টেকসহি I অটিজম অ্যাওয়ারনেস
২ এপ্রিল। ওয়ার্ল্ড অটিজম অ্যাওয়ারনেস ডে। কেমন চিত্র আমাদের দেশের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের দুনিয়ার? জানা যাক বিশেষজ্ঞ মত। লিখেছেন সাজিদা রহমান ড্যানি
কথায় আছে, ঠিক যতখানি দিতে পারবেন, ফেরত আসবে ততখানিই। ধরুন, ১৮ থেকে ২২ বছর ধরে, শিক্ষা থেকে কাজের জায়গায় যাওয়া পর্যন্ত আমরা সন্তানদের পেছনে বিনিয়োগ করি। এর জন্য বিপুল অর্থ খরচ করা হয় এটা নিশ্চিত করতে যে, তারা জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, কাজ করে নিজের জীবিকা উপার্জন করতে পারছে। এটি সর্বজনস্বীকৃত ব্যবস্থাপনা বা প্রক্রিয়া। প্রশ্ন হলো, ঠিক কতখানি সময়, প্রচেষ্টা ও টাকা বিনিয়োগ করছেন অটিজম এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানদের প্রতিষ্ঠার পেছনে? একটু হিসাব কষে দেখুন না!
আমাদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক কিছুই সরকার স্থাপন করে দেয়, যেন জাতি শিক্ষিত হতে পারে, শিক্ষার্থীদের ওপর এর চাপ না পড়ে। তারা স্বল্পমূল্যে বা কম টাকার বিনিময়ে শিক্ষা লাভ করতে পারে। এর সঙ্গে সঙ্গে কালচারাল সাপোর্ট, খেলাধুলা এবং অন্যান্য সাপোর্ট ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করা হয়; যেমন শিল্পকলা একাডেমি কিংবা ন্যাশনাল স্পোর্টস ফেডারেশন। প্রশ্ন হলো, অটিজম এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য সরকার কী কী একাডেমিক ও ভোকেশনাল এডুকেশনের ব্যবস্থা নিয়েছে? এ ধরনের সন্তানদের শিক্ষার জন্য আমরা কোথায় পাঠাব? সরকারি ব্যবস্থাপনায় এটা যদি না হয়, তাহলে কারা করবে? কেনই-বা করবে? আর তাদের পরিচালনার প্রক্রিয়া কী হবে? শিক্ষকের যোগ্যতা কী থাকবে? কোন কারিকুলাম বা সিলেবাসে পড়াশোনা হবে?
যদি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্যসেবার সুব্যবস্থা না করতে পারি, তাহলে জাতি হিসেবে আসলে কতটুকু সভ্য হয়েছি? এনডিডি [নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটিস] প্রোটেকশন আইন পাস হয়েছে ২০১৩ সালে। এরপর কেটে গেছে ৯ বছর। আমরা কতটুকু করতে পেরেছি ওদের বেসিক চাহিদা পূরণ করতে? ৯ বছর পরেও এই প্রশ্ন তুলতে হচ্ছে, এটা কি আমাদের জন্য গৌরবের? না করে থাকলে, কেন পারিনি? এই ব্যর্থতার দায় কি খতিয়ে দেখার সময় আসেনি? যেখানে এই প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্তের ওপর সারা বাংলাদেশের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের ভবিষ্যত নির্ভর করে, সেখানে পারফরম্যান্স অ্যানালাইসিস হওয়াটা খুবই জরুরী। আমরা ইমপ্যাক্টলেস কাজের লিস্ট দেখিয়ে নিজেদের পিঠ নিজেরা চাপড়ে বাহ্বা নিতেই পারি; বড় বড় সেমিনার আর মিটিংয়ে নিজেদের কাজের লিস্ট ধরে বলতেই পারি, আমরা কত কর্মঠ! দিন শেষে যদি ইমপ্যাক্ট না ফেলে, টার্গেট পপুলেশনের প্রয়োজন পূরণ করতে না পারে, তাহলে সেই কাজ অর্থহীন! সমস্যা হচ্ছে, আমাদের এই ব্যর্থতা আমরা ‘সরি’ বলে এককথায় পাশ কাটিয়ে দিতে পারি; কিন্তু এই ব্যর্থতার কারণে দেশজুড়ে যে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন লাখ লাখ শিশু ব্যক্তিজীবনের আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যে জীবনগুলো ঝরে যাচ্ছে, যে পরিবারগুলো দিনের পর দিন স্ট্রাগল করছে, এই বিশেষ বাচ্চার জন্য যাদের পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, তাদের জীবনের দায়ভার কি ‘সরি’র সমতুল্য?
এনডিডি প্রোটেকশন আইনটির মাধ্যমে এর নির্দিষ্ট কিছু কাজ ঠিক করা আছে। কাজগুলো সম্পন্ন করার দায়িত্ব এনডিডি বোর্ডের এবং এনডিডি বোর্ড ব্যবস্থাপকদের। এনডিডি বোর্ড সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। তার মানে আইনের মাধ্যমে যে কার্যাবলি নির্দিষ্ট করা আছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা এনডিডি বোর্ডের প্রধান দায়িত্ব। অথচ এনডিডি প্রোটেকশন আইন পাস হওয়ার ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো আইনের কার্যাবলিতে নির্ধারণ করে দেওয়া বেশির ভাগ কাজ বাস্তবায়নের জন্য কোনো ইফেক্টিভ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই কার্যাবলি রকেট সায়েন্স নয়, এক্সট্রাঅর্ডিনারি কিছু নয়, যেটার বাস্তবায়ন অসম্ভব। আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের জন্য সাধারণ কিছু কাজ এগুলো, যা উদ্যোগ নিলেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত বিচক্ষণ; তিনি এই বোর্ড পরিচালনার জন্য এর ফান্ড বরাদ্দ করে দিয়েছেন এবং এর সাসটেইনেবিলিটি নিশ্চিত করতে প্রোটেকশন আইন পাস করে বোর্ড তৈরি করে দিয়েছেন সেটি পরিচালনার জন্য। প্রশ্ন হলো, এই ৯ বছরেও আইনে স্বীকৃত কার্যাবলি কেন বাস্তবায়িত হয়নি? আমাদের বাধা কোথায়?
কিছুদিন আগে দেখলাম, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের শিক্ষকেরা তাদের চাকরি এমপিওভুক্ত করার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাবি তুলছেন। এমপিওভুক্ত হলে এর বেনিফিট কে পাচ্ছে? শিক্ষা এবং শিক্ষা প্রদানের মান উন্নত না হলে, বিশেষ করে শিক্ষকের মানসিক স্বাস্থ্য, চরিত্র, মানবিক গুণাবলি, আচার-ব্যবহার যদি উন্নত না হয়, শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের কতটুকু সদ্ব্যবহার হবে? শিক্ষার মান কতটুকু বাড়বে? আমি মনে করি, এমপিওর বরাদ্দ হওয়া উচিত শিক্ষার্থীদের জন্য। শিক্ষকেরা এফোর্ট দিয়ে, তাদের মেধা ও শিক্ষার মান নিশ্চিত করে শিক্ষার্থীদের তুলে আনবেন। একজন শিক্ষার্থী যদি তার প্রাপ্য সাপোর্ট শিক্ষকের কাছ থেকে পায়, তাহলে সে এগিয়ে যাবে, উন্নতি করবে। এখানে শিক্ষকের চেয়ে শিক্ষার্থীর প্রয়োজন বেশি এবং শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে এমপিও বরাদ্দ অবশ্যই শিক্ষার্থীদের জন্য হওয়া জরুরি। শিক্ষকদের অধীনে যেসব শিক্ষার্থী আছে, তারা যথাযথভাবে উন্নতি করলেই শিক্ষকের কাজের নিশ্চয়তা এবং তার মানসিক রেমুনারেশন আসা উচিত; কাজ না করে বেতন পাওয়ার জন্য নয়। শিক্ষার্থীর পারফরম্যান্সই বলে দেবে, একজন শিক্ষক কতটা আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা দিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দান করছেন। আমরা এখানে ফোকাস করছি কোথায়? শিক্ষকদের নাকি শিক্ষার্থীদের ওপর? বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের সাপোর্ট করার জন্যই বিশেষ শিক্ষকদের প্রয়োজন। উল্টোটা কিন্তু নয়!
আমরা যেখানে বেসিক অধিকারের বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছি, সেখানে প্রাপ্তবয়স্ক অটিজম বা এনডিডিসম্পন্ন ব্যক্তিদের জীবনধারণের জন্য কর্মসংস্থান বা ইনক্লুসিভ এমপ্লয়মেন্টের বিষয়ে কথা বলা বোধ হয় একটু বেশিই চাওয়া হয়ে যাবে। কিন্তু আইন পাস হওয়ার পরেও যেখানে অধিকারের পাওনাগুলো দূর আকাশের চাঁদের মতো, সেখানে ঢোল বাজিয়ে রথযাত্রা না করলে যারা নন-ভারবাল, তাদের আওয়াজ নীতিনির্ধারকেরা কী করে শুনবেন? আমরা দেশকে ডিজিটাল থেকে স্মার্ট দেশে রূপান্তর করছি; দেশের ২ দশমিক ৮ মিলিয়ন [২০১৩ বিবিসি জরিপ] মানুষকে বাদ দিয়ে কী করে স্মার্ট দেশের চিন্তা করা সম্ভব? স্মার্ট দেশে ইনক্লুসিভ সমাজব্যবস্থায় আমাদের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাসটেইনেবল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার কথা মাথায় রেখেই চিন্তা করা উচিত; আর সেটা না হলে ইনক্লুসিভ কনসেপ্ট বাদ পড়ে যাবে। এই কনসেপ্ট ক্লিয়ার না হলে স্মার্ট বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে এক ধাপ। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে অথবা তাদের সঙ্গে না রেখে কোনোভাবেই কোনো জাতি সভ্য হতে এবং এগিয়ে যেতে পারে না। ইনফ্রাস্ট্রাকচারের অ্যাকসেসিবিলিটি থেকে শুরু করে মাইন্ডসেটের পরিবর্তন এ ক্ষেত্রে বেশি জরুরি।
শুরু করেছিলাম একটি প্রশ্ন দিয়ে, আমরা আসলে আমাদের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পেছনে কতটা বিনিয়োগ করি? তাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে, স্বাস্থ্যবিষয়ক ইনফ্রাস্ট্রাকচারের জন্য, তাদের প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের জন্য, তাদের এমপ্লয়মেন্ট অথবা পারিবারিকভাবে অন্য ভাই-বোনের সঙ্গে তুলনা করে, অথবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষকদের এফোর্টের দিক থেকে? হিসাব করে দেখাটা খুব জরুরি। আমরা তাদের পেছনে ফেলে কিংবা ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে যেতে পারব না। তারা আমাদের পরিবারের অংশ, আমাদের সন্তান। যারা ভাবছেন, ‘এতে আমার কিছু যায়-আসে না’, তাদের বলছি, আজ আপনার পরিবারে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কোনো শিশু বা ব্যক্তি না-ও থাকতে পারে, কিন্তু কাল? কে জানে!
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, পিএফডিএ-ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার ট্রাস্ট
ছবি: ইন্টারনেট