স্বাদশেকড় I কাবাব কাণ্ড
অপূর্ব ঘ্রাণ। তুলনাহীন স্বাদ। কাবাবের জয়-জয়কার ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র
কাবাব মানেই মসলার সমাহার! আর তা পরিমাণে যথেষ্ট বেশি থাকাটা মূলত উপমহাদেশীয় ঐতিহ্যের কারণে। শামি থেকে শিক পর্যন্ত, ভারতীয় উপমহাদেশে আবিষ্কৃত বিভিন্ন ধরনের কাবাব নিত্যই তৃপ্তি মেটাচ্ছে ভোজনরসিকদের। আরও আছে হরিয়ালি, পনির টিক্কা, দই কাবাবের মতো নিরামিষ কাবাব, যেগুলোর উৎপত্তিও এই অঞ্চলে। বেশি ভাজা না হওয়ায় কাবাব এখন বিশ্বজুড়ে বেশ স্বাস্থ্যকর ফাস্ট ফুড হিসেবে বিবেচিত। মুখরোচক এই খাবারের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। এশিয়ান ও আফ্রিকান- উভয় রন্ধনপ্রণালিতে এর গল্প ঘুরেফিরে এসেছে।
‘কাবাব’ শব্দের অর্থ ‘ভাজা’; তবে মসলামিশ্রিত মাংসের প্যাটি হিসেবেও বিভিন্ন জায়গায় এর উল্লেখ আছে। বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশের খাবার সারা বিশ্বে নিজস্ব সুপরিচিতি ও ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি করেছে। এই খাদ্য বিপণনে কাবাবের রয়েছে বিরাট ভূমিকা। মোগলদের নাম ভাঙিয়ে ভারতীয়রা কাবাবের উৎপত্তিস্থলকে প্রায় নিজেদের বানিয়ে ফেলেছেন এবং অনেকেই তা বিশ^াস করেন। কিন্তু ইতিহাসবিদদের মত ভিন্ন। কাবাবের উৎপত্তিস্থল কোনোভাবেই এই উপমহাদেশ নয়। এদিকে, উপমহাদেশের বাইরের বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, এর উৎপত্তিস্থল তুরস্কে। আসলেই কি তাই?
ইতিহাস বলে, সুদূর অতীতে যুদ্ধের সময় সৈন্যরা শিকার করা প্রাণীর মাংস টুকরো টুকরো করে শুকনো মসলা যোগ করতেন, তারপর খোলা মাঠে আগুনে তরবারির ওপর তরবারি তির্যকভাবে রেখে বিশেষ ধরনের খাদ্য বানাতেন, যা তাদের শরীরে তাৎক্ষণিক শক্তি দিত; সেই সঙ্গে এটি ছিল যুদ্ধকালে সৈন্যদের স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী। তুরস্ককে কাবাবের জন্মভূমি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ নিয়ে কারও কারও দ্বিধা থাকলেও, কাবাব প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যের কোথাও যে পরিবেশন করা হয়েছিল, তা একরকম নিশ্চিত। কাবাব শব্দটি আরবি ‘কাবব’ থেকে এসেছে, যার অর্থ পোড়ানো।
আসুন, এবার সুনির্দিষ্ট ইতিহাসে ঢুঁ মারি। এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপ মিশেছে তুরস্কে। ভৌগোলিকভাবে প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট ওই অঞ্চলে নানা ধরনের মসলাগাছের ব্যবহার ছিল। তুরস্কে খুঁজে পাওয়া ‘কাইসা-ই-ইউসুফ’ নামক এক প্রাচীন লিপিতে ১৩৭৭ সালে প্রথম কাবাবের কথা শুনতে পাওয়া যায়। সময় বাঁচাতে সদ্য শিকার করা পশুর মাংস তরবারির ডগায় ঢুকিয়ে আগুনে পুড়িয়ে খাওয়ার চল তুর্কি সৈন্যরাই প্রথম চালু করেন, এ ব্যাপারে বেশির ভাগ ইতিহাসবিদই একমত। আরও জানা যায়, দ্বাদশ শতাব্দীতে তুরস্কের এরজুরুম প্রদেশে প্রথমবারের মতো কাবাবের স্বাদ নেওয়া হয়েছিল। তখনকার কাবাবে সাধারণত বেশি করে ভেজে শুকনো মসলা মিশিয়ে ভালো করে রান্না করা হতো এটি। যদিও এই রেসিপি পরে আরও অনেক উপায়ে প্রয়োগ করা হয়। পরে কাবাব নামে ভারতীয় উপমহাদেশের রান্নাঘরে পৌঁছে যায়।
