skip to Main Content

ফিচার I উদ্ভট উপাদান

খাবারের স্বাদ বাড়াতে কিংবা গঠন ঠিক রাখতে এমন কিছু উপাদান ব্যবহার প্রয়োজন, যেগুলোর বিষয়ে জানলে সাধারণত ভোজনরসিকদের চোখ কপালে উঠতে পারে। তবে বিকল্প উৎস না থাকায় মানুষ এসব উপাদানই খাবারে ব্যবহার করে থাকেন

যুগের পর যুগ ধরে চলেছে খাবার সুস্বাদু করার প্রক্রিয়া। এ জন্য মেশাতে হয়েছে নানা উপাদান, যেগুলোর কোনোটি এসেছে উদ্ভিদ, আবার কোনোটি প্রাণী থেকে। এমন কিছু উপাদান রয়েছে, খাবারে সেসব মেশানোর কথা সাধারণত মানুষ কল্পনাও করেন না।
খাবারে মল কিংবা আলকাতরা মেশানোর কথা কেউ কখনো ভাবে? অথচ কিছু খাদ্যে এগুলো মেশাতেই হয়! যেমন কিছু খাবারকে অভিজাত করে তুলতে তাতে ব্যবহার করা হয় সোনা। এমনকি সোনা মিশ্রিত পানিও মেলে। পোল্যান্ড ও জার্মানির এক ধরনের ওয়াইনে সোনার পাতলা ও ভোজ্য পাত টুকরা করে কেটে মেশানো হয়। তা ছাড়া কিউভি, ভদকা ইত্যাদি মদেও সোনা মেশানো হয়। ভোজ্য সোনা শরীরে কোনো ক্ষতি করে না। খুব স্বাভাবিকভাবেই তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এবং সাধারণ পদ্ধতিতেই বেরিয়ে যায়। অবশ্যই সোনা মেশানো খাবারগুলো সাধারণত বেশ দামি হয়ে থাকে।
খাবারে ভেনিলা ও র‌্যাস্পবেরির মতো ফ্লেভার পেতে বিভার নামের এক প্রাণীর পায়ুনিঃসৃত তরল ও মূত্রের মিশ্রণে তৈরি ক্যাস্টোরিয়াম ব্যবহার করা হয়। এ ফ্লেভার সুগন্ধ বাড়ানোর পাশাপাশি খাবারকে করে তোলে সুস্বাদু। কিছু চুইংগাম ও সিগারেট তৈরিতে এই উপাদান ব্যবহৃত হয়। বলে রাখা ভালো, বিভারের পায়ুর কাছাকাছি ‘ক্যাস্টর স্যাক অ্যান্ড গ্ল্যান্ড’ থাকে। সেটি থেকেই নিঃসৃত হয় ক্যাস্টোরিয়াম। টি কৃত্রিম উপায়ে তৈরি সম্ভব হয়নি এখনো। তাই কিছু খাবারে এ ধরনের ফ্লেভার আনতে বিভারের ওপর নির্ভর করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) একে প্রাকৃতিক ফ্লেভার হিসেবে গণ্য করেছে। বিভিন্ন ক্যান্ডি, গাম, পুডিং ও জেলাটিনে বিভার থেকে প্রাপ্ত এই উপাদান মেশানো হয়।
খাবারে ব্যবহৃত হয় আলকাতরাও। কয়লাকে কোল গ্যাস কিংবা কোকে রূপান্তর করার সময় পাওয়া আলকাতরা থেকে তৈরি হয় ‘অ্যালোরা এসি’ নামের একধরনের উপাদান, যা খাবারে মেশানো হয়। এটি বিষাক্ত নয়, তবে এটি যুক্ত করে তৈরি খাবার খেয়ে কারো কারো বমিভাব ও কিছু সাধারণ সমস্যা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবু একে খাদ্য ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সাধারণত কিছু ক্যান্ডি ও কোমল পানীয় তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়।
ক্যান্ডির ওপরে দেওয়া হয় শেল্যাক নামের একটি উপাদান। এটি ক্যান্ডিকে চকচকে করে তোলে। একে ক্যান্ডি গ্লেজ কিংবা কনফেকশনার্স গ্লেস হিসেবেও চেনেন অনেকে। শেল্যাক মূলত ‘ল্যাক বিটল’ থেকে নিঃসৃত একধরনের পদার্থ। সাধারণত ‘ল্যাসিফার ল্যাক্কা’ কিংবা ‘ক্যারিয়া ল্যাক্কা’ জাতীয় বিটল থেকে শেল্যাক পাওয়া যায়। থাইল্যান্ড ও ভারতের বনগুলোতে এ ধরনের পোকা মেলে। কিছু শক্ত আবরণের ক্যান্ডি, ক্যান্ডি কর্ন ও জেলি বিনে শেল্যাক মেশানো হয়।
খাবার আকর্ষণীয় করে তুলতে বিভিন্ন রং ব্যবহৃত হয়। এসব রঙের কিছু কৃত্রিম, কয়েকটি উদ্ভিজ্জ, কতগুলো আবার প্রাণিজ উৎস থেকে আসে। প্রাণী থেকে পাওয়া যায় ককিনিল ও কারমিন নামে দুটি লাল রং, যা খাওয়ার উপযোগী। এ দুটি উপাদান আসে এক প্রকার পোকা থেকে। এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে ককিনিল রং হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সাধারণত কিছু দই, আইসক্রিম ও মিষ্টিতে ককিনিল মেশানো হয়। তা ছাড়া ফলের তৈরি খাবার ও জুসে তা ব্যবহৃত হয়।
কিছু খাবারে মেশানো হয় সেলুলোজ। কাঠ ও তুলা থেকে প্রাপ্ত সেলুলোজ ব্যবহৃত হয় ক্রাফট পারমেসিয়ান চিজে। তা ছাড়া লো-ফ্যাট আইসক্রিম ঘন করতেও তা ব্যবহৃত হয়। এতে আইসক্রিম বেশ ক্রিমি হয়।
বেকড খাবারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত উপাদান হলো এল-সিস্টিন। এটি এক প্রকার অ্যামিনো অ্যাসিড, যা খাবারে স্থিতিস্থাপকতা এনে দেয়। তা ছাড়া খামির নরম করে। ডোনাট, ব্যাগেল, রুটি, কুজিকসহ কিছু খাবারে মেশানো হয় উপাদানটি। বেশি প্রয়োজন হওয়ায় মানুষ এল-সিস্টিনের সহজ উৎস খুঁজে বের করেছে। তা পাওয়া যায় মানুষের চুলে। চুলে থাকা বিশেষ রাসায়নিককে প্রক্রিয়া করে তৈরি করা হয় এল-সিস্টিন। এ ধরনের প্রযুক্তি রয়েছে চীনে। সে দেশের মানুষের চুল থেকে পাওয়া এল-সিস্টিন মেশানো হয় সসে। মানুষের চুল ছাড়াও তা পাওয়া যায় হাঁসের পালকে। পালক থেকে পাওয়া এল-সিস্টিন ওয়ার্ম সিনামন রোল ও বেকড হট অ্যাপল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
খাদ্য তৈরির আরেকটি উপাদান হলো স্ক্যাটোল। শব্দটি গ্রিক ‘স্ক্যাট’ থেকে এসেছে, যার বাংলা অর্থ মল তথা বিষ্ঠা। স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিষ্ঠা থেকে মেলে এই উপাদান। নানান সুগন্ধি তৈরির পাশাপাশি তা মেশানো হয় সিগারেট ও স্ট্রবেরি আইসক্রিমে।
খাবারের ঘনত্ব বাড়াতে সামুদ্রিক আগাছা থেকে প্রাপ্ত এক প্রকার জেল ব্যবহার করা হয়। কারাগিন্যান নামের বিশেষ আগাছা থেকে পাওয়া যায় এই জেল। কটেজ চিজ ও আইসক্রিম তৈরিতে এ ধরনের জেল কাজে লাগে। তা ছাড়া দুধ ও চকোলেটের মিশ্রণে তৈরি খাবারে দুধ যেন চকোলেট থেকে আলাদা হয়ে না যেতে পারে, তাই এই জেল মেশানো হয়। মানে চকোলেট মিল্কে এ ধরনের জেল থাকে।
নানা ধরনের খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয় জেলাটিন। এর অন্যতম উৎস হলো কোলাজেন প্রোটিন, যা পাওয়া যায় প্রাণীর চামড়া, হাড় ও কানেকটিভ টিস্যুতে। বর্তমান বিশ্বের কিছু স্থানে জেলাটিন তৈরিতে ৫০ শতাংশ শূকরের চামড়া এবং ২৫ শতাংশ গরুর হাড় ফোটানো হয় বলে জানা গেছে। এ ধরনের জেলাটিন কিছু দই, শাওয়ার ক্রিম, ক্যান্ডি ও ফ্রস্টেড সিরিয়াল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
খাবারে ব্যবহৃত আরও কিছু উপাদান আসে প্রাণিজ উৎস থেকে। যেমন ভেড়ার লোম থেকে পাওয়া যায় তেলতেলে ল্যানোলিন। এটি চুইংগাম নরম করতে দরকার পরে। তা ছাড়া ষাঁড়ের পিত্ত থেকে পাওয়া ‘টরিন’ কিছু এনার্জি ড্রিংক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
মার্কিনরা কিছু খাবারে ব্যবহার করে ভাইরাস। যেমন ‘রেডি টু ইট’ মাংসজাত খাদ্যে প্রায় ছয় ধরনের ভাইরাস যুক্ত করার প্রয়োজন পড়ে।
এসব ছাড়াও বিয়ারে আইসিং গ্লাস নামের একধরনের জেলাটিনের মতো পদার্থ ব্যবহার করা হয়, যা তৈরি হয় মাছের বায়ুথলি থেকে। এমনকি মুরগির ওজন এবং এর মাংসের স্বাদ বাড়াতে লবণপানির ইনজেকশন দেওয়া হয়।
খাবারে এসব উপাদান ব্যবহারের কথা শুনে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। সব ধরনের খাবারে এসব উপাদান ব্যবহার করা হয় না, বরং নির্দিষ্ট কিছু খাদ্য তৈরিতে কয়েকটি দেশে এগুলো কাজে লাগে। খাবারে মেশানোও হয় সহনীয় পরিমাণে, যাতে তা মানুষের শরীরে কোনো ক্ষতি না করে। তা ছাড়া বিশ্বের খাদ্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোও এসব উপাদান ব্যবহারের পরিমাণ ও নিয়ম-কানুন বেঁধে দিয়েছে। গবেষকেরা যথাযথ গবেষণার পর খাবারে এসব উপাদান নির্দিষ্ট পরিমাণে মেশানোর অনুমতি দিয়েছেন।

 আহমেদ সজিব
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top