স্বাদশেকড় I পিৎজা প্রসার
মুখরোচক এ খাবার থেকে জিভ সামলে রাখা ভার! কোথায় জন্ম এর? কীভাবে বিস্তার?
অনেকেই বলেন, কর্মব্যস্ত পৃথিবীতে রসবোধ প্রায় উঠে গেছে! কথাটা একেবারেই অমূলক নয়। ব্যস্ততার কারণে বিনোদনের জন্য কিছু করার সময়টুকু অনেকেই পান না। রুটিনমাফিক জীবন অতিবাহিত করতে করতে মানুষ যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, খোঁজে দুদণ্ড প্রশান্তি। এমন বিরস বদনের দিনে অথবা চলমান বিশ্বকাপের উত্তেজনায় আপনার মুখের স্বাদে প্রশান্তি এনে দিতে পারে পিৎজা। কিন্তু কোথায় উৎপত্তি এই সুস্বাদু খাবারের?
ইতিহাসবিদদের মতে, পিৎজা শব্দটি ইতালীয় ও গ্রিক সাহিত্য থেকে আসা। ইতালীয় এক ছোট্ট গ্রামে লেখা একটি লাতিন নথিতে এই শব্দের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে টপিংসসহ ফ্ল্যাট ব্রেডের ধারণাটি একেবারে নতুন ছিল না। কয়েক শতাব্দী আগে রোমান, গ্রিক ও মিসরীয়রা এভাবেই রুটি খেতেন। রুটি তৈরির জন্য তারা গরম পাথর বা মাটির চুলায় ফ্ল্যাট ব্রেড রাখতেন, তার ওপর টপিংস, যেমন ভেষজ বা মাশরুম ছড়িয়ে দিতেন। অন্যদিকে প্রাচীন পারস্যের সৈন্যরা মূলত ঢালকে চুলা হিসেবে ব্যবহার করে ফ্ল্যাট ব্রেড বেক করতেন!
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে একজন রোমান কবিকে পিৎজার মতো দেখতে রুটির ক্রমবিকাশ নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়। প্রাচীন রোমে লোকেরা গরম ছাইয়ে পিনসা রান্না করতেন; আর সেটিই আধুনিক দিনের পিৎজার সবচেয়ে নিকটতম রূপ। বহু বছর পরে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইতালির নেপলসকে পিৎজার জন্মস্থান হিসেবে বিবেচনা করা হতে থাকে। তবে সেই পিৎজা এখনকার মতো উপাদেয় ছিল না। তখনকার দিনে নেপলসের লোকেরা যে ধরনের পিৎজা খেতেন, সেটি ছিল টপিংসসহ একটি সাধারণ ফ্ল্যাট ব্রেড; কেননা, তা ছিল সস্তা। প্রশ্ন আসতেই পারে, কেন? কারণ, তারা বেশ গরিব ছিলেন; আর ওই ধরনের পিৎজা খাওয়ারই সামর্থ্য ছিল তাদের। ক্ষুধার্ত পেটে কাজে যেতে পারতেন না বলে ওই পিৎজাই ছিল ভরসা। সঙ্গে বাড়তি সুবিধা ছিল, এটির স্লাইস পথিমধ্যে চিবিয়ে খাওয়া যেত।
সেই সময়ে দোকানে গরিবদের জন্য কোনো খাবার বিক্রি হতো না। শুধু রাস্তার বিক্রেতারা ক্রেতার সামর্থ্য অনুযায়ী ছোট ছোট টুকরা করে এটি বিক্রি করতেন। গরিব ক্রেতার বাজেট অনুযায়ী প্রয়োজন মেটাতে প্রস্তুতকারীরা ন্যূনতম টপিং ব্যবহার করতেন; কখনো কখনো শুধু রসুনের সঙ্গে এক-দুটি সস্তা উপাদান যুক্ত করে।
এই ‘নিম্নমানের’ খাবার নিয়ে প্রথম দিকে কাউকে লিখতে তেমন আগ্রহী দেখা যায়নি। যারা কদাচিৎ লিখতেনও, এই খাবার সম্পর্কে তাদের বলার মতো কিছুই থাকত না, এবং ‘জঘন্য’র মতো শব্দ ব্যবহার করে এর বর্ণনা দিতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই ‘আধুনিক’ পিৎজার সঙ্গে ইতালীয়রা টমেটো জুড়ে দেওয়ার ফলে এর স্বাদ জনপ্রিয় হতে থাকে। মজার ব্যাপার হলো, তখনকার দিনে মানুষ টমেটোকে বিষাক্ত ভাবত; যদিও পরবর্তীকালে সেই ভ্রান্ত ধারণা কেটে যায়।
যাহোক, আমেরিকা ও ইউরোপে প্রচুর টমেটো রপ্তানি হতো। তা খাওয়ার পক্ষে নিরাপদ দেখে টপিং হিসেবে ব্যবহার করতে উৎসাহ দেওয়া হতো সেখানকার অধিবাসীদের। তা ছাড়া টমেটো দামে সস্তা হওয়ায় সবাই এটি ব্যবহার করতে শুরু করে; ফলে পিৎজা প্রস্তুতকারীদের খুব বেশি দক্ষতার প্রয়োজন হয়নি।