তুর্কি কাবাব আধুনিক কাবাবের আদি রূপ। তবে সম্প্রতি গ্রিসের সান্তোরিনি অঞ্চলের আক্রোতিরিতে খননকাজ চালানোর সময় খ্রিস্টপূর্ব সপ্তদশ শতাব্দীর একধরনের সমান্তরাল দুই পায়াবিশিষ্ট একটি চুলা আবিষ্কৃত হয়েছে, যার সঙ্গে বর্তমান কাবাব বানানোর কয়লার চুলার মিল প্রায় শতভাগ। সেই হিসাবে কাবাবের জন্মস্থান নিয়ে দ্বিধায় পড়তে হয়। সন্দেহটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রাচীন গ্রিক মহাকবি হোমার। বিখ্যাত কাব্য ইলিয়াডে কয়েক টুকরো ঝলসানো মাংসপি-ের উল্লেখ করেছেন তিনি। তাই বলা চলে, কাবাবের বর্তমানের রূপ এক কালে আসেনি। কালের আবর্তনে মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে বিবর্তন ঘটেছে এ খাবারেরও।
এবার চলুন, অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়কার তুরস্কের বুরসা শহরে যাওয়া যাক! দেশটির আনাতোলিয়ার অঞ্চলের অন্যতম বড় শহর এটি। আনাতোলিয়াকে বলা হয় কাবাবের রাজ্য। এখানকার বুরসা শহরে ইস্কান্দার এফেন্দি নামের এক ভোজনরসিক ছিলেন, যিনি পোড়ানো মাংসের একটি চমৎকার রেসিপি আবিষ্কার করেন। অন্যদিকে, উনিশ শতকের শেষ দিকে তুর্কি রেস্টুরেন্টার কাদির নুরমানের হাত ধরে ডোনার কাবাব ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানি ও ইংল্যান্ডে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এবার ফেরা যাক ভারতীয় উপমহাদেশে কাবাব বিবর্তনের ইতিহাসে। মোগলাই প্রস্তুতির শিল্প ও পরিশীলন বহু শতাব্দী ধরে খাদ্যপ্রেমীদের দারুণ আকর্ষণ করেছে। এই উপমহাদেশে পঞ্চদশ শতাব্দীতে সম্রাট বাবর মোগল শাসনের গোড়াপত্তন করেন। প্রচলিত বিশ^াস অনুসারে, দ্বাদশ শতাব্দীর শুরুর ভাগে মঙ্গোলীয় শাসক চেঙ্গিস খানের সৈন্যরা যখন যুদ্ধে যেতেন, খাওয়ার জন্য মাংস, পেঁয়াজ, ময়দা, চাল ও ময়দাযুক্ত মসলা সঙ্গে দিতেন তাদের স্ত্রীরা। সৈন্যরা আগুনের ওপর তরবারিতে গাঁথা মাংসের টুকরো গ্রিল করতেন এবং তা মসলা মিশিয়ে খেতেন। তুর্কি সভ্যতাও তরবারির ডগায় মাংস ভাজার রীতি গ্রহণ করেছিল। সেই সূত্রে ভারতীয় উপমহাদেশে উপাদেয় খাবার শিক কাবাবের জন্ম ঘটে বলে প্রচলিত রয়েছে। মরক্কোর বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা [১৩০৪-১৩৬৯] উল্লেখ করেছেন, কাবাব ছিল দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজদরবারে দৈনন্দিন খাদ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আফগান লুণ্ঠনকারী ও হানাদাররা মোগলদের প্রবেশের অনেক আগেই এটি ভারতীয় উপমহাদেশে নিয়ে এসেছিল। উপমহাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জীবনাচারও প্রচলিত বিভিন্ন খাবারের ওপর প্রভাব ফেলেছে। ফলে একটা সময় যখন ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্যের বিকাশ ঘটে, তা একদিকে যেমন সমাজব্যবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন আনে, তেমনি প্রচলিত খাবার ব্যবস্থায়ও ফেলে প্রভাব। মাংস গেঁথে আগুনে পুড়িয়ে খাওয়ার এই রেওয়াজ পরবর্তীকালে মোগলদের হাতে পড়ে রীতিমতো শিল্পে পরিণত হয়।
ইতিহাস বলে, মোগলেরা মাংসের কিমা পছন্দ করতেন। কিন্তু ইবনে বতুতার মতে, ভারতীয় উপমহাদেশে মোগল শাসন শুরুর আগে থেকেই এখানকার রান্নাঘরে কাবাবের অস্তিত্ব ছিল। মোগল আমলে রাজকীয় রান্নাঘরের দায়িত্ব ছিল খানসামার হাতে। সেখানে ছিল তুর্কি, ইরানি ও আফগান খানসামাদের প্রাধান্য। মোগলদের অনেক সুস্বাদু খাবারের প্রভাব পড়েছিল উপমহাদেশীয় খাবারে, বিশেষত রাজপুতদের ওপর।
ঐতিহাসিকদের মতে, ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে মোগল শাসক আওরঙ্গজেব গোলকুন্ডা দুর্গ আক্রমণ করেন, যা বর্তমানে ভারতের হায়দরাবাদে অবস্থিত। নানা কারণে সেই দুর্গ জয় করা আওরঙ্গজেবের পক্ষে সহজ ছিল না। তবে ৯ মাসের দীর্ঘ লড়াইয়ে মোগল সৈন্যরা এর দখল নিতে পেরেছিল। আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনীর বিজয় উদ্যাপন একই দুর্গে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সৈন্যদের পরিবেশন করা হয়েছিল শামি কাবাব।
গোলকুন্ডা দুর্গের যুদ্ধের সময়, মোগল সৈন্যরা হায়দরাবাদে সহজলভ্য গ্রানাইট পাথর ব্যবহার করে মাংস রান্নার একটি নতুন শৈলী আবিষ্কার করেছিলেন। গ্রানাইট সহজেই ৪৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা পর্যন্ত তাপ প্রতিরোধী, এমনকি ১২০০ ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে সক্ষম। ফলে এই পাথরগুলো ব্যবহার করে মাংস ভাজা সৈন্যদের জন্য ছিল সহজ। কথিত আছে, এতে তারা দুটি সুবিধা পেতেন। প্রথমত, পাথরে মাংস আটকে পাথরের উত্তাপ কমানো যেত এবং দ্বিতীয়ত, এর ফলে সৈন্যরা উত্তাপ থেকে কিছুটা স্বস্তি পেতেন। আজও হায়দরাবাদে এই স্টাইলে কাবাব তৈরি করা হয়, যা ‘পাথর কাবাব’ নামে খ্যাত।
‘তুন্ডে কে কাবাব’ নামক বিশ্বখ্যাত কাবাবের নেপথ্য গল্প জানেন? সপ্তদশ শতাব্দীতে মোগল সাম্রাজ্যের আওধ রাজ্যে এর উৎপত্তি। সে সময় স্বাদের সঙ্গে আপন না করে নরম কাবাব তৈরির জন্য খানসামাদের মধ্যে এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। গলৌটি কাবাবের উদ্ভাবন ছিল এর ফল। হাজি মুরাদ আলীর তুন্ডের রেসিপি ছিল প্রত্যাশার সবচেয়ে কাছের রূপ। তুন্ডে কে কাবাবের জন্য লখনউ বেশ বিখ্যাত। ১৬০টির বেশি রকমের মসলা দিয়ে এটি বানানো হয়। এই কাবাবের নামের পেছনেও রয়েছে মজার গল্প। কথিত আছে, হাজি মুরাদ আলী শাহি গলৌটি কাবাবের মিশ্রণ নিখুঁত করার সময় ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙেছিলেন, যা শেষ পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়। এক হাত নিয়ে কাজ করার পরও, রান্নার প্রতি তার আবেগ বিন্দুমাত্র কমেনি। তিনি এমন লোকদের নিয়োগ করেছিলেন, যারা মাংসকে এত মিহি করে তুলতে পারতেন, যাতে কাবাব মুখে দিতেই গলে যাবে। কাবাবগুলো ‘দম’ (ওভেনে বেকড) স্টাইলে ঘি দিয়ে বানানো হতো। আওধের তৎকালীন ও সর্বশেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের সামনে উপস্থাপন করা হলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে তুন্ডে কে কাবাবকে রাজকীয় মর্যাদা ও পৃষ্ঠপোষকতা দেন। বলে রাখা ভালো, পান খাওয়ার বদ-অভ্যাস থাকায় ওই নবাবের দাঁত নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ফলে কাবার চিবোতে পারতেন না। তাকে কাবাবের স্বাদ নেওয়ার দারুণ সুযোগ এনে দেয় অতি মিহি তুন্ডে কে কাবাব।
সমকালীন রুচির সঙ্গে ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটিয়ে, কালের পরিক্রমায় আজ বিশ্বজুড়ে বহু ভোজনরসিকের প্রিয় খাদ্য হয়ে আছে কাবাব।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট