দেহযতন I জুম…বোম…জুম্বা
নাচের তালে এক্সারসাইজ? আইডিয়া নতুন হলেও দারুণ কাজের!
জুম্বা। ফিটনেস ও নাচের জগতে সর্বশেষ সংযোজন। এটি এমন এক অ্যারোবিক ড্যান্স, যা আমেরিকান ও লাতিন শৈলীর হিপ-হপ ও সালসার মতো কিছু ড্যান্সের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত। এক জরিপে দেখা যায়, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ১৮০টি দেশে জুম্বা নাচের ক্লাস রয়েছে দুই লক্ষাধিক।
জুম্বা শব্দটি স্প্যানিশ; আভিধানিক অর্থ দ্রুতগতির মুভমেন্ট। কলম্বিয়ান নৃত্যশিল্পী আলবার্তো বেতো পেরেজ এ নাচের ধারণা প্রবর্তন করেন। নিজ দেশে নব্বইয়ের দশকে ক্লাসের কার্যক্রম শুরু করেন তিনি। আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে নাচের ক্লাস প্রতিষ্ঠা করেন ২০০১ সালে। শুরু থেকেই জুম্বা নাচের ক্লাসগুলো ফিটনেস প্রোগ্রামের মাধ্যমে দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশেও। তাতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছেন অত্যাধুনিক ওয়ার্কআউট প্রোগ্রাম ‘জুম্বা’র লাইসেন্সধারী ফিটনেস ইনস্ট্রাক্টর সুমাইয়া চৌধুরী কৃতিকা। তিনি বলেন, ‘২০১৮-১৯ সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রে পড়া অবস্থায় আমি জুম্বা প্র্যাকটিস শুরু করি। শুরুতে পারদর্শিতা দেখে একজন ট্রেইনার আমাকে অনুপ্রেরণা দেন। ব্যাপারটি আমার চিন্তার জগতে নাড়া দেয় এবং আমি জুম্বা নিয়ে গবেষণা করতে থাকি। ২০২২ সালে লাইসেন্স পাওয়ার পর দেশে সম্পূর্ণভাবে জুম্বা নিয়ে কাজ শুরু করেছি।’
‘বিশ্বব্যাপী জুম্বার আবেদন প্রধানত নারীদের কাছে বেশি হলেও আমাদের দেশে এর প্রেক্ষাপট ভিন্ন; নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ প্রায় সমান,’ বলেন তিনি। নানা ধরনের জুম্বা ড্যান্সের মধ্যে কয়েকটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন কৃতিকা। চলুন, জানা যাক:
অ্যাকোয়া জুম্বা: যাদের শরীরের নিম্নাংশে আঘাত রয়েছে, কিন্তু কম পরিশ্রম হয়—এমন ব্যায়াম করতে চান, তাদের জন্য এটি উপযুক্ত। অ্যাকোয়া জুম্বা লাতিন নাচের উন্মাদনাকে বাড়িয়ে দেয়।
জুম্বা গোল্ড: স্ট্যান্ডার্ড জুম্বা ক্লাসের এই পরিবর্তিত সংস্করণটি বয়স্ক মানুষদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। যারা ঐতিহ্যবাহী হাস্যরসাত্মক মিউজিক ও ফ্লেয়ার চান, কিন্তু কম তীব্রতায় পারফর্ম করতে আগ্রহী, তাদের জন্য পারফেক্ট।
জুম্বা কিডস: ৭ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে এই প্রোগ্রাম। জুম্বা কিডস ঐতিহ্যগত জুম্বার ধরনকে ভেঙে দিয়ে নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে। মূলত বাচ্চাদের ঘাম ঝরানোর বিষয়ে এখানে মনোযোগ দেওয়া হয় এবং তাদেরকে আগ্রহী রাখতে ক্লাসে গেম ও নানা ধরনের অ্যাকটিভিটি যোগ করা হয়।
জুম্বা কিডস জুনিয়র: এখানে সবকিছু জুম্বা কিডসের মতোই, তবে এটি ৪ থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুদের জন্য। এই বয়সী শিশুদের ব্যস্ত রাখতে অনেকটা ড্যান্স পার্টির আবহ তৈরি করা হয়।
জুম্বা স্টেপ: এটি লাতিন-অনুপ্রাণিত নাচের কোরিওগ্রাফ। মূলত ওয়ার্কআউটের তীব্রতা বাড়ানোর জন্য অ্যারোবিক স্টেপ যোগ করা হয়। এতে উচ্চতর পৃষ্ঠ বরাবর পা রাখার কারণে পায়ের মাংসপেশি শক্তিশালী হয়।
জুম্বিনি: সপ্তাহে একবার ৪৫ মিনিটের ক্লাসটি শূন্য থেকে ৩ বছর বয়সী শিশুদের জন্য। ছোট বাচ্চা ও তাদের বেবিকেয়ারে নিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এখানে ঘটে মিউজিকের বন্ধন। বাচ্চারা তাদের বয়স-উপযোগী খেলায় অংশ নেয়। চিন্তাশীলতা বাড়াতে কম ওয়ার্কআউট এবং বেশি শেখার প্রবণতা এর মূল উদ্দেশ্য।
স্ট্রং বাই জুম্বা: উচ্চ-তীব্র ফিজিক্যাল ওয়ার্কআউট এটি, যার সঙ্গে ড্যান্স মুভ করা হয় মিউজিকের তালে। এই রুটিনের প্রধান উপাদান পুশআপ, স্কোয়াট, বারপিস এবং লাঞ্জ।
জুম্বা টোনিং: হালকা ওয়েটের জুম্বা টোনিং স্টিকস ব্যবহার করে পরিচিত জুম্বা ড্যান্স পরিচালনা করা হয় এ ক্ষেত্রে।
জুম্বা গোল্ড-টোনিং: জুম্বা টোনিংয়ের মতোই, তবে বয়স্কদের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যেখানে পরিশ্রমের মাত্রা কিছুটা কম।
জুম্বা ইন দ্য সার্কিট: কার্ডিওভাসকুলার ফিটনেস এবং পেশিশক্তি উন্নত করার উদ্দেশ্যে পুরো শরীরের ওয়ার্কআউটের জন্য এই জুম্বা নাচের বিকল্প নেই বললেই চলে!
জুম্বা সেন্টাও: ওজন ব্যবহার না করে মূল শক্তিতে ফোকাস করতে ড্যান্স পার্টনার হিসেবে চেয়ার ব্যবহার করা হয় এতে।
জুম্বা নাচের ফিটনেস প্রোগ্রাম ধীরলয়ের সংগীতের মাধ্যমে শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে আপবিট গানের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে হয়। এটি ক্যালরি বার্ন করতে, কার্ডিওভাসকুলার হেলথ উন্নত করতে, শরীরে ভারসাম্য আনতে এবং ভারসাম্য উন্নত করতে বেশ কাজে দেয়।
জুম্বার আরও কিছু উপকারিতা রয়েছে; চলুন, জানি—
ক্যালরি ও ফ্যাট বার্ন: জুম্বার ফলে হাত থেকে পা পর্যন্ত শরীরের প্রতিটি অংশ মুভ করে। এ ছাড়া ড্যান্সের রুটিনটি বেশ দ্রুতলয়ের এবং সহজ। তাই জুম্বা আপনাকে ক্যালরি বার্ন করতে এবং ফ্যাট কমাতে সাহায্য করতে পারে। এক ঘণ্টার জুম্বা ড্যান্সে ৫০০ থেকে ৮০০ ক্যালরি বার্ন করা সম্ভব। পুরো শরীরের কার্যকারিতার ফলে পেশির ওপর চাপ দূর করে এবং ফিটনেসে উন্নতি ঘটায় এই এক্সারসাইজ।
কার্ডিওভাসকুলার ফিটনেসে উন্নতি: জুম্বা ড্যান্স হৃৎপিণ্ড ভালো রাখতে সহায়তা করে। এই ড্যান্সের প্রভাবে হৃৎপিণ্ডে দ্রুত পাম্প হয়। জুম্বায় দ্রুত মুভ করার ফলে দ্রুত ও দীর্ঘ শ্বাস নিতে বাধ্য হন এক্সারসাইজকারী। ফলে তার ফুসফুসে ও রক্তে বাড়তি অক্সিজেন যোগ হয়, যা পরবর্তীকালে সারা শরীরে সঞ্চালিত হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে, আপনি যত বেশি শ্বাস নেবেন, আপনার শক্তির স্তর তত বেশি হবে এবং আপনাকে ফিট রাখবে।
শারীরিক সহনশীলতা: নিয়মিত জুম্বা প্র্যাকটিস করলে শারীরিক সহনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। ড্যান্স ওয়ার্কআউটের সময় যেহেতু প্রায় প্রতিটি পেশি অবিরাম মুভমেন্ট করে, ফলে তা শরীরের মজ্জাকে স্থিতিশীল করে তোলে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: স্থূলতার কারণে উচ্চ রক্তচাপ বাড়ে, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। শরীরের ওজন যত বাড়ে, উচ্চ রক্তচাপে তত বেশি আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে সামান্য ওজন হ্রাসের মাধ্যমেও এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। জুম্বা ড্যান্স ওজন কমাতে সাহায্য করে; তাই তা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অন্যতম সেরা উপায়।
মনস্তাত্ত্বিক সুবিধা: জুম্বা একটি ফান ওয়ার্কআউট। এই ওয়ার্কআউটের সময় আপনি যেহেতু মিউজিক ও ড্যান্স স্টেপগুলোতে ফোকাস রাখবেন, তাই দুশ্চিন্তা ভুলে যাওয়ার দারুণ নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে এটি। তা ছাড়া ওয়ার্কআউট করার সময় শরীর এন্ডোরফিন মুক্ত হয়; ফলে চর্চাকারী তুলনামূলক উৎফুল্ল থাকেন। তা ছাড়া জুম্বা আপনাকে সামাজিকভাবে আরও সক্রিয় করে তুলতে সক্ষম। এই ওয়ার্কআউট কয়েকজন মিলে দলগতভাবে করা হয়। ফলে চারপাশে থাকা অন্যান্য মানুষের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন আপনি।
সারা শরীরের ব্যায়াম: যদিও জুম্বা করতে একটি রুটিন কোরিওগ্রাফির সাহায্য নেওয়া হয়, তবে এই ব্যায়ামের কোনো সঠিক কিংবা ভুল উপায় নেই। জুম্বায় অংশগ্রহণকারীদের প্রধান ফোকাস থাকে শরীরকে যত দ্রুত সম্ভব মুভ করানো। ফলে সারা শরীরের মুভমেন্ট প্রয়োজন পড়ে। সহজ করে বললে, জুম্বা ড্যান্স আপনার পুরো শরীরকে একটি সামগ্রিক ওয়ার্কআউট এনে দেয়।
মেটাবলিজমের উন্নতি: পুরো শরীরের ওয়ার্কআউট এবং জুম্বার সাধারণ স্বাস্থ্য উপকারিতা আপনার মেটাবলিজমকে উন্নত করতে সাহায্য করবে। এই ওয়ার্কআউট শরীরে রক্তসঞ্চালন বাড়ায়; ফলে আপনার মেটাবলিজম এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও বাড়বে।
দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিকতা: যেকোনো ব্যায়াম শুরু করার চেয়ে সেটি চালিয়ে নেওয়া কঠিন। কোনো ওয়ার্কআউট রুটিন থেকে ইতিবাচক ফল পেতে চাইলে একাগ্রতা ও ধারাবাহিকতা গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি ফিটনেস ফ্রিক না হন, তাহলে প্রচলিত ওয়ার্কআউটগুলো আপনার কাছে বিরক্তিকর হয়ে উঠতে পারে। অন্যদিকে, জুম্বা একটি ফান এক্সারসাইজ। আরও ভালো ফলের জন্য হয়তো মনের অজান্তেই আপনি লম্বা সময়ের জন্য এ চর্চায় নিযুক্ত থাকবেন।
একটি কার্যকর জুম্বা ড্যান্সের রুটিন আপনার শরীরে একধরনের ছন্দ এনে দেবে। তবে বোঝা জরুরি, শুধু জুম্বা আপনাকে কোনো শেপে আনবে না। তাই জুম্বা ড্যান্স ও প্রচলিত স্ট্রেন্থ এক্সারসাইজ—উভয়ই বেছে নেওয়া চাই। এ দুয়ের একটি সম্মিলিত রুটিন আপনার সামগ্রিক ফিটনেস উন্নত করতে সাহায্য করবে, যা দীর্ঘ ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে হয়ে উঠবে সহায়ক। তাই আপনি যদি নাচ ভালোবাসেন এবং আবার শেপে ফিরে আসতে চান, তাহলে যোগ দিতে পারেন জুম্বা ফিটনেস প্রোগ্রামে।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সুমাইয়া চৌধুরী কৃতিকার সৌজন্যে