যাপনচিত্র I ব্যর্থতায় বাজি
এফ এস নাঈম। মডেল, অভিনেতা, গায়ক ও উপস্থাপক। মিডিয়ায় প্রথম উপস্থিতি নব্বইয়ের দশকে। এখনো দাপুটে বিচরণ
সর্বদা একটি নতুন দিনের প্রত্যাশায় আনন্দিত হন এফ এস নাঈম। একটি নতুন চেষ্টা, আরও একটি শুরুর জন্য প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে পড়েন। সম্ভবত সকালের পেছনে কোথাও কিছু জাদু অপেক্ষা করে তার জন্য! খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠেন বলে ব্রেকফাস্ট করেন তিন ধাপে। ঘুম থেকে উঠে হালকা নাশতা সেরে বেরিয়ে যান জিমের উদ্দেশে। শারীরিক কসরত বলতে কার্ডিও করেন মূলত। তবে শুটিং থাকলে উত্তরায় অবস্থিত নিজ বাসার আশপাশের রাস্তায় ও লেকে হাঁটেন। দীর্ঘদিন ধরে পায়ে সমস্যা থাকায় সাইক্লিং ও হাঁটা ছাড়া অন্য কিছু তেমন একটা করেন না। ট্রেডমিল ব্যবহার তো রীতিমতো নিষেধ। ডিম ও ওটস তার সকালের মেনুতে থাকে নিয়মিত। তবে মেনু সবচেয়ে দীর্ঘ থাকে ব্রেকফাস্টে। সে ক্ষেত্রে ভোর ছয়টার আগেই কখনো কখনো পোলাওর মতো খাবার রাখতেও দ্বিধা করেন না। সুস্থ জীবনযাপন তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
সকালের নাশতা, ওয়ার্কআউটসহ নিয়মিত কাজগুলো শেষ করে দিনের কাজ শুরু করেন। বলাই বাহুল্য, নাঈম বেশ সময় ও নিয়মানুবর্তী। কাজের বেলায় নিয়মিত হোমওয়ার্ক করেন। কী বলবেন বা করবেন, আগে থেকেই গুছিয়ে রাখতে চান। কাজ সম্পর্কে সার্বিক ধারণা রাখাকে মনে করেন গুরুত্বপূর্ণ। মেইনটেইন করেন ক্যালেন্ডার। এমনকি পরিবারের সঙ্গে কোথাও ঘুরতে গেলেও তা দু-তিন সপ্তাহ আগে থেকেই ঠিক করে রাখেন। ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফ্যামিলি তার কাছে অগ্রাধিকার পায় সব সময়। সবকিছুর আগে তিনি পরিবারকেন্দ্রিক মানুষ।
মিডিয়ার বাইরে নাঈমের সবচেয়ে কাছের বন্ধু শাহাদাতুল ইসলাম কল্যাণ ও এলদেম ফারুকী। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার ক্ষেত্রেও আগে থেকে শিডিউল ঠিক করে রাখেন। সেই হিসাবেই দেখা করেন, হোক ইনডোর কিংবা আউটডোরে। বেশির ভাগ বন্ধুই স্কুলজীবনের। পড়েছেন মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে। শৈশব কেটেছে পৈতৃক নিবাস রাজধানীর শাহজাহানপুরে। কৈশোরও। বর্তমানে উত্তরায় বাস। অ্যাপার্টমেন্টের হোম ডেকোরেশনে পরিবারের অন্য সবার সঙ্গে নিজের পছন্দেরও প্রতিফলন ঘটান। নব্বইয়ের দশকে বেড়ে উঠেছেন বলে চেষ্টা করেন বাসার আসবাব, হোম ডেকর থেকে শুরু করে সবকিছুতে ভিনটেজ, ক্ল্যাসিকের ছোঁয়া রাখতে; সমন্বয় করেন মডার্ন ডিজাইনও। এফ এস নাঈমের বাসা তাই বেশ ছিমছাম ও পরিপাটি।
দুপুরের খাবার একটা থেকে তিনটার মধ্যেই সারেন। পাতে থাকে ৫-৬টি ডিমের সাদা অংশ, নানা ধরনের শাকসবজি ও মাছ। পোশাকের ব্যাপারে তিনি বেশ সিলেকটিভ। বেশি পছন্দ স্যুট, ব্লেজার ও পাঞ্জাবি-পায়জামা। ডেনিম বুটকাটও পছন্দের। ক্যাজুয়াল, ফরমাল শার্ট, টি-শার্টও পরেন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। প্রিয় রং সাদা।
নাঈম বলেন, ‘আমার সবচেয়ে পছন্দের অ্যাকসেসরিজ ঘড়ি ও পারফিউম। সবচেয়ে পছন্দের পারফিউম ক্রিড বাই আভান্তিস, শ্যানেল অ্যালুর (স্পোর্টস অ্যান্ড ক্ল্যাসিক), টমফোর্ড নয়ার ও টাস্কান লেদার, ভারসাচি হোম, আল হারামাইন হায়াতি। আর ঘড়ির কথা বললে সবচেয়ে পছন্দের ব্র্যান্ড আইডব্লিসি ও টিসোট।’
অনেকেই হয়তো জানেন না, এফ এস নাঈম আগাগোড়া গানপোকা। গান শোনার পাশাপাশি ১৯৯৬ সালে নিজেও যুক্ত হয়েছিলেন সংগীতজগতে। যাদের গান প্রেরণা জোগায়, তাদের গানকে শোনার ক্ষেত্রে দেন অগ্রাধিকার। সেই তালিকায় আছে বাংলাদেশের রকস্ট্রাটা, ওয়ারফেজ, উইনিং, আর্ক, ইন ঢাকা, আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, নিলয় দাস, পিকলু (এক্স অর্থহীন), কমল, রাসেল (এক্স ওয়ারফেজ), লাবু, মাকসুদ, পার্থ বড়ুয়া, ফোয়াদ নাসের বাবু, কাজী ফয়সাল আহমেদ আর আন্তর্জাতিকভাবে ব্রুস ডিকিনসন (আয়রন মেইডেন), ফিলিপ আলসেলমো (প্যানটেরা)। মডেলিংয়ে আদর্শ মানেন ডেভিড গ্যান্ডি, প্যাট্রিক ডেম্পসিকে। সব কাজ শেষ করতে পারলে বসেন টিভির সামনে। পছন্দের টিভি সিরিজ ‘অনট্রাজ’ আর সিনেমা ‘আ ওয়াক টু রিমেম্বার’। পছন্দের অভিনেতা ব্র্যাডলি কুপার, ব্র্যাড পিট ও অ্যাস্টন কুচার।
নব্বইয়ের দশকের বাংলা নাটক ও সিনেমা সময় পেলেই দেখেন। হুমায়ুন ফরীদি, খায়রুল আলম সবুজ, তারিক আনাম খান, মামুনুর রশীদ, শতাব্দী ওয়াদুদ, ইন্তেখাব দিনার, আনিসুর রহমান মিলন, জাহিদ হাসান, তৌকীর আহমেদ, শহীদুজ্জামান সেলিম, জিতু আহসানের অভিনয়ের ভক্ত তিনি।
স্টাইল তার কাছে কী—এমন প্রশ্নে নাঈম বলেন, ‘স্টাইল থেকে আমাকে আলাদা করে দেখার কিছু নেই। আমি যা, তা-ই আমার কাছে স্টাইল। স্টাইলের মাঝেই ফুটে ওঠে আমার ব্যক্তিত্ব।’
বাসায় কোনো কাজের মানুষ রাখার পক্ষপাতী নন তিনি। এটা অনেক আগে থেকেই তার পারিবারিক রেওয়াজ। রান্না করেন নিজেও। সেই সুবাদে রান্নার হাত বেশ ভালো নাঈমের। যদিও এই গুরুদায়িত্ব বেশির ভাগ সময়েই সামলান তার জীবনসঙ্গী—মডেল ও অভিনেত্রী নাদিয়া। তবে ঘরের সব ধরনের কাজেই সহযোগিতার হাত নাঈম সব সময় প্রসারিত রাখেন।
ছোটবেলায় মিডিয়াকেন্দ্রিক কিছু হওয়ার স্বপ্ন ছিল না এই তারকার। বরং কোনো ব্রিটিশ স্কুলে পড়ালেখা করার স্বপ্ন দেখতেন। বললেন, ‘আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব দাদা মৃত (এমএলএ) অ্যাডভোকেট আব্দুস সোবহান ছিলেন বেশ জ্ঞানী মানুষ। সেই সময় এমএলএ ছিল বিশাল ব্যাপার। মূলত তাকে দেখেই আমার ব্রিটিশ স্কুলে পড়ার ইচ্ছে জাগে।’
সোশ্যাল মিডিয়া যথাসম্ভব এড়িয়ে চলেন। সম্প্রতি কিছুটা অ্যাকটিভ হলেও তা বেশ সীমিত আকারে। তবে তিনি বেশ ভ্রমণপিয়াসী। তার কাছে ভ্রমণ মানে হলো একই সময়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলা, আর নতুন কিছু খুঁজে পাওয়ার সেরা উপায়। এ পর্যন্ত সার্ক, ইউরোপ ও আমেরিকা মিলিয়ে ২৮টি দেশ ঘুরেছেন। পছন্দের জায়গা হিসেবে শীর্ষে রয়েছে স্ট্রাসবুর্গ। প্যারিস ও জার্মানির বর্ডার লাইনে অবস্থিত জায়গাটি জ্ঞানপিয়াসীদের জন্য যেন এক তীর্থস্থান—অভিমত নাঈমের। কেননা ওই শহরের গলিতে গলিতে লাইব্রেরি দিয়ে সাজানো। আরেকটি পছন্দের জায়গা ইতালির ক্ল্যাসিক শহর ভেরোনা। স্কটল্যান্ড, গ্রিস, বেলজিয়াম, লাসভেগাসের সৌন্দর্যও তাকে বিমোহিত করেছে। ভ্রমণের পরে তার আরেকটি শখ বই পড়া। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সবচেয়ে প্রিয় লেখক; আর সবচেয়ে প্রিয় বই ‘শেষের কবিতা’।
একসময় দারুণ ফুটবল খেলতেন এফ এস নাঈম। পায়ের ইনজুরির কারণে তা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আসন্ন কাতার বিশ্বকাপে বরাবরের মতোই জার্মানির পক্ষে সমর্থন থাকবে তার। ডেডিকেশন, লাইফস্টাইল—সব মিলিয়ে সবচেয়ে পছন্দের ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।
খুব সকালে ওঠেন বলে রাত সাড়ে আটটা থেকে নয়টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে অভ্যস্ত নাঈম। আটটার মাঝেই সেরে ফেলেন রাতের খাবার। সেই তালিকায় রাখেন প্রোটিন, সবুজ আপেল ও ওটস। জীবনদর্শন সম্পর্কে তার ভাষ্য, ‘সফল হতে হলে আগে ব্যর্থ হতে হবে। যত বেশি ব্যর্থ হওয়া যায়, তত বেশি সফলতা উপভোগ করা সম্ভব। জীবনে যিনি ব্যর্থ হননি, তিনি আসলে সফলতার দরজা খুঁজে পাবেন না কখনো।’
‘সফলতাকে একটি চলমান প্রক্রিয়া মনে করি,’ যোগ করেন তিনি।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন