skip to Main Content

ফিচার I সভ্যতার সোপানে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য

আজকের সভ্যতায় পৌঁছাতে প্রক্রিয়াজাত খাবারের ভূমিকা অনেক। অন্যথায় মানুষ হয়তো এখনো বন্যই থেকে যেত! গাছের শিকড় থেঁতলে খাওয়া থেকে শুরু খাদ্যপ্রক্রিয়ার। তারপর টিন-ক্যান ও হিমায়িত খাবার হয়ে এখন মানুষ আবারও প্রকৃতিমুখী হচ্ছে

প্রকৃতি থেকে পাওয়া খাবারকে নিজেদের সুবিধামতো কাটছাঁট ও সংরক্ষণ করে নেয় মানুষ। সেগুলোই প্রক্রিয়াজাত খাবার। চিপস, সসেজ, কেক—দৈনন্দিন জীবন এখন অনেকটাই প্রক্রিয়াজাত খাবারের ওপর নির্ভরশীল। খাদ্যের এই বিবর্তন কোনো মামুলি বিষয় নয়। সেটি সরাসরি প্রভাব ফেলেছে সভ্যতা বিনির্মাণে। এমনকি কিছু যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায়, খাবার প্রক্রিয়াজাত করা না হলে মানুষ এই প্রাণিজগতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান জীব হয়ে উঠতে পারত না। আজও তাদের বসবাস হতো বনে। একদম আদিকাল থেকে ব্যাখ্যা করলে বিষয়টি বোঝা সহজ হবে।
মানুষের প্রথম প্রক্রিয়াজাত খাবার মাছ। লুইস হেনরি মরগান তার ‘অ্যানশিয়েন্ট সোসাইটি’ বইতে এমনটাই লিখেছেন। আদিম মানুষ মাছ ঝলসে খেতে শুরু করে। মাছের খোঁজেই তারা নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে বিশ্বের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে বলে একটি ধারণা প্রচলিত আছে। আদিম মানুষের খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের আরেকটি নমুনা হলো গাছের শিকড় ভক্ষণ। শক্ত মূলগুলো খাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। ফলে তা কিছুটা থেঁতলে নিয়ে খাওয়া শুরু করেছিল মানুষ। সেটিও প্রথম প্রক্রিয়াজাত খাবারের উদাহরণ হতে পারে। আরেকটি উদাহরণ হলো, প্রাণীর বড় বড় মাংসের টুকরাকে ছোট করে কেটে খাওয়া। শিকড় থেঁতলে নেওয়া কিংবা মাংস ছোট করে কাটার রেওয়াজ চালু হয়েছিল ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন বছর আগে। তারা আমাদের মতো হোমো স্যাপিয়েন্স নয়। বিজ্ঞানীরা তাদের নাম দিয়েছেন হোমো হাবিলিস। তারাই শুরু করেছিল খাবার প্রক্রিয়াজাতকরণ। ফলে এই পদ্ধতিকে ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন বছর আগের বলা যেতে পারে। কিন্তু এই তত্ত্বের ভিত্তি কী?
হাবিলিসদের আগে পৃথিবীতে যেসব মানুষের বিচরণ ছিল, তাদের দাঁতের আকার ছিল বড়। কিন্তু কালক্রমে তা ছোট হতে থাকে এবং হাবিলিসদের সময়ে এসে তা উল্লেখযোগ্য ছোট হয়ে যায়। দাঁত ছোট হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করা যায় শুধু একটি ধারণা দিয়ে। তা হলো, খাবার মুখগহ্বরে যাওয়ার আগেই তাতে কোনো পরিবর্তন আনা হলে সেই খাবার বেশি সময় ধরে চিবানো লাগে না। ফলে দাঁতের কাজ কমে। কাজ কমলেই দাঁতের আকার কমবে। ঠিক এই ধারণা থেকেই বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন, প্রক্রিয়াজাত খাবারের উদ্ভব মূলত ওই হাবিলিসদের সময়েই।
ধারণা করা হয়, প্রক্রিয়াজাত করার কারণে খাদ্য চিবিয়ে খাওয়ার প্রবণতা প্রায় ৫ শতাংশ কমে যায়। ফলে গাল, চোয়াল ও হজমে যেই শক্তির প্রয়োজন হতো, তা সঞ্চিত হতে থাকে শরীরে। বেঁচে যাওয়া এনার্জি কাজে লাগে মস্তিষ্ক গঠনে। মগজ বড় হয়। ফলে মানুষ বুদ্ধিমান হতে শুরু করে। হাবিলিসদের মাথার খুলির তুলনায় চোয়াল ছিল ছোট। এ থেকেও ধারণা করা যেতে পারে, খাবারের প্রক্রিয়াজাতকরণ শুরু হয়েছিল তাদের সময়কাল থেকেই।
খাবার প্রক্রিয়াজাত করার জোয়ার শুরু হয় রান্না আবিষ্কারের মাধ্যমে। মগজের আকৃতি বেড়ে বুদ্ধিমান হয়ে ওঠার কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা রান্নার আবিষ্কারকেই গণ্য করেন। সেটি হয়েছিল হোমো ইরেকটাসদের সময়ে। এ বিষয়ে ইসরায়েলি ইতিহাসবেত্তা ইউভাল নোহা হারারি তার ‘সেপিয়েন্স’ বইতে চমৎকার কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছেন। গরিলা, শিম্পাঞ্জি ও মানুষ একই গোত্রের হওয়ার পরও মানুষ বুদ্ধিসুদ্ধিতে এগিয়ে গেছে। গরিলা ও শিম্পাঞ্জি রয়ে গেছে বন্যই। কারণ, মানুষ খাবার প্রক্রিয়া তথা রান্না করতে পারে। কাঁচা খাবার খেয়ে হজমযোগ্য করতে তা ১০ ঘণ্টা চিবোয় গরিলা। শিম্পাঞ্জি চিবোয় পাঁচ ঘণ্টা। ফলে চিবানো ও হজমে অনেক শক্তি ব্যয় হয়। এতে গরিলা ও শিম্পাঞ্জি মস্তিষ্ক গঠনে প্রয়োজনীয় শক্তি পায় না। কিন্তু হোমো ইরেকটাসরা রান্না তথা আগুনে ঝলসে নরম হওয়া খাবার প্রক্রিয়াজাত করে খাওয়ার বদৌলতে তা চিবোতে সময় লাগে কম, শক্তিও ব্যয় হয় সামান্য। এমনকি আঁশজাতীয় খাবার হজম করাও সহজ হয়ে গিয়েছিল তাদের কাছে। ফলে উদ্বৃত্ত শক্তি কাজে লাগল মানুষের মগজ গঠনে। তারা হয়ে উঠল বুদ্ধিমান। এগিয়ে যেতে লাগল সভ্যতার দিকে। তা ছাড়া রান্না তথা প্রক্রিয়া করতে শেখার কারণে মানুষের খাদ্যভান্ডারে যোগ হতে থাকে নতুন নতুন খাবার। প্রকৃতিতে এমন অনেক ফসল ছিল, যা কাঁচা খেয়ে হজম করা কঠিন। তবে প্রক্রিয়াজাত করে তা অনায়াসে হজম করা যায়। তেমনই একটি শস্য হলো গম।
সভ্যতার আরেকটি উপাদান হলো ভাষা। হাবিলিস, ইরেকটাস ও নিয়ানডারথালরা খাবার প্রক্রিয়াজাত করে খাওয়ার কারণে তাদের মুখগহ্বর হয় নমনীয়। এই সুযোগে তারা নানা ধরনের বাড়তি শব্দ করতে থাকে মুখ দিয়ে, যা পরে ভাষার জন্ম দেয় বলে ধারণা করা হয়।
এখনকার সাধারণ লোকেরা প্রক্রিয়াজাত খাবার বলতে মূলত ক্যান কিংবা হিমায়িত খাবারকেই বোঝে। ক্যানে খাদ্য সংরক্ষণ শুরু হয়েছিল সম্ভবত নেপোলিয়নের সময়ে। তার সৈন্যরা যুদ্ধের চেয়ে অপুষ্টিতেই বেশি মরতে শুরু করায় বিকল্প খাবারের খোঁজে সে সময় ক্যানের খাবারের প্রচলন ঘটে বলে অনুমান করা হয়। এ ধরনের খাবার সংরক্ষণের বিপ্লব ঘটে ১৯১২ সালে। সে সময় যুক্তরাজ্যে গৃহপরিচারিকাদের সুবিধার্থে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। তাতে তাদের জন্য সপ্তাহে অন্তত অর্ধবেলা ছুটি ধার্য করা হয়। এতে ওই এক দিন রান্নার দায়িত্ব বর্তায় গৃহিণীদের ওপর। তারা নিজের কাজকে সহজ করতে তৈরি খাবারের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে বাজারে প্রক্রিয়াজাত খাবারের চাহিদা বাড়ে। বৃদ্ধি পায় টিনের ক্যানে সংরক্ষিত খাদ্যের কদরও। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে টিনের বাজারে ধস নামে। এবার মানুষ ঝোঁকে হিমায়িত খাবারের দিকে। ১৯৮০ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের এক কৃষকের হাত ধরে সংরক্ষিত খাবারের বিপ্লব সাধিত হয়। সংরক্ষণের অভাবে বছরে তার ফলানো ৩৬০ টন গাজর অপচয় হতে থাকে। প্রতিবছর এই লোকসানের কবল থেকে নিস্তার পেতে তিনি প্রতিটি গাজর দুই ইঞ্চি মাপে কেটে সংরক্ষণ ও বাজারজাত শুরু করেন। বিষয়টি তখন এতই জনপ্রিয় হয়, সে দেশে গাজর খাওয়া বাড়ে ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত। ইতিহাসবেত্তারা এটিকে ক্ষুদ্র গাজর বিপ্লব বলে অভিহিত করেছেন।
সব প্রক্রিয়াজাত খাবারই যে মানুষের সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের ফল, তা কিন্তু নয়। যেমন দুধ থেকে মানুষ খুব আকস্মিকভাবেই পনির লাভ করেছিল। প্রায় দশ হাজার বছর আগে এর উদ্ভব। দুধ রাখার জন্য প্রাণীর পাকস্থলী দিয়ে ব্যাগ তৈরি করেছিল মানুষ। কিন্তু সেই থলের গাত্র থেকে রেনেট নামের এক প্রকার এনজাইম বেরিয়ে দুধ কেটে ফেলে। ফলে পনিরের উৎপত্তি হয়।
যাহোক, মানবসভ্যতা বিনির্মাণে অন্যতম বড় প্রভাবক হিসেবে প্রক্রিয়াজাত খাবারকে ধরা চলে। আজকাল এ ধরনের খাবারের বাজার বেশ তুঙ্গে। মূলত ব্যস্ততা বাড়ার কারণে খাবার রান্নার পেছনে মানুষ পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছে না। তাই প্রক্রিয়াজাত খাবারেই ভর করতে হচ্ছে তাদের। কিন্তু এ ধরনের খাদ্য স্বাস্থ্যের জন্য খুব একটা উপযোগী না হওয়ায় মানুষ আবারও প্রাকৃতিক খাদ্যমুখী হচ্ছে।

i আহমেদ সজিব
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top