পাতে পরিমিতি I শীত সামাল
হিমশীতল আবহাওয়া যেমন উপভোগ্য, তেমনি রয়েছে নানান রোগব্যাধির চোখরাঙানি। উইন্টারে ফ্লু প্রতিরোধ ও ডায়েট বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন নিশাত শারমিন নিশি
শীত মানেই ঠান্ডা-ঠান্ডা আনন্দ! তবে এই আনন্দ-অনুভূতি সহ্য হয় না অনেকের শরীরে। কেননা এ সময়ে হাঁপানিসহ নানা রকম হাঁচি-কাশি ও অ্যাজমার সমস্যা বেড়ে যায়; সঙ্গে নানা রকম এলার্জির অসুবিধাও। তাই শীতকে যারা আনন্দঘন করতে চান, এই ঋতু পুরোপুরি জেঁকে বসার আগেই তাদের নিতে হবে বাড়তি সতর্কতা।
রাখুন খেয়াল
যাদের নানা রকম শারীরিক কমপ্লিকেশন রয়েছে, বিশেষত যারা অ্যাজমা অথবা অ্যালার্জিটিক রাইনিটিসে ভোগেন, এবারের উইন্টার এনজয় করতে চাইলে অসুখ আক্রান্ত করার আগেভাগেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
যেহেতু আবহাওয়ায় তাপমাত্রার পরিবর্তন এসেছে, তাই খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রেও তা বিশেষভাবে খেয়াল রাখা চাই। তার মানে, অতিরিক্ত ঠান্ডা খাবার এই সময় না খাওয়াই ভালো।
কোন কোন খাবারে অ্যালার্জির সমস্যা বাড়ে, দেরি না করে এখনই খাদ্যতালিকা থেকে সেসব উপাদান বাদ দিন। অন্যথায় এসব খাবার গ্রহণের মাধ্যমে এই শীতে অ্যালার্জির সমস্যা থেকে অ্যাজমা বা হাঁপানি বাড়তে পারে।
সমাধান সূত্র
সারা বছর যারা একটু এলোমেলো খাদ্যাভ্যাস বা লাইফস্টাইলে থাকেন, তাদের এই শীতে সাবধান হওয়া জরুরি! কিছু কিছু উপাদান দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় রাখলে অ্যাজমা বা হাঁপানির সমস্যা এবং নানা রকম ফ্লু থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়া সম্ভব। চলুন, জানি এমন কিছু পুষ্টি উপাদানের কথা:
ভিটামিন সি: রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি শরীরে উৎপন্ন হওয়া ফ্রি র্যাডিক্যাল রিমুভ করতে ভিটামিন সি বেশ সাহায্য করে। সে ক্ষেত্রে খেতে পারেন মাল্টা স্লাইস, কমলা কিংবা নানা রকম ফ্রুটস জুস। এ ছাড়া লেবুর শরবত থেকেও পর্যাপ্ত ভিটামিন সি পাওয়া যায়। তবে প্যাকেটজাত জুস কিংবা বাইরে তৈরি খোলা শরবত বাদ দিয়ে, বাসায় তৈরি জুস বা শরবত গ্রহণ করাই স্বাস্থ্যসম্মত।
বিটা ক্যারোটিন: গাঢ় লাল, কমলা ও হলুদ রঙের সবজি ও ফল থেকে পেতে পারেন বিটা ক্যারোটিন। এটি একধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। উইন্টারে যাদের ড্রাই স্কিনের সমস্যা থাকে অথবা ত্বক খারাপ হওয়ার প্রবণতা বেশি, তাদের ক্ষেত্রে গাজরের সুপ, বিটরুটের জুস, লাল হলুদ মিক্সড স্যালাড হতে পারে বেস্ট চয়েস। এগুলো আপনার ত্বক ও চুল সুন্দর রাখার পাশাপাশি, ফুসফুসের প্রসারতা বাড়াতে সাহায্য করবে। তাই হাঁচি-কাশির সমস্যা যাদের বেশি, তাদের ক্ষেত্রে কষ্ট লাঘব অনেকটাই সম্ভব।
ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড: ডায়েট নিয়ে সচেতন কম-বেশি সবাই জানেন, স্যাচুরেটেড ফ্যাট শরীরের জন্য ক্ষতিকর। সে ক্ষেত্রে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড আপনার রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি গুড কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়াতেও সাহায্য করবে, যা হৃদ্পিণ্ডের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে যথেষ্ট কার্যকর। এ ছাড়া অ্যাজমাটিক সমস্যা নিরূপণেও বেশ হেল্পফুল। তাই খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন বিভিন্ন ধরনের মাছ, মাছের ডিম, বিভিন্ন ধরনের বাদাম অর্থাৎ মিক্সড নাট ইত্যাদি। তবে উইন্টারে যাদের বারবার রান্নাঘরে যেতে কষ্ট হয়, তারা কাঠবাদাম, পেস্তাবাদাম, কাজুবাদাম ও ওয়ালনাট মিক্সড করে, অল্প টক দই যোগে ঝটপট তৈরি করে নিতে পারেন বিকেল কিংবা মধ্য-সকালের নাশতা।
ফলে পরিচয়
যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা স্বাভাবিকের তুলনায় একটু কম, তাদেরই হাঁচি-কাশির সমস্যা কিংবা ফ্লু অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। সে ক্ষেত্রে দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন এই মেডিসিনাল ফুডগুলো:
তুলসী পাতা: এ এক দারুণ মেডিসিনাল ফুড। বলতে পারেন, একরকম ম্যাজিক্যাল লিফ। শীতে অনেকেরই গলা খুসখুসের প্রবণতা দেখা যায়। এ ছাড়া ছোট ছোট কাশি বা রাইনিটিস হওয়ার সমস্যা যাদের বেশি, তারা প্রতিদিন খেতে পারেন এক কাপ তুলসী টি। এ ছাড়া তৈরি করতে পারেন এই রেসিপি: ফ্রেশ ৬-৭টি তুলসী পাতা নিন। সামান্য বেটে বা পিষে একটু রস করে নিতে হবে। এরপর একটি কাপে তুলসী পাতার রস ও এক চা-চামচ মধু এক কাপ গরম পানিতে মিক্সড করে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে গ্রহণ করলে খুসখুসে কাশি ও হাঁপানির সমস্যা অনেকটাই নির্মূল হবে।
রসুন: রসুনে থাকে সেলিনিয়াম। এ এক পাওয়ারফুল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এই শীতে প্রতিদিন এক কোয়া রসুন আপনাকে হাঁচি-কাশি ও হাঁপানি রোধে সাহায্য করবে। সে ক্ষেত্রে বিকেলে এক বাটি গরম স্যুপ সিলেক্ট করতে পারেন, যাতে এক বা দুই কোয়া রসুন যোগ করলে রসুনের গুণাগুণ যেমন পাবেন, খেতেও সুস্বাদু লাগবে।
মধু: যারা ওজন কমাতে চান, তাদের কাছে গরম পানিতে মধুর মিশ্রণ যেন সবচেয়ে পছন্দের পানীয়। কিন্তু অনেকেরই ধারণা নেই, এই অসম্ভব মজার পানীয় প্রতিদিন সকালে গ্রহণ করলে রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও অনেকটাই বাড়ে। তা ছাড়া হাঁচি-কাশির সমস্যাও দূর হয়।
হলুদ: অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি ক্ষমতা থাকায় হলুদ বা টারমারিক পাউডার সেই আদি যুগ থেকেই পথ্য হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। সে ক্ষেত্রে এক কাপ গরম পানিতে আধা চা-চামচ টারমারিক পাউডার যোগ করে সপ্তাহে দু-তিন দিন গ্রহণ করতে পারেন। এটি উইন্টারে অকারণ যে গায়ে ব্যথা হওয়ার প্রবণতা থাকে, তা কমাতে সাহায্য করবে।
মন খারাপকে ছুটি
আমাদের দেশে অনেকেরই সারা বছর হাঁচি, কাশি, হাঁপানি প্রভৃতি সমস্যা লেগে থাকে। মূলত খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমেই এ ধরনের শারীরিক সমস্যাগুলো নির্মূল করা সম্ভব। সুস্থ থাকতে হলে ডিসিপ্লিনড লাইফ সব সময়ই আপনাকে সাহায্য করবে। মনে রাখা চাই, আমরা যা খাই তা আমাদের শরীরের ওপর প্রভাব ফেলে। মানসিক প্রভাবের গুরুত্বও কম নয়; বরং মন সুস্থ রাখতে হবে সবার আগে। কেননা মনের যত্ন না নিলে কোনো নিয়মই সঠিকভাবে মানা সম্ভব হয় না। তাই মন ভালো রাখার কিছু টিপস জানা যাক:
প্রতিদিন নিয়ম করে একটু হাসুন এবং হালকা অ্যারোবিক করুন।
খাদ্যতালিকাকে একটু ব্যালান্স করে নিন। তার মানে, দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় কার্বোহাইড্রেট প্রোটিন ফ্যাটের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণ মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট রাখুন।
পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি ও তরল খাবার গ্রহণ করুন। উষ্ণ গরম পানি, ‘র’ চা, বিভিন্ন ধরনের স্যুপ খেতে পারেন।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুন। কেননা ধুলোবালি ও জীবাণু থেকেও হাঁচি-কাশির সমস্যা বাড়তে পারে।
শীতকালে যেহেতু প্রচুর শাকসবজির সমারোহ থাকে, তাই কালারফুল খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। তার মানে, নানা রঙের শাকসবজি ও ফলমূল যেন আপনার দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় জায়গা পায়, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
সুন্দর ও সঠিকভাবে জীবনযাপনের জন্য সব সময় একটু নিয়মমাফিক চলা চাই। শীতের মৌসুমে তা হয়তো একটু বেশি মাত্রাতেই। তাই খেয়াল রাখুন নিজের।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ছবি: ইন্টারনেট