মনোযতন I বহু সত্তার হুংকার
ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডার। এক মানুষের ভেতর বহু সত্তার বসবাস। খুবই বিপজ্জনক মনোব্যাধি। বিস্তারিত আশিক মুস্তাফার লেখায়
রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের রহস্যগল্প ড. জেকিল অ্যান্ড মি. হাইডের কথা নিশ্চয় মনে আছে। গল্পের ড. জেকিল এমন এক ওষুধ আবিষ্কার করেছিল, যা ব্যবহারে তার ভেতরের খারাপ সত্তাগুলো জেগে ওঠে এবং সে এক অন্য মানুষে পরিণত হয়। ড. জেকিল তার ওই সত্তার নাম দিয়েছিল মি. হাইড। জেকিল আরেকটি ওষুধও আবিষ্কার করেছিল, যার মাধ্যমে সে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারত। নিজের ভেতর দুটি ভিন্ন সত্তা নিয়ে বাস করা ড. জেকিলের মতো আমাদের আশপাশের অনেকেই মনোজগতে একাধিক সত্তা বয়ে বেড়ান। পরিসংখ্যান বলে, মাত্র শূন্য দশমিক ০১ থেকে ১ শতাংশ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হন। তবে নারীদের মধ্যে এ রোগ বেশি দেখা যাওয়ায় তাদের জন্য সব সময়ই রোগটি ইয়েলো সিগন্যাল দিয়ে রাখে। একটু মোটা দাগে দেখলে বোঝা যায়, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বলে থাকেন, সিনেমায় তারা নিজেদের দেখছেন! অন্যদিকে, প্রায় ৭ শতাংশ কোনো শনাক্তকরণ ছাড়াই মনে করেন, এই রোগ তাদের রয়েছে!
পরিচয়সূত্র
কল্পকাহিনির মতো বাস্তবেও এমন এক মানসিক রোগের দেখা মেলে, যা ঘাড়ে ভর করার কারণে একজন মানুষ ১০০টির মতো বিচ্ছিন্ন সত্তায় বসবাস করেন। ভৌতিক মনে হলেও এ কথা সত্যি! চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় রোগটিকে বলে ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডার। বাংলায় বহুসত্তা ব্যাধি বলা যেতে পারে। আমরা প্রায় সবাই জীবনের কোনো না কোনো সময় একটু হলেও বিচ্ছিন্নতা অনুভব করি কিংবা করেছি। কথা বলতে বলতে কিংবা কাজ করতে করতেই হঠাৎ কোথাও হারিয়ে গিয়েছি, যাকে আমরা দিবাস্বপ্ন বলি। কিন্তু ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডার আসলে দিবাস্বপ্নের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। ফলে মানুষের চিন্তাভাবনা ও অন্যান্য কাজের সঙ্গে তার নিজেরই একটি বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। এই রোগে একজন মানুষের মধ্যে একাধিক ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। তা হতে পারে কোনো কাল্পনিক মানুষের, কোনো কল্পনার চরিত্রের, এমনকি কারও কারও মাঝে পশুপাখির স্বভাবও দেখা যায়! মানুষটি বেশ কয়েকটি সত্তার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। সেই সত্তাগুলো থেকে নিজেকে আর আলাদা করতে পারেন না। শুধু তা-ই নয়; ওই বিচ্ছিন্ন সত্তাগুলো রোগীকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তিনি যখন স্বাভাবিক অবস্থায় থাকেন, নিজের অন্য সত্তাগুলো সম্পর্কে তার কিছুই মনে থাকে না। শুধু অনুভব করেন, হয়তো কোথাও হারিয়ে গিয়েছিলেন! মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই অবস্থাকে বলা হয় ব্ল্যাকআউট। একের মাঝে একাধিক ব্যক্তিত্বও দেখা যায়। এর সংখ্যা হতে পারে ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত। রোগটিকে তাই মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিজঅর্ডারও বলা হয়।
হেতু সন্ধান
সাধারণত একের পর এক মানসিক আঘাত একজন মানুষকে এই রোগের দিকে টেনে নিয়ে যায়। মূলত নিজের ভয়ংকর স্মৃতিগুলো থেকে রক্ষা পেতে এই রোগে আক্রান্তরা নিজেদের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিত্ব তৈরি করে নেন। কেন করেন এমনটা? এর বেশ কিছু কারণের মধ্যে রয়েছে—
শৈশবে ঘটে যাওয়া যেকোনো ধরনের ভয়ংকর ঘটনা কিংবা যৌন হয়রানি;
কোনো কিছুকে প্রচণ্ড ভয় পাওয়া;
পরিবারে লাঞ্ছনা কিংবা অতিরিক্ত মারধরের শিকার হওয়া;
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত র্যাগিংয়ের শিকার হওয়া;
অতিরিক্ত মানসিক চাপ;
বিষণ্নতা ও অবসাদে ভোগা;
নিজের জীবন নিয়ে হতাশা এবং প্রাত্যহিক জীবন থেকে মুক্তিলাভের পথ খুঁজতে গিয়ে নিজের মধ্যে অন্যান্য ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটানো।
তবে মোটা দাগে দোষারোপ করা হয় যৌন হয়রানিকে। শৈশবে যারা এ ধরনের হয়রানির শিকার হন, তাদের মধ্যে এ রোগের প্রকোপ বেশি। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, মূলত ওই প্রচণ্ড ভয় থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ভিকটিম নিজের ভেতর নতুন ব্যক্তিত্ব তৈরি করে নেন। অনেক সময় ওই সত্তাগুলোকে তিনি তার রক্ষাকর্তা হিসেবেও কল্পনা করেন। শত চেষ্টার পরও যখন তিনি ভয়ংকর স্মৃতি থেকে রক্ষা পান না, সাধারণত তখনই এই পন্থা অবলম্বন করেন। অনেক ক্ষেত্রে তার ভেতর এমন এক ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটতে দেখা যায়, যার বয়স তার ওই ভয়ংকর স্মৃতির আগমুহূর্ত পর্যন্ত আটকে রয়েছে; এরপর আর বাড়ছে না, যার সঙ্গে ওই ভয়ংকর স্মৃতির কখনো সাক্ষাৎ ঘটে না।
লক্ষণে চেনা
বেশ কিছু লক্ষণ দেখে এই রোগে আক্রান্তদের শনাক্ত করা সম্ভব। যেমন—
রোগী তার ব্যক্তিগত তথ্যগুলো ভুলে যেতে থাকেন, যা সাধারণত তার ভুলে যাওয়ার কথা নয়;
রোগী অনেক সময় অনুভব করেন, তিনি তার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন;
তার ভেতর আত্মহত্যার প্রবণতা এবং চরম হতাশা বিরাজ করে;
মুড সুইং হয় প্রতিনিয়ত;
ঘুমের নানা সমস্যা দেখা দেয়; যেমন ঘুম না হওয়া, ঘুমের মাঝে ভয় পাওয়া, ঘুমের মাঝে হাঁটা প্রভৃতি;
অস্থিরতা, প্যানিক অ্যাটাক এবং বিভিন্ন ধরনের ফোবিয়া দেখা দেয়; যেমন কোনো স্মৃতি মনে পড়লে সেগুলোর প্রতি বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখানো;
বিভিন্ন মাদকের প্রতি আসক্তি দেখা দেওয়া;
হ্যালুসিনেশনে ভোগা;
খাওয়াদাওয়ায় অনিয়ম ইত্যাদি।
ভুলের বেসাতি
অনেকেই মনে করেন, মানসিক চিকিৎসকেরা রোগীর মাঝে হ্যালুসিনেশন সৃষ্টি করার কারণে এই রোগ হয়। বর্ডার লাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডারসহ অন্য বেশ কিছু রোগের সঙ্গে এর মিল থাকায় অনেকে একে সেসব রোগের লক্ষণও ভেবে থাকেন। অনেক মানসিক চিকিৎসকও একে ‘ভুয়া’ বলেন। মানসিক রোগীদের অন্যান্য রোগকে অনুকরণ করার তীব্র প্রবণতা থাকে বলেই এসব বিভ্রান্তির উদ্রেক ঘটে। অনেকে আবার ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডারকে গুলিয়ে ফেলেন সিজোফ্রেনিয়ায় সঙ্গে। সত্যি হলো, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা বিভিন্ন অবাস্তব জিনিস দেখতে বা শুনতে পান; যেমন কাল্পনিক কিছু মানুষ কিংবা প্রাণী, কোনো শব্দ অথবা গন্ধ। কিন্তু তাদের মাল্টিপল পারসোনালিটি থাকে না। অন্যদিকে ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডারে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে অবাস্তব কোনো বস্তু দেখতে পাওয়ার ঘটনা খুব কম ঘটে। তারা বরং বিভিন্ন সত্তার মাঝে হারিয়ে ফেলেন নিজেদের।
শনাক্তের উপায়
ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডার শনাক্ত করতে বেশ সময় লাগে। কখনো কখনো দেখা যায়, শনাক্ত করার আগেই রোগী ৫ থেকে ৭ বছর মানসিক চিকিৎসার তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। তবু রোগটি শনাক্ত করা যায়নি। এ খুবই স্বাভাবিক। কেননা, এ রোগের এমন কিছু লক্ষণ রয়েছে, যা অন্যান্য মানসিক রোগের সঙ্গে বেশ মিলে যায়। তা ছাড়া এ রোগে আক্রান্ত অনেক রোগীর একই সঙ্গে বর্ডার লাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার, ডিপ্রেশন এবং অস্থিরতা ব্যাধিও থাকে। তাই মানসিক চিকিৎসকেরা রোগটি শনাক্তের জন্য পাঁচটি লক্ষণ নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
একাধিক সত্তা ও আলাদা দর্শন: রোগীর মধ্যে সব সময়ই একাধিক সত্তা বিরাজ করবে এবং একেকটি সত্তার ধরন থাকবে একেক রকম; থাকবে জীবন ও পরিবেশ নিয়ে আলাদা দর্শন।
ভুলে যাওয়ার প্রবণতা: রোগী তার প্রাত্যহিক জীবনের বিষয়গুলো ভুলে যেতে থাকবেন; বিশেষ করে ভয়ংকর ঘটনাগুলো ভুলে যাবেন খুব সহজে।
ক্ষুব্ধ ও পীড়িত: রোগী তার দৈনন্দিন জীবন নিয়ে খুবই ক্ষুব্ধ ও পীড়িত থাকবেন।
সমস্যার মিলন: নিজের সমস্যাগুলোকে স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গে তিনি মেলাতে পারবেন না।
শারীরবৃত্তীয় প্রভাবে ‘না’: রোগীর উপসর্গগুলো কোনো শারীরবৃত্তীয় প্রভাব ফেলবে না। যেমন মাতাল অবস্থায় চিৎকার কিংবা ভাঙচুর করবেন না; কিংবা কোনো রোগের বা চিকিৎসার পরবর্তী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পড়বে না।
সমাধানে
সুনির্দিষ্ট ও বাস্তব প্রমাণের ভিত্তিতে যদি বুঝতে পারেন, আপনি এই সমস্যায় ভুগছেন, তবু একটু সময় নিন। বিষয়টি ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করুন। সুনির্দিষ্ট বাস্তব কোনো প্রমাণ না থাকলে অকারণে সন্দেহ করা যাবে না। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, লেখক ও অধ্যাপক ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, ‘ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডার পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য নয়। তাই সব সময় মানসিক চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকাই এর একমাত্র চিকিৎসা।’ তিনি আরও জানান, রোগটির কার্যকরী কিছু চিকিৎসা হচ্ছে টকথেরাপি, সাইকোথেরাপি, হিপনোথেরাপি ও অ্যাডজাঙ্কটিভ থেরাপি। এ ছাড়া রোগটি যেহেতু মনোদৈহিক সমস্যা, তাই মেডিটেশনের মাধ্যমে এর থেকে বেশ ভালো ফল পেতে পারেন। কাজে লাগাতে পারেন বন্ধুত্বকেও। প্রতিনিয়ত হীনম্মন্যতায় না ভুগে ঘনিষ্ঠ কোনো বন্ধুর সঙ্গে আপনার সমস্যা শেয়ার করুন। এরপরও যদি সদুত্তর বা সমাধান না পান, তাহলে পরিবারের এমন কোনো সদস্যের শরণাপন্ন হোন, যার সঙ্গে কথা বলে কিছুটা হালকা অনুভব করবেন। তবে ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডারকে ইতিবাচক ভাবতে যাবেন না; বরং এ সমস্যা বেশি বাড়তে না দিয়ে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ছবি: ইন্টারনেট