স্মরণ I প্রণমি তোমায়
সবার কপালের টিপ কেবল টিপ হয়েই থাকে না। কারও কারওটি হয়ে ওঠে সূর্য- তেমনই কপাল তাঁর। তিনি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী।
তিনিই শিখিয়েছেন কপালের টিপ কেবল সৌন্দর্যচর্চা নয়, ব্যক্তিসত্তার পরিপূরক, প্রকাশ করে নিগূঢ় মর্মার্থ, অপার্থিব আলোয় আলোকিত করে অসংজ্ঞায়িত সৌন্দর্য ও আত্মার যোগ। টিপ দিয়ে যিনি প্রকাশ করতেন গ্রহ, নক্ষত্র, পৃথিবী, মাটি, শিকড়, স্বপ্ন, স্বাধীনতা কিংবা বিশ্বাস- তাঁর শিল্পীমনের ব্যাপ্তি খুঁজতে যাওয়া ঔদ্ধত্য। তবে তাঁর ভাবনা, জীবনাচরণ, অভিজ্ঞতা, শিল্পকর্ম এবং ভালোবাসায় বাধা রাখেননি। তিনি শিল্পী, তিনি ভাস্কর, তিনি মুক্তিযোদ্ধা, তিনি মা- তিনি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী।
তিনিই প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন, বীরাঙ্গনা লজ্জার নয়, সম্ভ্রমহানির বিষয় নয়, শ্লীলতাহানির বিষয় নয়- এটা গর্বের। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যৌন নির্যাতন করেছিল এ দেশের নারীদের আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেবার জন্য। তারা ধর্ষণ করেছিল যাতে বাঙালি নারী মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। এ বিষয়টি নিয়ে যিনি প্রথা ভেঙে কথা বলেছিলেন তিনি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘সকল বীরাঙ্গনা নারী জাতির পক্ষ থেকে বলব- যারা সেদিন নীরবে যুদ্ধ করেছেন, অত্যাচারের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ করেছেন, ধর্ষণের মধ্য দিয়ে, অসহায়ত্বের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ করেছেন, তাদেরকেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত।’
কপালে লাল বড় টিপ, চোখে গাঢ় কাজল, গলায় কাঠ, মাটি কিংবা পাথরের গয়না, শান্ত, সৌম্য রূপের দিকে তাকালেই এক সতত জননীর প্রতিকৃতি ধরা পড়ে- তাই তো তিনি সিক্ত হয়েছেন অসংখ্য সন্তানের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ‘মা’ ডাকে। ১৯৭১ সালে এ দেশের আরও লাখো নারীর সঙ্গে তিনিও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ নয় মাসে শেষ হলেও তাঁর সংগ্রাম শেষ হয়নি। পদে পদে নিন্দা, অবজ্ঞা, কটূক্তি ও কুদৃষ্টি তাঁকে অস্পৃশ্য বানাতে চেয়েছে। তবু মাথা উঁচু করে জীবনযুদ্ধে লড়ে গেছেন- শিল্পকর্মে ডুব দিয়েছেন, সন্তান লালন পালন করেছেন, চাকরি করেছেন। স্বাধীনতার ২৮ বছর পরে হলেও তিনি একাত্তরে নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন জনসম্মুখে। জীবনের এত ক্লেদ, এত নিষ্ঠুরতার পরেও উঠে দাঁড়িয়েছেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। মানুষের কাছ থেকে বিরূপ আচরণ পেয়েও ফিরে গেছেন মানুষের কাছে। তাঁর ওপর নেমে আসা নির্মমতাই পরবর্তী সময়ে জীবনের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে।
তীব্র বঞ্চনাবোধ থেকেই উৎসারিত হয়ে এসেছে প্রিয়ভাষিণীর শিল্প। সমাজ, পরিবার আর নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে যখন বিষণ্ন, ক্লান্ত হয়ে পড়তেন, তাঁর মন খুলে দিতেন প্রকৃতিকে। প্রকৃতিতে মগ্ন হতেন। তাই উৎস হয়েছে তার সৃষ্টিসম্ভারের। নিতান্তই তুচ্ছ গাছের ডাল, শিকড়-বাকড় আর পরিত্যক্ত কাঠের টুকরা, পোড়া কাঠ আর শেওলা ধরা ভাঙা বাঁশের টুকরা, পচতে থাকা কাঠের টুকরা, অযত্নে বেড়ে ওঠা কোনো উদ্ভিদের মাঝে তিনি আবিষ্কার করে ফেলেন শিল্পকলার বিষয়-আশায়। তাঁর সৃষ্টিশীলতায় এসব পরিত্যক্ত সামগ্রী হয়ে ওঠে এক একটি শিল্পকর্ম।
একদিন শিল্পী এস এম সুলতান তাঁর কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে বললেন, ‘তুমি তো একজন শিল্পী! হেনরি মুরের সৌন্দর্য নিয়ে এসেছ তুমি তোমার ভাস্কর্যে।’ সুলতান তাঁকে শিল্পী হিসেবে তুলে ধরেছেন জাতির সামনে। যশোর শিল্পকলা একাডেমিতে প্রথম প্রদর্শনীর মাধ্যমে শুরু হয় ভাস্কর প্রিয়ভাষিণীর যাত্রা।
তাঁর শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিজের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। ক্ষয়ে যাওয়া কাঠ যেভাবে ভিন্ন আকৃতিতে হয়ে ওঠে শিল্পের মূর্ত প্রতীক, তাঁর জীবনটাও যেন তেমনি পুড়ে হয়েছে খাঁটি সোনা। প্রায় সাত মাস পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারে প্রায় ফুরিয়ে যাওয়া জীবনীশক্তি নিয়ে তিনি যেমন ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, তেমনই তিনি ফুরিয়ে যাওয়া কাঠের টুকরা, শিকড়, গাছের গুঁড়িকে তুলে এনে দান করেছেন নতুন জীবন।
২০১০ সালে সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা খেতাব দেয়। অবশ্য স্বীকৃতি কিংবা সম্মাননা নয়, কঠিন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করার যে সাহস ও প্রেরণা তিনি দিয়েছেন উত্তরসূরিদের, অপশক্তিকে রুখে দিতে তা উজ্জীবিত করবে লড়াকু প্রজন্মকে। তিনি চাইতেন কাজের মাধ্যমে বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করে যেতে। কুমারী মায়েদের পুনর্বাসন, আশ্রয়হীন শিশুদের জন্য কাজ করারও ইচ্ছে ছিল তাঁর। রোড আইল্যান্ডগুলোকে কাজে লাগানোর কথা ভাবতেন। সারা বাংলায় পথে পথে গাছ লাগানোর স্বপ্ন থেকেই বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি শুরু করেন।
‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে
তবু শান্তি তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে’
গত ৬ মার্চ অনন্তলোকের মহাযাত্রায় পাড়ি জমান ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। যতটুকু চলে গেলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি রয়ে গেলেন শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, স্বপ্ন ও আদর্শে।
দীপান্বিতা ইতি
ছবি: ডি এম শিবলী