skip to Main Content

কভারস্টোরি I নবদুর্গায়ন

এ যেন নয়-এর নান্দনিক উদযাপন। নয় রাতের আরাধনায় পূজিত হয় দেবী দুর্গার নয়-নয়টি কায়া মূর্তি। রূপের আদলে নবসাজে সেজে ওঠেন দেবী। উপাসকেরাও কম যান না! রীতি মেনেই রাঙিয়ে নেন নিজেদের। কারণ, রূপের সঙ্গে রঙের এই সম্পৃক্তি পুরাণপ্রসিদ্ধ। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আস্থা আর শুভাশুভের সংকেত। লিখেছেন জাহেরা শিরীন

প্রথমং শৈলপুত্রীতি দ্বিতীয়ং ব্রহ্মচারিণী।
তৃতীয়ং চন্দ্রঘণ্টেতি কুষ্মাণ্ডেতি চতুর্থকম্॥
পঞ্চমং স্কন্দমাতেতি ষষ্ঠং কাত্যায়নী তথা।
সপ্তমং কালরাত্রীতি মহাগৌরীতি চাষ্টমম্॥
নবমং সিদ্ধিদাত্রীতি নবদুর্গাঃ প্রকীর্তিতাঃ।
উক্তান্যেতানি নামানি ব্রহ্মণৈব মহাত্মনা॥

শ্রীশ্রী চণ্ডীর দেবীকবচ অধ্যায়ের তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্লোকে নবদুর্গার এ উল্লেখ পাওয়া যায়। যেখানে প্রথমবারের মতো দেবী দুর্গার নয়টি রূপের বর্ণনা ও মহিমা প্রকাশিত হয়। রাবণবধ ও দেবী সীতাকে উদ্ধারে অনুগ্রহ করায় স্বয়ং রামচন্দ্র অভয়াশঙ্করী দুর্গার অকাল বোধন করে নবরাত্রির ব্রত পালন করেছিলেন। এটা কৃত্তিবাসী রামায়ণের মতে। তবে পুরাণের বর্ণনা ভিন্ন। বৃহদ্ধর্মপুরাণে রামের জন্য ব্রহ্মার দুর্গাপূজার বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। এই পুরাণমতে কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গের পর রামচন্দ্রের অমঙ্গল আশঙ্কায় দেবতারা শঙ্কিত হন। তখন ব্রহ্মা বলেন, দুর্গার আরাধনা ছাড়া উপায় নেই। রামচন্দ্রের মঙ্গলের জন্য স্বয়ং ব্রহ্মা যজমানি করতে রাজি হন। তখন শরৎকাল। দক্ষিণায়ন। দেবতাদের নিদ্রার সময়। তাই ব্রহ্মা স্তব করে দেবীকে জাগিয়ে তোলেন। কুমারী বেশে দেবী ব্রহ্মাকে এসে বলেন বিল্ববৃক্ষমূলে দুর্গার বোধন করতে। দেবতারা মর্ত্যে এসে এক দুর্গম স্থানে একটি বেলগাছের শাখায় সবুজ পাতার শাখে ঘুমন্ত অবস্থায় অতিসুন্দরী মেয়ে খুঁজে পান। ব্রহ্মা বুঝতে পারেন, এই মেয়েই জগজ্জননী দুর্গা। তিনি বোধন স্তবে তাকে জাগিয়ে তোলেন। জেগে উঠে দেবী চণ্ডিকামূর্তি ধারণ করেন। তখন ব্রহ্মা বলেন, রাবণবধে রামচন্দ্রকে অনুগ্রহ করার জন্য অকালে জাগিয়ে তোলা হয়েছে তাকে। যত দিন রাবণবধ না হয়, তত দিন এ পূজা চলবে। শুধু তা-ই নয়, যত কাল সৃষ্টি থাকবে, তত দিন মর্ত্যবাসী এ পূজা চালিয়ে যাবে বলে আশ্বস্ত করা হয় দেবীকে। এরপর চণ্ডিকারূপী দেবী ব্রহ্মাকে বলেন, সপ্তমী তিথিতে তিনি রামের ধনুর্বাণে প্রবেশ করবেন। অষ্টমীতে রাম-রাবণে মহাযুদ্ধ হবে। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণের দশমুণ্ডু বিচ্ছিন্ন হবে। সেই দশমুণ্ডু পুনরায় জোড়া লাগলেও নবমীতে নিহত হবেন রাবণ। দশমীতে রামচন্দ্র বিজয়োৎসবে মাতবেন। হয়েছিলও তাই। মহাবিপদ অষ্টমীতে কেটে যাওয়ায় হয়ে উঠল মহাঅষ্টমী। রাবণ বধ করে মহাসম্পদ সীতাকে লাভ করলেন রাম, তাই নবমী হলো মহানবমী। আজও বোধনের মন্ত্রে উচ্চারিত হয়:

ওঁ ঐং রাবণস্য বধার্থায় রামস্যানুগ্রহায় চ
অকালে বৃহ্মণা বোধো দেব্যস্তয়ি কৃতঃ পুরা॥
অহমপাশ্বিনে ষষ্ঠ্যাং সায়াহ্নে বোধয়মি বৈ।
[হে দেবী, রাবণবধে রামকে অনুগ্রহ করার জন্য ব্রহ্মা তোমার অকাল বোধন করেছিলেন, আমিও সেইভাবে আশ্বিন মাসের ষষ্ঠী তিথিতে সন্ধ্যায় তোমার বোধন করছি।] পুরাণমতে, ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্র শারদীয় দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। পালন করেন নবরাত্রি ব্রত। এটি পালিত হয় শুক্লা প্রতিপ্রদ থেকে নবমী পর্যন্ত। আশ্বিন মাসে, শরৎকালে একদিকে যেমন দুর্গাপূজা হয়, ঠিক তেমনি চলে এই ব্রত। সনাতন ধর্মমতে মহালয়ার আগের ১৫ দিন থাকে পিতৃপক্ষ। মহালয়ার দিন থেকে শুরু হয় দেবীপক্ষের। এর সূচনাকালের প্রথম দিন অর্থাৎ মহালয়ার পরদিন থেকে নবমী পর্যন্ত এই নয় রাতে দেবী দুর্গার নয়টি আলাদা রূপকে শাস্ত্র অনুযায়ী পূজা করা হয়। এই উপলক্ষ পরিচিত নবরাত্রি নামে। দুর্গার এই নয় শক্তি আভিধানিকভাবে নবদুর্গা নামে পরিচিত। পিতামহ ব্রহ্মা দেবী দুর্গার এই নয়টি রূপের নামকরণ করেছিলেন। সাধারণত উত্তর আর পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলোতে নবরাত্রির উৎসব উদযাপিত হয় জাঁকজমকের সঙ্গে। আয়োজিত হয় আমাদের দেশেও, তবে পরিসর স্বল্প।
বছরে দুবার উদযাপিত হয় নবরাত্রি। চৈত্র (মার্চ-এপ্রিল) এবং শারদ (অক্টোবর-নভেম্বর) মাসে। দুর্গাপূজার নিয়মকানুনের সঙ্গে এর যেমন সামঞ্জস্য রয়েছে, রয়েছে বহু বৈসাদৃশ্যও। নবরাত্রির অর্থ হচ্ছে নয়টি রাত। এই পূজা সাধারণত রাতে করা হয়। সারা দিন উপোস থেকে রাতে দেবীর আরাধনা সেরে তবেই পারণ করা যায়। পূজার দিনগুলোতে বাড়িতে আমিষ খাওয়া নিষিদ্ধ থাকে। পেঁয়াজ, রসুনের মতো সবজিও বাদ রাখা হয় দৈনন্দিন খাবারের তালিকা থেকে। এই নয় দিনে দেবীর রূপের সঙ্গে মানিয়ে তাকে সাজানো হয়। সেজে ওঠেন অনুরাগীরাও। এ ক্ষেত্রে বিশেষ নয়টি রং প্রাধান্য পায়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, প্রথা মেনে এগুলো পরিধানে দেবী সন্তুষ্ট হন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়।
হলুদ হর্ষ
নবরাত্রির প্রথম রাতে পূজিত হন শৈলপুত্রী, দেবী দুর্গার প্রথম রূপ। বাহন বৃষ। দক্ষিণ হস্তে ত্রিশূল আর বাম হস্তে কমল থাকায় দেবীর এ রূপের অপর নাম শূলধারিণী। পূর্বজন্মে ছিলেন দক্ষনন্দিনী বা দাক্ষায়নী সতী দেবী। বিনা অনুমতিতে শিবকে বিয়ে করায় প্রতিশোধ নিতে শিবহীন যজ্ঞের আয়োজন করেন দক্ষ। বিনা নিমন্ত্রণে সতী দেবী পিত্রালয়ে গিয়ে অপমানিত হন। দেহত্যাগ করেন সতী রূপে আবির্ভূত মহামায়া। এরপর ভগবান শিব দক্ষযজ্ঞ ধ্বংস করেন। দেবী মহামায়া পরজন্মে হিমালয়কন্যা পার্বতী রূপে জন্ম নেন। হিমালয়কে শৈল নামেও আরাধনা করা হয়। তাই শৈলপুত্রী রূপে পূজিত হন দেবী। উজ্জ্বল হলুদ বর্ণে; যা উজ্জ্বলতা আর উদ্দীপনার উৎস। এই রং আত্মবিশ্বাসেরও পরিচায়ক। ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টিকারী। তাই শক্তির প্রতীক শৈলপুত্রী দেবীর আরাধনায় হলুদ পোশাকে নবরাত্রি পূজার শুরুর প্রথাকে শুভ মানা হয় সনাতন ধর্মে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ বছর ফ্যাশনবিশ্বেও সবচেয়ে বেশি অপটিমিস্টিক কালারের খেতাব জুটেছে রংটির। ফুল অন, হেড টু টো ম্যাক্সিমালিস্ট আউটফিটে সেজে উঠলে তাই মন্দ দেখাবে না।
সম্মোহনী সবুজ
দ্বিতীয় দিন ব্রহ্মচারিণী রূপে পূজিত হন দেবী। তপস্যারিণী রূপে। যার রূপ জ্যোতিতে পূর্ণ, অতি মহিমামণ্ডিত। রুদ্রাক্ষ আর কমণ্ডলু শোভিতা। স্নিœগ্ধ সবুজ বর্ণা। স্বামী রূপে শিবকে পাওয়ার আশায় কঠিন তপস্যা আর কৃচ্ছ্রসাধন করেন তিনি। সহস্র বছর ধরে শুধু ফলমূল খেয়ে জীবনধারণ করেছিলেন। তারপর শতবর্ষ পার করেন শাক খেয়ে। যার কারণে তাকে পটলবতী বা শাকাহারিণীও বলা হয়। এরপর তিন সহস্র বছর শুধু গাছ থেকে মাটিতে ঝরে পড়া বেলপাতা ছিল তার আহার। এরপর তা-ও ত্যাগ করে নির্জলা, নিরাহারে থেকে তপস্যা শুরু করেন দেবী। দেবতা, ঋষি, সিদ্ধগণ, মুনিসহ সবাই একে অভূতপূর্ব পুণ্যকাজ বলে প্রশংসায় মেতে ওঠেন ব্রহ্মচারিণী দেবীর। অবশেষে পিতামহ ব্রহ্মা প্রসন্ন হয়ে আকাশবাণীর মাধ্যমে জানান দেন, তার মনস্কামনা সর্বতোভাবে পূর্ণ হবে। ভগবান শিবকে পাবেন পতিরূপে। সনাতন ধর্মে প্রচলিত, দেবী দুর্গার এ দ্বিতীয় রূপ ভক্ত ও সিদ্ধদের অনন্ত ফল প্রদানে সহায়ক। তার উপাসনায় মানুষের স্বভাবে তপ, ত্যাগ, বৈরাগ্য, সদাচার, সংযম বৃদ্ধি পায়। কঠিন সংঘর্ষেও মন বিচলিত হয় না। দেবীর কৃপায় সর্বদা সিদ্ধ আর বিজয় প্রাপ্তি হয়। দেবীর মৃণ¥য়ী রূপের আরাধনা করা হয় এই দিন। সবুজ পোশাক পরে। এতে জীবনে উন্নতি আসে বলে বিশ্বাস তাদের। নতুন সূচনার সহায়ক। এ বছর সবুজও রয়েছে ফ্যাশনের শীর্ষ কালার প্যালেটের তালিকায়। প্রমাণ, ক্ল্যাসিক ব্র্যান্ডগুলো থেকে ওয়াইটুকে ইন্সপায়ারড লেবেলগুলোতে এই জুয়েল টোনের উপস্থিতি। তাই নবরাত্রির দ্বিতীয় দিনে সবুজে সেজে উঠলে স্নিগ্ধ দেখানোর পাশাপাশি সৌভাগ্যও থাকবে তুঙ্গে।
ধ্রুপদি ধূসর
তৃতীয় দিনের এ রাতে দেবীর চন্দ্রঘণ্টা রূপ প্রকাশিত হয়। ধূসরবর্ণা এ দেবীরূপ পরম কল্যাণিকা ও সুমঙ্গলা। শিবের সঙ্গে বিয়ের পর কপালে অর্ধচন্দ্র অঙ্কন ছিল মহাগৌরীর সাজসজ্জার অঙ্গ। এটি ঘণ্টার মতো দেখতে হওয়ায় দেবীর নামকরণ হয় চন্দ্রঘণ্টা। অবশ্য তিনি চিত্রঘণ্টা নামেও পরিচিত। তার রয়েছে সিংহবাহিনী। তবে কাশীর মন্দিরে তার ব্যাঘ্রবাহিনী দেখা যায়। দশভুজা, দশপ্রহরণধারিণী। তার গায়ের রং সোনার মতো উজ্জ্বল। চণ্ডীর স্তবে বর্ণিত আছে, মহিষাসুর বধের আগে দেবতাদের সম্মিলিত জ্যোতি থেকে যখন দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটে, তখন দেবতারা তাকে নিজ নিজ অস্ত্রে সজ্জিত করেন। ইন্দ্র সে সময় নিজ বাহন ঐরাবতের গলা থেকে ঘণ্টা খুলে নিয়ে তা থেকে আরেকটা ঘণ্টার সৃষ্টি করে দেবীকে অর্পণ করেন। যুদ্ধ চলাকালে দেবী এই ঘণ্টা বাজানোর পর অসুর সৈন্যরা নিস্তেজ হয়ে পড়েন। নবরাত্রির এই তিথিতে ধূসর পরার প্রচলন রয়েছে। সনাতন ধর্মে বিশ্বাস করা হয়, চন্দ্রঘণ্টা দেবী সমস্ত মন্দের ধ্বংসকারী। আর ধূসর পরে তার আরাধনা করলে জীবনের নেতিবাচকতা দূর হয়। এ বছর ওয়্যারড্রোবে এই রঙের সংযুক্তিকে ডিজাইনাররা দেখছেন পরিশীলতার যোগ হিসেবে। যারা লুকে ভারসাম্য পছন্দ করেন, তারা অনায়াসেই পরে নিতে পারেন প্যালেটের নিউট্রাল এ শেড।
কমলায় কৃতার্থ
চতুর্থ রাতে দেবী কুষ্মাণ্ডার রূপে পূজিত হন। এখানে উষ্মার অর্থ তাপ। পুরাণমতে দুর্বিষহ ত্রিতাপ হলো কুষ্মা, যিনি ত্রিতাপকে নিজের পেটে ধারণ করার ক্ষমতা রাখেন। দেবী এই রূপ ধারণ করার পরেই মহাবিশ্বের সৃষ্টি। যে কারণে তিনি বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে পূজিত হন। দেবী এখানে সিংহবাহিনী। কখনো দশ হাতের তো কখনো আট হাতের। আটটি হাতে সুদর্শনচক্র, ধনুর্বাণ, রক্তপদ্ম, কমণ্ডলু ইত্যাদি দৃষ্টিগোচর হয়। দেবীর বাম হস্তে একটি অমৃতপূর্ণ কলসও থাকে। এখানে অমৃত ব্রহ্মের রূপক। অর্থাৎ দেবী ব্রহ্মজ্ঞানের আধার হাতে নিয়ে বসে থাকেন। যোগ্য সাধক আপন তপোবল ও কৃচ্ছ্র দ্বারা মহামায়াকে প্রসন্ন করতে পারলে তবেই দেবী ব্রহ্মজ্ঞানে কৃতার্থ করেন। প্রচলিত আছে, কমলাবর্ণা এ দেবীর স্মিত হাসিতেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি। তাই কমলা রং পরিধানের প্রথা প্রচলিত রয়েছে। রংটি উষ্ণতা, আগুন ও শক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই ধারণা করা হয়, কমলা পোশাকে পূজায় দেবী প্রসন্ন হবেন। আসবে সৌভাগ্য। আর এ বছর রংটি আছে ট্রেন্ডিং লিস্টের শীর্ষে। ডোপামিন ড্রেসিংয়ে ঝোঁক থাকলে এই হ্যাপি ব্রাইট কালারের সনাতনী পোশাকেও দেখাবে নজরকাড়া।
শুভ্র সর্বমঙ্গল্য
বাংলায় দেবীকে যেমন গণেশজননী হিসেবে পূজা করা হয়, ঠিক তেমনি পশ্চিম ভারতে আবার তাকে আরাধনা করা হয় কার্তিকেয়র মাতা হিসেবে। যার আরেক নাম স্কন্দ। নবরাত্রির পঞ্চম রাতে দেবী পূজিত হন স্কন্দমাতা রূপে। ত্রিনয়নী এ দেবী চার হাতবিশিষ্ট। ডান দিকের ওপরের হাতে শিশু কার্তিক, আর নিচের হাতে প্রস্ফুটিত পদ্ম। বাঁ দিকের এক হাতে বরাভয় দিচ্ছেন, আরেক হাতে ধরে আছেন পদ্ম। এই রূপে দেবী সিংহ বাহনে উপবিষ্ট হন। বসে থাকেন ফুটে থাকা কমলে। শুভ্রবর্ণা এই দেবী পদ্মাসনা রূপেও পরিচিত। পূজিত হন নবরাত্রির পঞ্চম দিনে। এ দিনে সাদা রঙের পোশাক পরলে সৌভাগ্য খুলে যায় বলে মত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের। স্কন্দমাতার শাড়িও যেহেতু সাদা রঙের হয়, এদিনে সাদা পরলে সুখ ও সমৃদ্ধির মাত্রা বেড়ে যায় বলে বিশ্বাস করা হয়। আর বছরের এই শেষ প্রান্তে অল হোয়াইট ট্রেন্ড নজরে পড়বে সবচেয়ে বেশি। অলটাইম ক্ল্যাসিক এ কালার চোখে আরাম দিলেও আয়োজনের জাঁকজমক কমিয়ে দেবে না এতটুকুও।
লাল লগ্ন
ষষ্ঠ দিনে দেবী পূজিত হন কাত্যায়নী রূপে। এই নাম এবং রূপের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পৌরাণিক কাহিনি। পুরাণমতে, কাত্যায়নের কন্যারূপে দেবী জন্ম নিয়েছিলেন। বৈদিক যুগে কাত্যায়ন ছিলেন একজন মহাঋষি। এক পুত্রের পিতা। কিন্তু কন্যাসন্তানের প্রবল আকাঙ্ক্ষায় তিনি দেবী পার্বতীর তপস্যা শুরু করেন। অভীষ্ট পূর্ণও হয়। তার স্তবে তুষ্ট হয়ে স্বয়ং দেবী পার্বতী জন্ম নেন মহাঋষি কাত্যায়নের কন্যাসন্তান রূপে। তখন তার নাম হয় কাত্যায়নী। বামন পুরাণ গ্রন্থে দেবী কাত্যায়নীর উদ্ভবের কাহিনি অবশ্য অন্য রকম। দেবগণ চরম দুরবস্থায় বিষ্ণুর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলে তার আদেশে শিব, ব্রহ্মা ও অন্য দেবীরা দেবী দুর্গার অংশ নিয়ে তাকে কায়া রূপ দেন। সবার দেহ থেকে দিব্য তেজ নির্গত হয়, সৃষ্টি হয় জ্যোতিপর্বতের। এই জ্যোতিপর্বত অষ্টাদশভুজা, কৃষ্ণকেশী, ত্রিনয়না ও সহস্র সূর্যের প্রভাযুক্তা দেবী কাত্যায়নীর রূপ নেয়। শিব তাকে ত্রিশূল দেন, বিষ্ণু দেন সুদর্শন চক্র, বরুণ দেন শঙ্খ, অগ্নি দেন শক্তি, বায়ু দেন ধনুক, সূর্য থেকে মেলে তীরভরা তূণীর, ইন্দ্র দেন বজ্র, কুবের দেন গদা, ব্রহ্মা দেন অক্ষমালা ও কমণ্ডলু, কাল দেন খড়্গ এবং ঢাল আর বিশ্বকর্মা দেন কুঠার এবং অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র। এইভাবে অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দেবী চলে যান বিন্ধ্যাচলে। সেখানে করার বিবকরার অসুরদ্বয় তাকে দেখে তার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাদের রাজা মহিষাসুরের কাছে দেবী রূপের বর্ণনা দেন। মহিষাসুর দেবীকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তবে দেবী জানান, যুদ্ধে তাকে পরাজিত করতে পারলে তবেই সে সুযোগ মিলবে। পরবর্তী সময়ে পরাজিত হয় মহিষাসুর। দেবী তার মস্তক ছিন্ন করেন। নাম হয় মহিষাসুরমর্দিনী। সিংহবাহিনী রক্তিমবর্ণা দেবী শক্তির প্রতীক। মহাষষ্ঠীতে বাংলায় যখন দুর্গার বোধন শুরু হয়, উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে উদযাপিত হয় মাতা কাত্যায়নীর পূজা। সনাতন ধর্মে বিশ্বাস করা হয়, এই দিন লাল রঙের পোশাকে পূজা করলে ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকে। দেবীকে এই দিন লাল চেলিতে সাজানো হয়। অনুরাগীরাও তাই লালে সেজে উঠতে পারেন দেবীশক্তি উদযাপনে। আর লাল রং তো সব ঋতুতেই ফ্যাশন কোড হিসেবে বিবেচ্য। পূজায় লাল লুকে আলাদা আভিজাত্য যোগ করে। সনাতনী যেকোনো পোশাকের জমিনে এই রং মানায় ভালো।
নীলে নিষিক্ত
সপ্তম রাতে কালরাত্রি রূপে পূজিত হন দেবী। মূলত নবপত্রিকা স্নানের মাধ্যমে শুরু হয় পূজার আবহ। অনন্ত মহাকাশে নৃত্যরত কালভৈরবের দেহাংশ থেকে জন্ম নেন দেবী যোগনিদ্রা মহাকালিকা, যিনি কৃষ্ণবর্ণ হওয়ায় কালরাত্রি নামেও পরিচিত। দেবী এখানে ভীষণদর্শনা এবং এলোকেশি। ঘোর নীলবর্ণা। নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ভয়ঙ্কর অগ্নিশিখা বের হয়। দৈত্য, দানব, রাক্ষস, ভূতপ্রেতসহ সমস্ত শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের সময় দেবী কালরাত্রির রূপ ধারণ করেন। এই রূপই উপাসিত হয় কালিকা রূপে। তবে এই রূপেও দেবী ভক্তের শুভ করেন। শুভঙ্করিণী এই দেবী বিদ্যুৎশিখার মতো উজ্জ্বল কণ্ঠাহারে ভূষিত। সপ্তমীতে নীল রঙের শাড়িতে ধরা দেন দেবী কালরাত্রি। তাই জ্যোতিষবিদদের পরামর্শ এই পূজায় নীল রঙের পোশাক পরার। এতে স্বাস্থ্য, সম্পদ ও শক্তির উন্নতি হয়। আর সাজে নীলাম্বরী হয়ে ওঠার আলাদা সৌন্দর্য রয়েছে। পূজার সান্ধ্য অনুষ্ঠানে তাই আজও ঘন নীলরঙা পোশাকের আবেদন এড়ানো মুশকিল। এথনিক কিংবা ইন্দো-ওয়েস্টার্ন—সবেতেই সমান সুন্দর কালার প্যালেটের এই রং।
গোলাপি গরিমা
অষ্টমীর রাতে যখন বাংলায় সন্ধিপূজাতে দেবী দুর্গাকে চণ্ডী হিসেবে পূজা করা হয়, তখন পশ্চিম ভারত মহাগৌরীর আরাধনায় মগ্ন। হিমালয়কন্যা ছিলেন গৌরবর্ণা। শিবের তপস্যা করে রোদে যিনি কৃষ্ণা হন। মহাদেব যখন গঙ্গাজল দিয়ে তাকে স্নান করান, তখন তিনি হয়ে ওঠেন ফর্সা। তাই এই রূপের নাম মহাগৌরী। গোলাপি পোশাকে সজ্জিত। প্রচলিত আছে, নবরাত্রির অষ্টম রাতে তার পূজা করলে সব পাপ ধুয়ে যায়। চার হাতবিশিষ্ট দেবীর বাহন ষাঁড়। এক হাত শোভিত বরাভয় মুদ্রায়, বাকি তিন হাতে পদ্ম, ত্রিশূল আর ডমরু। এ দিনে গোলাপি পোশাকে আরাধনায় অংশ নিলে পাপমোচন হয় বলে বিশ্বাস রয়েছে সনাতন ধর্মে। আর এ বছর তো ফ্যাশনিস্তাদের সবচেয়ে পছন্দসই রং গোলাপি। বাবল পিঙ্ক থেকে হট পিঙ্ক—পোশাকে বারবিকোর অ্যাসথেটিক যেন রাজত্ব করছে সর্বত্র। পূজার পোশাকই-বা পিছিয়ে থাকবে কেন।
আসমানি আসিক্ত
নবদুর্গার নবম তথা শেষ রূপ সিদ্ধিদাত্রী। সিংহবাহিনী দেবীর চার হাতে আশীর্বাণী মুদ্রা। তিনি সিদ্ধি দান করেন। তার উপাসনায় সংসারে আসে সুখ ও সমৃদ্ধি। সবাইকে বরাভয় দেন এই মাতৃকামূর্তি। পুরাণে আছে, স্বয়ং মহাদেব দেবীকে সিদ্ধিদাত্রী রূপে পূজা করেছিলেন। আশীর্বাদে মহাদেব সিদ্ধিও লাভ করেন। এই দিন হালকা নীল বা আসমানি পরার প্রচলন রয়েছে। কারণ, এ দিনে দেবীর আভূষণও হয় হালকা নীল। আদি পরাশক্তির প্রকাশ। সিদ্ধিদাত্রী হিসেবে সাফল্যের প্রতীকস্বরূপ। প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হওয়ারও প্রকাশ। তাই নবরাত্রির শেষ লগ্নে আসমানি রঙে সেজে ওঠেন অনুরাগীরাও।

মডেল: অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব ও জুয়েলারি: কিয়ারা
স্টাইলিং ও ফ্যাশন ডিরেকশন: ফয়সাল তুষার
ছবি: হাদী উদ্দীন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top