যাপনচিত্র I সুখের সন্ধান
জিয়াউর রহমান। জিয়া নামে অধিক খ্যাত রকস্টার। ‘শিরোনামহীন’-এর ফাউন্ডার, লিরিসিস্ট, কম্পোজার, বেজিস্ট ও ব্যান্ড লিডার। জানা যাক তার একান্ত জীবন
মিউজিকের জাদুকরী প্রভাবের সঙ্গে লিরিকের গভীরবোধী দ্যোতনা একাকার হয়ে থাকে ‘শিরোনামহীন’-এর গানে। এই রক ব্যান্ডের বেশির ভাগ গানই জিয়ার লেখা। লিরিকে তিনি মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করতে চান। প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে অঞ্জন দত্ত, কবীর সুমন, পিঙ্ক ফ্লয়েড, বব ডিলান, লিওনার্দ কোহেন, মহীনের ঘোড়াগুলির গানের কথা। সৃষ্টিশীলতায় নিজের ভালো লাগাকে দিয়েছেন প্রাধান্য। অভিজ্ঞতাকে কাব্যিকভাবে প্রকাশের প্রবণতা তার ভেতর সহজাত।
ব্যক্তি জিয়া ছোটবেলা থেকেই বইপোকা। সেবা প্রকাশনীর প্রায় সব বই, সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়সহ উল্লেখযোগ্য সব লেখকের অনেক বই তার ইতিমধ্যে পড়া হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের গান শোনা এবং নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে গিটার বাজানো শুরু করার পর উদ্বুদ্ধ হন গান তৈরিতে। গীতিকার ও কম্পোজার নিজে হওয়ায় এই দুটির সমন্বয় ঘটাতে বেগ পেতে হয়নি। এরপর শুরু সিনেমা দেখা। সিনেমায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লাইফস্টাইলের অনেক গল্প থাকায় নানা ধরনের জ্ঞান তিনি রপ্ত করতে থাকেন। তার মতে, সৃষ্টিশীল কাজে জ্ঞানের বিকল্প নেই। তবে গ্রামার ফলো করা বা শিখে কাজ করাটা গুরুত্বপূর্ণ হলেও অপরিহার্য মনে করেন না।
একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙে জিয়ার, ১০-১১টায়। ঘুম থেকে উঠে গরম পানিতে মিশিয়ে মধু ও মনাক্কা পান করেন। এই স্বাস্থ্যসচেতন রকস্টার সকালের নাশতায় পাতে রাখেন রুটি, ডিম অথবা একটি কেক। ব্যান্ডের দলনেতা হওয়ায় মিউজিকের পাশাপাশি করপোরেট, আয়োজক, বামবাসহ বিভিন্ন ধরনের মিটিং করতে হয়। বলে রাখি, জিয়ার টাইম ম্যানেজমেন্ট খুব ভালো। ঘুম থেকে ওঠার পর সিদ্ধান্ত নেওয়ার বদলে বরং চেষ্টা করেন দু-তিন দিন আগে থেকেই সবকিছুর শিডিউল ঠিক করে রাখার। ন্যূনতম এক দিন আগে ঠিক করে না রাখলে তিনি সেই কাজ করেন না, যদি না অত্যাবশ্যকীয় হয়। ‘আমার ডিসিপ্লিন লেভেল অনেকটা আর্মি লেভেলের,’ বললেন জিয়া।
রাজধানীর মিরপুরে স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে তার বসবাস। মেয়ে রেশ রহমান এ-লেভেলে অধ্যয়নরত। নিজেকে সম্পূর্ণ পরিবারকেন্দ্রিক মানুষ মনে করেন না জিয়া। ক্রিয়েটিভ মানুষ বলে বন্ধের দিনগুলোতে তাকে নানা জায়গায় পারফর্ম করতে হয়। তবে পরিবারকে যথেষ্ট সময় না দিতে পারলেও চেষ্টা করেন কোয়ালিটি টাইম দেওয়ার। নিজের পছন্দ সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী তিনি নন।
‘শিরোনামহীন’ লিডার দুপুরের খাওয়া সারেন দুইটা-আড়াইটার মধ্যে। এ বেলা পাতে রাখেন শাকসবজি; সঙ্গে প্রোটিন হিসেবে মাছ অথবা মাংস। ভাত পরিহারের প্রচেষ্টা রয়েছে তার পরিবারে। শিক্ষাজীবনে সেন্ট গ্রেগরি স্কুল, নটর ডেম কলেজ, বুয়েটে পড়ার ফলে সেই সার্কেলে যথেষ্ট বন্ধু রয়েছে তার। ফেসবুকের কল্যাণে সম্প্রতি খুঁজে পেয়েছেন ছোটবেলার এক বন্ধুকে। তবে গানের জগতের বন্ধুদের সঙ্গেই এখন সময় কাটে বেশি।
জিয়ার বাসার ইন্টেরিয়রে রয়েছে ক্ল্যাসিক ভিনটেজ ছোঁয়া। ফটোফ্রেম, মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট, বই আর সিনেমার সিডি-ডিভিডি দেখলে যেকেউ শিল্পীমনের পরশ পাবেন। পোশাকের ক্ষেত্রে তার পছন্দ শার্ট, টি-শার্ট ও জিনস। পছন্দের রং কালো ও বোটল গ্রিন। ইনস্ট্রুমেন্ট কালেকশনে ঝোঁক আছে। বেজের পাশাপাশি সারদ, ভায়োলিন, শেলো বাজাতে ভালোবাসেন। সোশ্যাল মিডিয়া পছন্দ না করলেও পাবলিক ফিগার হওয়ায় অনেকটা বাধ্য হয়ে তা ব্যবহার করেন।
ফ্যাশন ও স্টাইল প্রসঙ্গে জিয়ার মূল্যায়ন, ‘যারা রক জনরার গান করেন, তারা একধরনের লাইফস্টাইল ও ফ্যাশনের মধ্য দিয়ে যান, যা ভিন্ন অথচ ট্রেন্ডমেকার। রক আইকন বা রকস্টার বলতে আমরা যাদের বুঝি, তারা কিন্তু সমাজে বিভিন্ন ধরনের ফ্যাশন ও স্টাইল সেট করেছেন, করেন এবং করবেন।’ স্টাইল আইকন হিসেবে জেমসের কথা আলাদাভাবে বললেন। তার চোখে এই রকস্টারের রয়েছে একধরনের সুপার পাওয়ার, যা তিনি ধারণ করতে পারেন। এ ছাড়া ‘মাইলস’-এর হামিন আহমেদ, ‘ওয়ারফেজ’-এর কমল, ‘এলআরবি’র আইয়ুব বাচ্চু এবং ‘মাকসুদ ও ঢাকা’র মাকসুদ তার স্টাইল আইকন। এই বিবেচনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবচেয়ে প্রিয় ‘মেটালিকা’র ড্রামার লার্স উলরিক।
জিয়াউর রহমান বেশ ভ্রমণপিয়াসী। চষে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর নানা প্রান্ত। পছন্দের জায়গার মধ্যে প্যারিসের স্থাপত্য, পাতিসেরি এবং সেখানকার মানুষের শিল্পীমনের ছোঁয়া আলাদাভাবে তাকে টানে। তার চোখে এ যেন ‘অর্ধেক নগরী তুমি, অর্ধেক কল্পনা’। সেখানকার সদ্য নির্মিত বাড়িতে গ্রাফিতি আঁকার ব্যাপারটি মুগ্ধ করে তাকে। লুভরে গিয়ে দেখেছেন কিংবদন্তি আর্টিস্টদের বিশ্বখ্যাত পেইন্টিং। যতটা না দেখেছেন, তার চেয়ে বেশি অনুভব করেছেন। জিয়ার আরেকটি পছন্দের জায়গা চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগ। ব্যান্ড সদস্যদের সঙ্গে সেখানে কাটানো মুহূর্তগুলো উপভোগ করেছেন বেশ। স্থাপত্য বিষয়ে পড়ালেখা করায় একটি ব্যাপার জিয়া আলাদাভাবে খেয়াল করেন। প্রাগের মানুষদের আর্টিস্টিক মাইন্ড তাকে বেশ ভাবিয়েছে। শহরটির স্থাপত্যে হারকিউলিসসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক চরিত্রের প্রতিফলন করেছে মুগ্ধ। পাথুরে রাস্তায় হেঁটে বেড়ানো, ঐতিহাসিক চার্লস ব্রিজ দেখা, কাঠের নৌকায় ভ্রমণ, নৌকার মাঝির পরনের ড্রেস, শার্লক হোমসের মতো ড্রেস পরে ঘোড়ার গাড়ি চালানো লোকটি…প্রাগের এমন অসংখ্য চিত্র গেঁথে আছে তার মনে। নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামও মনে ধরেছে জিয়ার। অন্যদিকে, থাইল্যান্ডে অনেকবার গেলেও পাতায়া কিংবা ব্যাংকক তাকে খুব একটা টানেনি; বরং বেশি থেকেছেন বিভিন্ন দ্বীপে। ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোও তার ভালো লেগেছে।
বইপ্রেমী জিয়ার পছন্দের লেখকের তালিকায় সমরেশ-শীর্ষেন্দু ছাড়াও রয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদ, চার্লস ডিকেন্স, লুই স্টিভেনসন, আলেক্সঁদ্র দ্যুমা, জুলভার্ন, মার্ক টোয়েন প্রমুখ। গান শোনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে পছন্দের জনরা থ্র্যাশ মেটাল। এ ছাড়া সাইকেডেলিক ও ক্ল্যাসিক ব্লুজ বেশ পছন্দ। প্রিয় ব্যান্ড ‘অ্যানথ্রাক্স’, ‘সেপালচুরা’, ‘প্যানটেরা’, ‘স্লেয়ার’, ‘মেগাডেথ’, ‘মেটালিকা’ ও ‘আয়রন মেইডেন’। সিনেমায় বেশি ভালো লাগে রবার্ট ডি নিরো, মাইকেল ফ্যাসবেন্ডার, মারলন ব্র্যান্ডো, আল পাচিনো ও হিউ জ্যাকমেনের অভিনয়। পছন্দের সিনেমা ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’, ‘সিটি অব গড’, ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’ প্রভৃতি।
পছন্দের টিভি সিরিজ ‘স্কুইড গেম’ ও ‘মডার্ন ফ্যামিলি’। চলমান বিশ্বকাপে বরাবরের মতো সমর্থন ব্রাজিলের প্রতি। সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়াড় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। ভালো লাগে লিওনেল মেসি, ইডেন হ্যাজার্ড ও নেইমারের খেলাও।
জিয়া বলেন, ‘দিন শেষে সুখ খুঁজে পাওয়াই আমার জীবনের মূল উদ্দেশ্য। আমার কাছে সুখ মানে অনেক বেশি টাকা থাকা নয়, আবার অর্থকষ্টে ভোগাও নয়; বরং মাঝামাঝি একটি জায়গা রক্ষা করা।’ জ্ঞান আহরণের মাঝে সুখ খুঁজে পান তিনি, সেটা বই, সিনেমা, গান—যেকোনো মাধ্যমেই হোক। সেই সঙ্গে ভ্রমণকালে প্রকৃতির সান্নিধ্যেও খুঁজে পান সুখ।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: জিয়ার সৌজন্যে