skip to Main Content

ফিচার I লোকগানে তাঁতশিল্পের বয়ান

বাংলার বিভিন্ন জনপদে প্রচলিত লোকগানে তাঁতশিল্পের আর্থসামাজিক ইতিহাস লুকিয়ে আছে। লিখেছেন অনার্য তাপস

প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক জীবনে তাঁতশিল্পের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। আঠারো শতকের প্রথম দিকে দিল্লির নবাবদের দরবারে পাঠানো মসলিনের হিসাব কিংবা ১৭৪৭ সালে জন টেলরের দেওয়া ঢাকাই মসলিন বাণিজ্যের হিসাব থেকে বোঝা যায়, সে সময় অর্থনীতিতে এই শিল্পের অবদান কেমন ছিল। টেরাকোটা, ভাস্কর্য, লোকসংগীত ইত্যাদিতেও এটি যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। ময়নামতি কিংবা পাহাড়পুরে পাওয়া টেরাকোটায়, বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামসহ বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত প্রাচীন ভাস্কর্যশিল্পে নকশাদার তাঁতবস্ত্রের উপস্থিতি দেখা যায়। চর্যাপদের একাধিক চর্যাসহ প্রচলিত বিভিন্ন লোকসংগীতে তাঁতবস্ত্রের গুণগান তো বটেই, এর বিভিন্ন অনুষঙ্গের কথা এবং তাঁতি সম্প্রদায়ের উল্লেখ আমাদের বুঝিয়ে দেয়, তাঁতশিল্প কতটা তাৎপর্যময় ভূমিকা রেখেছে প্রাচীনকাল থেকে, আমাদের জীবনে। বিষয় হিসেবে তাঁত ও তাঁতি সমাজ লোকসংগীতকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে।
কোনো অঞ্চলের জীবনধারার মৌলিক বৈশিষ্ট্য বুঝতে সেখানকার লোকসংগীত বেশ সাহায্য করে। খাদ্য, পেশা, সংস্কার, রীতি, মানবসম্পর্কের রূপ, লোকায়ত ভাবনা ইত্যাদি ধরা থাকে এর ছত্রে ছত্রে। ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, ধুয়া গান, বিয়েবাড়ির গান প্রভৃতি বিশ্লেষণ করলে এই বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এসব লোকগানে তাঁতশিল্প ও তাঁতি সম্প্রদায়ের সমাজ-নৃতাত্ত্বিক পরিচয় যেমন পাওয়া যায়, তেমনি তাঁত বা তাঁতসংশ্লিষ্ট কাহিনি, চিন্তা, সাধনার বিভিন্ন রূপকের সন্ধান মেলে। তাঁতশিল্পে তন্তু বা সুতা, তাঁতযন্ত্র, তাঁতি সম্প্রদায় এবং বস্ত্র- এই চারটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এসবই লোকসংগীতে এসেছে।
লালন ফকিরের সমসাময়িক সাহেবধনী সম্প্রদায়ের সাধক, পদরচয়িতা কুবের সরকার তথা কুবির গোঁসাই (১৭৮৭-১৮৭৯) তাঁর গানে তাঁত ও তাঁতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। চর্যাপদের সিদ্ধাচার্যদের মতো রূপকার্থে তাঁতে বস্ত্রবয়নের বিভিন্ন পর্যায়ের কথা এসেছে।
যখন সুতা করব মাতি।
প্রথমে বিশকরম বলে চালিয়ে মাকু
আঁকু বাঁকু করব না ভুলে তায়
ঝাপ তুলে ঘা দিব নাটা।
তবে ঝাপ ঝোপে বুনব কাপড় দিয়ে ও
সাবির কাটা।।
কলে বলে নলি চালাব।
ছিঁড়বে না খেঁই খাব সে দেই
সাঁদ মেরে যাব
খুব দেখাব আমার গুণ যেটা।
কাপড় বুনব কিসে নরাজ ঘিসে
রাখব না দশি কাটা।।
ভাল কাপড় বুনতে জানি।
চিরুন কোটা শালের বোটা ঢাকাই
জামদানি তার ঢের কানি তা বুঝে
দেয় কেটা।।
কুবির চরণ ভেবে বলে
এবার এ দফাতে নাই ঘোটা।।

কুবির বলছেন, একজন তাঁতি যেভাবে সাবধানে নাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সুতা জড়ায়, একজন সাধকও সেই রকম সাধনার সঙ্গে, একাগ্রচিত্তে তার ইষ্টের প্রতি সমর্পিত হবেন। এই সাধনায় যদি বিঘ্ন ঘটে, মগ্নতায় ফাটল দেখা দেয় তাহলে আবার তাকে ‘জুড়ে’ নিতে হবে ঠিক যেভাবে সুতা ছিঁড়ে গেলে জোড়া দেওয়া হয়। সুতা এলোমেলো হলেও অর্থাৎ একাগ্রতা নষ্ট হলেও কোনো সমস্যা নেই। পুনরায় মনঃসংযোগ করতে হবে। এই গানেরই একপর্যায়ে তিনি তাঁতিদের রিচুয়ালের কথাও বলছেন, ‘প্রথমে বিশকরম বলে চালিয়ে মাকু/ আঁকু বাঁকু করব না ভুলে তায়/ ঝাপ তুলে ঘা দিব নাটা’। উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিশকরম হচ্ছে ‘বিশ্বকর্মা’। হিন্দু তাঁতি সম্প্রদায়ের দেবতা। অবশ্য এই বিশকরম বা বিশ্বকর্মার নাম নিয়ে জামদানি কারিগররাও (বর্তমানে এরা মূলত মুসলমান) কাজ শুরু করতেন একসময়। যা হোক, বিশ্বকর্মার নাম নিয়ে তাঁতিরা তাঁতের কাজ শুরু করেন। এটা তাদের রিচুয়াল।

কুবির গোঁসাইয়ের আরেকটি গানে তাঁতি সমাজের পেশা পরিবর্তন, দুঃখ-দুর্দশার কথা উঠে এসেছে।

ভারি সুতোর বাজার আক্কারা
হয়েছে যুগী তাঁতী পুলিশ-সৈন্য
শিখেছে কেয়াজ করা।
এখন কাপড় বোনায় লভ্য নাইক
উল্টো দেনায় হয় সারা
কাপাস তুলো নেইক দেশে
কেশের ফুলকোয় মাঠ ভরা
তাতে হয় না সুতো অনাহত ভাবছে যত চাষীরা
এখন দায়ে পড়ে পৈতে ছিঁড়ে দস্তী হবে দ্বিজরা
এখন মাকু বেছে কাঁকু চুষে বেড়ায় যত জোলারা
কলার পেটোর কপিড়ব পড়বে যত বাউল নেড়ারা

কুবির বলছেন, বাজারে সুতার অভাব। আর সে কারণে তাঁতিরা তাদের পেশা পরিবর্তন করে হয়ে গেছে পুলিশ, সৈন্য। কাপড় বোনায় লাভ নেই আর। বরং এই কাজ করতে গিয়ে তাঁতিরা দেনার দায়ে জর্জরিত হচ্ছে। কার্পাস তুলা নেই এখন। ‘কেশের ফুলকোয়’ মাঠ ভরে গেছে যা দিয়ে সুতা হয় না। এর ফলে মাকু বিক্রি করে দিয়েছে জোলা, মানে মুসলমান তাঁতিরা। তাঁতিরা কাজ ছেড়ে দিয়েছে বা দিচ্ছে, তাই কলার পেটোর কাপড় ব্যবহার করতে হবে বাউলদের।

কুবির গোঁসাইয়ের মতো লালন সাঁইও তাঁতের বিভিন্ন অনুষঙ্গকে তাঁর গানে ব্যবহার করেছেন।

আমার চরকা ভাঙা টেকো আড়ানে।
আমি টিপে সোজা করব কত
আর তো প্রাণে বাঁচিনে।।
একটি আঁটি আরকটি খসে
বেতো চরকা লয়ে যাব কোন দেশে
আর কতকাল জ্বলবো এ হালে
এ বেতো চরকার গুণে।।
সামান্য কাঠ পাটের চরকা নয়
তার খসলে খুঁট খেটে আঁটা যায়
মানবদেহ চরকা সে তো
লালন কি তার ভেদ জানে

লালন বলছেন, তিনি ভাঙা চরকা নিয়ে কী করবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না। চরকার একদিকে ঠিক করলে অন্যদিক ভেঙে যায়। এই চরকা নিয়ে আর কতকাল জ্বলবেন, কোন দেশে যাবেন সেটা ভেবে তিনি অস্থির। চরকাকে তিনি দেহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কাঠের চরকার কোন ‘খুট’ খুলে গেলে সেটা পরিশ্রম করে সংযুক্ত করা যায়। কিন্তু মানবদেহ সে চরকা নয়। কুবির গোঁসাই বা লালন ফকিরের গানে তাঁতের বিভিন্ন অনুষঙ্গ রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে মাহিন শাহর গান অন্য কথা বলছে। মাহিন শাহ তাঁতকে কেন্দ্র করে কিছুটা হালকা চালে তাঁতি সম্প্রদায়ের সমৃদ্ধির কথা বলেছেন তার গানে।

এত রাইতে শুইনা যা লো
চরকার গুনগুনি
বরিশাইল্যা চরকা আমার
চরকা আমার হিয়া-
চরকার দৌলতে আমার
সাত সাতখান বিয়া লো সজনী
এত রাইতে শুইনা যা লো
চরকার গুনগুনি
চরকা আমার ছেলে মেয়ে
চরকা নাতি পুতি
চরকার দৌলতে আমার
দরজায় বান্ধা হাতি লো সজনী
এত রাইতে শুইনা যা লো
চরকার গুনগুনি

মাহিন শাহ বলছেন, চরকার জন্য তাঁতির সাতটি বিয়ে। অর্থাৎ, চরকায় সুতা কেটে, কাপড় বুনে তা বিক্রি করে তাঁতি বেশ ধনশালী হয়ে উঠেছে। যে কারণে তাঁতি সাতটি (একাধিক বোঝাতে) বিয়ে করেছে। এই সমৃদ্ধির পথে চরকা যে তাঁতির ‘সবকিছু’ হয়ে উঠবে, তাতে আর সন্দেহ কী? মাহিন শাহ, রাতের বেলা চরকার ‘গুনগুনানি’র কথা বলেছেন। সাধারণত চরকায় সুতা কাটা হয় দিনের বেলায়। রাতে চরকায় সুতা কাটা তাঁতিদের- পরিশ্রমের জানান দেয়। ধনশালী হওয়ার জন্য তাঁতিদের দিন-রাত পরিশ্রম করতে হয়।

শুধু কুবির গোঁসাই, লালন ফকির বা মাহিন শাহর গানেই নয়, আরও অনেক পদকর্তা বা বিখ্যাত লোককবির গানেও তাঁতের কথা পাওয়া যায়। এবার কিছু প্রচলিত গান-

নাচনি কাঠি নাচন করে
মাকুয় করে চলাচল
গেদিটা বাইচা গেল
আইল রে কারেন্টের কল।
এটি সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে প্রচলিত ধুয়া গান। এই গানে ‘কারেন্টের কল’ অর্থাৎ পাওয়ার লুমের কথা এসেছে। খটখটি গর্ত তাঁতে কাপড় বোনা শ্রমসাপেক্ষ। অন্যদিকে পাওয়ার লুমে কাপড় বুনতে খুব একটা শারীরিক পরিশ্রম হয় না। তাঁতি পরিবারগুলোর নারীরা ‘প্রি উইভিং’ মানে তাঁতের কাপড় বোনার আগের কাজগুলো, যেমন- নলিতে ও মাকুর ভেতর চিটায় সুতা ভরানো, বও বাঁধা ইত্যাদি কাজ করে। কাপড় বোনার মতোই পরিশ্রমের কাজ এগুলো। ‘কারেন্টের কল’ আসার কারণে ‘গেদি’ অর্থাৎ বাড়ির মেয়েটি বেঁচে গেছে সেই কায়িক পরিশ্রম থেকে। সে কথাই বলা হয়েছে এই গানে।

পাবনা জেলার প্রচলিত গোপে দাসের একটি গানে দোগাছি অঞ্চলের বিখ্যাত শাড়ির গল্প পাওয়া যায়। পাবনা-সিরাজগঞ্জ সুতির শাড়ি তৈরির জন্য বিখ্যাত বেশ আগে থেকেই। গল্প শোনা যায়, দোগাছির শাড়ি গুণে ও মানে এতই উৎকৃষ্ট ছিল যে, এককালে এটি জোগাড় করতে না পারলে বিয়ে হতো না। বিশেষ বিশেষ উৎসব-পার্বণে নারীদের এই শাড়ি কিনে দিতেই হতো। তেমন এক চিত্র ধরা পড়েছে গোপে দাসের ধুয়া গানে।
দোগাছির শাড়ি ভাই ভাই
তার ওপরে শাড়ি নাই
স্বামী তোমার ধরি পায়
কিন্যা দেও আমায়।

অভিজ্ঞ দাদু তার নাতনিকে জোলাপাড়া অর্থাৎ তাঁতিদের গাঁয়ে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কারণ, ছেঁড়া কাপড় পরা দরিদ্র পরিবারের সুন্দরীদের নতুন কাপড় দিয়ে প্রণয় নিবেদন করা যুবকের অভাব ছিল না তাঁতিদের ঘরে। দাদুর কথা না শুনে তরুণী নাতনি গিয়েছিল তাঁতিদের গাঁয়ে। ফল যা হবার তাই হয়েছে। নতুন কাপড় দিয়ে নাতনির মন গলিয়ে নিয়েছে সে-গাঁয়ের এক ‘কালো’ যুবক। এটি টাঙ্গাইল অঞ্চলের ‘ছবকি’ গান, গায়ক রহিজ মাতাব্বর।

আগে না কইছিলাম নাতিন
যাইস না জোলা পাড়া
কাইল দেখছি তোর কাপড় ছিরা
কাপড় দিল কেরা লো।।
ওলো নাতিন কালা জামাই রসের ভিমরা।।

বিয়ের গান বাংলা লোকসংগীতের এক অনবদ্য অংশ। বর-কনে উভয়ের বাড়িতেই এসব গাওয়া হয় বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায়। বিয়ের গানে কনের বাড়িতে ঠাট্টার ছলে বরের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথা বলা হয়ে থাকে।

উত্তর থিকা আইলো রে নওশা
জামে একে বাজিয়া
জামে একে বাজিয়া।
বিবির জন্য আনছে শাড়ি
হ্যারে নিত্তির ওজন দিয়া গো
হ্যারে নিত্তির ওজন দিয়া গো।
গানটিতে বলা হচ্ছে, উত্তরাঞ্চলের নতুন বর তার বিবির জন্য যে শাড়ি এনেছে, তা এতই পাতলা, নিক্তিতে (সোনা পরিমাপের দাঁড়িপাল্লা) মাপা যায়। এতে অবশ্য দুই ধরনের অর্থ রয়েছে। পাতলা ফিনফিনে বস্ত্র অনেক সময় আভিজাত্যের প্রতীক। যেমন মসলিন। আবার এটি দারিদ্র্যকেও নির্দেশ করে। কারণ, ঘন বুনটে সঠিক সুতায় না বুনলেও বস্ত্র পাতলা হতে পারে, যেগুলো কম দামে বাজারে পাওয়া যায়। যা হোক, এই গানে নতুন বরকে উপহাস করা হয়েছে এই কাপড়ের জন্য।
তাঁতশিল্প ও তাঁতিদের নিয়ে এ রকম কত দৃশ্যকল্প যে ছড়িয়ে আছে বাংলার লোকগানে, তার হিসাব করা অসম্ভব। বিশেষ মতাদর্শের লোককবিরা হয়তো রূপক অর্থে তাঁতের বিভিন্ন অনুষঙ্গকে ব্যবহার করেছেন তাদের গানে। অন্যদিকে প্রচলিত বিভিন্ন লোকগানে তাঁত, তাঁতি সমাজ ইত্যাদির একটা সমাজ-নৃতাত্ত্বিক চিত্র পাওয়া যায়। এই লোকগানগুলো সংগ্রহ করে, সেগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে তাঁতশিল্প, তাঁতি এবং তাঁতে তৈরি বস্ত্রের অনেক অনুদ্ঘাটিত ইতিহাস জানা সম্ভব।
সহায়ক গ্রন্থ : শাওন আকন্দ, বাংলাদেশের তাঁতশিল্প। দেশাল, ঢাকা, ২০১৮। শামসুল আলম সাঈদ, চর্যাপদ, তাত্ত্বিক সমীক্ষা। এডর্ন পাবলিকেশন্স, ঢাকা।
ব্যবহৃত লিঙ্ক: বাংলাপিডিয়া (https://goo.gl/erp73Q),সাপ্তাহিক আমাদের মানচিত্র (https://goo.gl/erp73Q)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top