যাশন জগৎও এর বাইরে নয়। এই এক যুগের সামান্য আগেও ইউরোপীয় ফ্যাশনের নিত্যনতুন খবরের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। প্যারিস, লন্ডন, মিলান ও নিউইয়র্কের মতো ফ্যাশন ক্যাপিটালের হালহকিকত জানার জন্য বিদেশি ফ্যাশন পত্রিকা আর টেলিভিশন ছাড়া তেমন কোনো উৎসই ছিল না। আজ মুহূর্তেই আমরা পেয়ে যাচ্ছি পৃথিবীর অপর প্রান্তের সর্বশেষ ফ্যাশন বার্তা; নিজের মুঠোফোনের মাধ্যমে, যেখানেই থাকি না কেন।
বিশ্বায়নের প্রভাব পড়েছে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। আমাদের খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-আশাক, রীতিনীতি, আচার-আচরণ, ভাষা, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকান্ড- সবকিছুই আজ ভুবনায়ন প্রভাবিত। তবে এটি একদিকে যেমন খুলে দিয়েছে অবারিত সম্ভাবনার দুয়ার, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় এতে যে হুমকির সম্মুখীন, সেই অভিযোগ উঠছে।
বর্তমানে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে ক্রস কালচারাল রেফারেন্সিং বা আন্তসাংস্কৃতিক বিষয়গুলোর উল্লেখ আর অবাধ ব্যবহার ক্রমশ সহজাত হয়ে উঠেছে। ইউরোপীয় ফ্যাশন ডিজাইনাররা হরদম নিজেদের ক্যাটওয়াক শোগুলোতে তুলে ধরছেন পৃথিবীর অন্য প্রান্তের সংস্কৃতি, কারুশিল্প, এমনকি পুরোনো এবং হারিয়ে যাওয়া শিল্পের অনুপ্রেরণায় তৈরি করছেন তাদের পোশাক। ক্রিস্তিয়ঁ দিওরের সাবেক ডিজাইনার জন গালিয়ানো অথবা প্রয়াত আলেক্সান্ডার ম্যাককুইনের মতো জাঁদরেল ফ্যাশন ডিজাইনারদের কাজে বারবার উঠে এসেছে ঐতিহাসিক চিত্রকলা, বিচিত্র আর চমকপ্রদ ভিনদেশি রীতির পোশাক-আশাক ও অলংকরণ। তাদের এই অনুপ্রেরণার প্রতিফলন প্রায়শই সারা বিশ্বকে মুগ্ধ করছে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন, নতুনের সঙ্গে পুরোনোর এই অনাবিল সহাবস্থান সবাই গ্রহণ করেছে। কিছু কট্টরপন্থী সমালোচক বিপক্ষে কথা বললেও কল্পনা আর সৃষ্টিশীল জগৎকে ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক গন্ডিতে কি বেঁধে রাখা সম্ভব? সংগীত, নৃত্যকলা, রন্ধনশিল্প- জীবনযাত্রার সব ক্ষেত্রেই ক্রস কালচারাল এলিমেন্টস ব্যবহৃত হচ্ছে অবাধে।
শিল্প-সংস্কৃতির বিনিময় এবং মিশ্রণ কোনো নতুন ঘটনা নয়। যুগে যুগে এক দেশের মানুষ অন্য দেশে পাড়ি জমিয়েছে জীবিকার সন্ধানে। সতেরো ও আঠারো শতকে ইউরোপীয় নানা জাতি সমগ্র পৃথিবীতে উপনিবেশ স্থাপন করে। ফলে পণ্যসামগ্রীর লেনদেন ছাড়াও বিনিময় হয়েছে রীতিনীতি, ভোগ্য ও ভোজ্যপণ্য, ভাষা, স্থাপত্য কলাসহ দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি উপাদান। ঔপনিবেশিকতার সমাপ্তি ঘটলেও এখন আমরা সমান্তরালভাবে গোটা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছি। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, তথ্যের অবাধ বিচরণ, মুঠোফোনে সামাজিক মেলবন্ধনের কারণে আমাদের মাঝের ভৌগোলিক দূরত্ব এখন প্রায় অদৃশ্য। আমরা সবাই এখন পরস্পরের অনেক বেশি কাছাকাছি।
বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিও এই ধারার বাইরে নয়। প্রতিবেশী দেশগুলোর টেক্সটাইল, মোটিফ, সিল্যুয়েট- সবকিছুই আমাদের দেশীয় ফ্যাশনকে প্রভাবিত করছে। তবে এটা সুখকর যে, এখনো আমাদের দেশীয় মোটিফ, শিল্পরীতি আর উপমহাদেশীয় কারুশিল্প হারিয়ে যায়নি, বরং নতুন নতুন মাত্রায় হাজির হয়ে চলেছে। যদিও দ্রুত পরিবর্তনশীল শহুরে জীবনে পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক-আশাক ধীরে ধীরে সবার ওয়্যারড্রোবে স্থায়ীভাবে স্থান করে নিচ্ছে। তথ্যের অবারিত দুয়ার আমাদের সৃষ্টিশীলতাকে দ্রুত প্রভাবিত করছে। সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাই আমরাও হয়ে উঠছি গ্লোবাল। গ্লোবালাইজেশনের এই জোয়ারকে প্রতিহত না করে নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় যথাযথভাবে অক্ষুণ্ন রাখতে পারি। সবার সঙ্গে আমরাও পরিবর্তন আর প্রবৃদ্ধিকে আলিঙ্গন করে দেশকে আরও সমৃদ্ধিশালী করে তুলতে পারি।
লেখক: ডিজাইনার, আরশী ডিজাইন স্টুডিও
ছবি: ইন্টারনেট