এত সব আলোচনার মাঝে প্রশ্ন আসতেই পারে, কে বা কারা পিৎজা আবিষ্কার করেছিল। চলুন, ঢুঁ মারি ইতিহাসে। ইতালি একটা দীর্ঘ সময় ধরে দুনিয়ার নানা প্রান্ত শাসন করেছে। এর ফলে সেখানে ছিল মিশ্র সংস্কৃতির উপস্থিতি। ১৮৮৯ সালে নেপলস সফরের সময় ইতালিয়ান রাজা প্রথম উমবার্তো [১৮৪৪—১৯০০] ও রানি মার্গেরিতা [১৮৫১—১৯২৬] একবার একটি ইতালীয় খাবার খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সেই সফরে রানি প্রথাগত ফরাসি খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে চেয়েছিলেন। তৎকালীন ইতালীয় শেফ রাফায়েল এস্পোসিতোই প্রথম সেই প্রিমিয়াম সুস্বাদু পিৎজা তৈরি করেছিলেন। অনেকে তাকে আধুনিক পিৎজার জনক হিসেবেও গণ্য করে। নিজের মালিকানাধীন সরাইখানা ‘পিৎজারিয়া দি পিয়েত্রো ই বাস্তা কসি’তে (সরল বাংলায়, ‘পিয়েত্রোর পিৎজা এবং এটুকুই যথেষ্ট!’) তিনি রন্ধনশিল্পের এই জাদু দেখিয়েছিলেন। সেবারের নেপলস সফরে রানিকে সম্মান জানাতে নেতারা রাফায়েলকে একটি সিগনেচার খাবার তৈরি করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তার ফল হিসেবেই রানি মার্গেরিতার খাবার মেনুতে বিভিন্ন ধরনের পিৎজা পরিবেশন করা হয়। ইতিহাসবিদদের ভাষ্য, জিভে পানি আনার মতো প্রতিটি স্লাইস নমুনাস্বরূপ খাওয়ার পরে রানি থাম্বস-আপ দিয়েছিলেন। সেখানে এমন একটি পিৎজাও ছিল, যার উপাদান ইতালীয় পতাকার রঙের মতো। সেই পিৎজাই সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছিল রানির। আর তার নামেই সেটির নামকরণ করা হয়।
এ ঘটনা পিৎজাকে সম্ভ্রান্ত মানুষের খাবার হিসেবে স্বীকৃতি এনে দেয়। তা ছাড়া, যে খাবার একসময় শুধুই দরিদ্রদের জন্য বিবেচিত ছিল, সেটি যদি রানি খেতে পারেন, একে অনায়াসে ক্ল্যাসিক ইতালীয় খাবারের তকমা দেওয়া যেতেই পারে। তাই রাতারাতি বাড়তে থাকে পিৎজার বিস্তার; আর ইতালীয়রা এটিকে তাদের নিজস্ব খাবার হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেন, আগে যেমনটি তারা বিবেচনা করতেন পাস্তার ক্ষেত্রে।
মজার ব্যাপার হলো, ১৮৩০ সালের আগ পর্যন্ত নেপলসে কোনো পিৎজারিয়া ছিল না। প্রথম পিৎজারিয়ার নাম অ্যানটিকা পিৎজারিয়া পোর্ট’আলব্যান। তখনো পিৎজার খ্যাতি বাকি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েনি; বরং এর ব্যবহার ইতালিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ওই দেশে আসা পর্যটকেরা স্থানীয় খাবারের কথা জিজ্ঞাসা না করা পর্যন্ত এর খ্যাতির যথেষ্ট অভাব ছিল। মূলত প্রস্তুতকারীরাই তাদের পিৎজা অফার করতেন। এভাবে এই ফাস্ট ফুড আরও এক ধাপ প্রসার পেয়েছিল। সে সময়ে অন্য সব পিৎজার চেয়ে পিৎজা মেরিনারা পর্যটকদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। এটি বানাতেন মূলত নাবিকদের স্ত্রীরা; তাতে টপিংস হিসেবে থাকত অরিগানো, রসুন ও টমেটো।
জনপ্রিয়তা যত বাড়তে থাকে, শেফরা বিভিন্ন ধরনের টপিংস নিয়ে তত নিরীক্ষা শুরু করেন, যেন পিৎজাকে আরও সুস্বাদু করে তোলা যায়। আর তাতে এটি দামি খাবারে পরিণত হতে থাকে। এককালের অবহেলিত এই খাবারের প্রতি উনিশ শতকের শেষ দিকে ইতালীয়দের ভালোবাসা এতই বেড়ে যায়, তারা এটিকে অপরিহার্য খাবার হিসেবে গণ্য করতে শুরু করেন। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও সৈন্যদের মাঝেও এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে কর্মরত সৈন্যরা বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার সময় মুখে-মুখে পিৎজার গুণাগুণ ও প্রশংসা ছড়িয়ে দিতে থাকেন। এর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকায়ও। সেখানকার ইতালীয় অভিবাসীরা তাদের নিজস্ব খাবার হিসেবে পিৎজাকে নিয়ে গর্ব করতেন। তাতে এটি খাওয়ার জন্য ভিড় জমতে থাকে পিৎজারিয়াগুলোতে।
এর আগেই অবশ্য ১৯০৫ সালে আমেরিকানরা প্রথম পিৎজারিয়ার দেখা পেয়েছিলেন জেনারো লোম্বার্দির সৌজন্যে। তিনি ছিলেন আমেরিকায় এই খাবার বেক করার লাইসেন্স পাওয়া প্রথম আমেরিকান। তবে যারা কাঠকয়লা-ভর্তি ড্রামে পিৎজা বিক্রি করে এটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন, তাদের অবদানও কম নয়।
রিক রিকার্ডো সিনিয়র অবশ্য ডিপ-ডিশ পিৎজার ব্যবসা শুরু করে লোম্বার্দির পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। তবে ইরা নেভিনই ১৯৪৫ সালে পিৎজা বেকারদের জন্য এ খাবার বানানোর প্রক্রিয়া সহজ করে তোলেন। তার আবিষ্কৃত গ্যাসচালিত পিৎজা ওভেন এটি উৎপাদনের খরচ কমানোর পাশাপাশি কাঠকয়লা ব্যবহারের অসুবিধা দূর করে।
এদিকে, পিৎজা রেস্তোরাঁর প্রিমিয়ার চেইন খোলার কারণে ১৯৫০-এর দশক এই খাবারের উন্নতির জন্য একটি ভালো সময় হিসেবে বিবেচিত হয়। এই যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৫৮ সালে, পিৎজা হাটের মাধ্যমে। পরের বছর লিটল সিজার এবং তারও পরের বছর ডোমিনোস (তখনকার নাম ডোমিনিকস) এই প্রতিযোগিতায় যোগ দেয়।
১৯৫০-এর দশকে পিৎজা নিয়ে মাতামাতির সময়ে কেউ একজন বুঝতে পেরেছিলেন, এর শেলফ লাইফ দীর্ঘায়িত করা দরকার। ফলে এটি হিমায়িত করা শুরু হয়। সুপারমার্কেটগুলো ক্রাস্ট নিয়ে রেখে, হিমায়িত পিৎজা মজুত করতে শুরু করে। সেই সময় অর্থনীতি মজবুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আয়ও বাড়তে থাকে। ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহারের জন্য বাসায় ফ্রিজ ও ফ্রিজার রাখার ধুম পড়ে যায়। তাই তারা বাসাতেই পিৎজা সংরক্ষণ করতে থাকেন। অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আরও কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং নতুন নতুন ফাস্ট ফুড আইটেম জনপ্রিয় হতে থাকে। প্রয়োজন মেটানোর স্বার্থে পিৎজাকে দীর্ঘক্ষণ সংরক্ষণে রাখার উপযোগী করতে বেকাররা তাজা টমেটোর পরিবর্তে টমেটো পেস্ট ব্যবহার শুরু করেন।
পিৎজার বিশ্বজয়ে শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদেরই নয়, অবদান রয়েছে জিমি ডুরান্টের মতো হলিউড তারকাদেরও, যাদের শিকড় ছিল ইতালিতে। তা ছাড়া গাড়ির ব্যবহার বাড়ার ফলে ভোজনরসিকদের বাড়িতে পিৎজা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হতে থাকে। ডোমিনোসের দ্রুত ডেলিভারি ব্যবস্থার ফলে ক্রেতাদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে তাদের পিৎজা।
আমেরিকাকে বলা হয় পিৎজার সেকেন্ড হোম। নতুন নতুন শহর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফাস্ট ফুডের প্রয়োজন বাড়তে থাকে সেখানে। বাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বেকাররা এর স্বাদে কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন। এই সময়েই শিকাগো স্টাইলের পিৎজা বাজারে আসে, যেটি ছিল গভীর, যার ক্রাস্ট ছিল পুরু। তারপর বাজারে আসে কলোরাডো রকি মাউন্টেন পাই। খাদ্যপ্রেমীরা এটি মধুর সঙ্গে উপভোগ করতেন।
আধুনিক পিৎজার জন্মস্থান হিসেবে নেপলসকে ২০০৯ সালে স্বীকৃতি দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সেখানে এক রায়ে বলা হয়, কেউ সত্যিকারের নিওপলিটান পিৎজা তৈরি করতে চাইলে তাকে অবশ্যই মূল মাস্টারপিস বজায় রাখতে হবে। এদিকে, ২০১২ সালে তৈরি করা একটি পিৎজা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পিৎজার স্বীকৃতি পেয়েছিল, যার আকার ছিল ১ হাজার ২৬০ বর্গমিটারের বেশি।
ইতালি থেকে প্রাচীন গ্রিস হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়া পিৎজা এখনো বেশির ভাগ ভোজনরসিকের জিভে পানি এনে দেওয়া মুখরোচক খাবার হয়ে রয়েছে।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট