বিশেষ ফিচার I সৃষ্টিসঙ্গ
মাকসুদুল হক। বাংলাদেশি রক মিউজিকের জীবন্ত কিংবদন্তি। রক, পপ, ফোক, ফিউশন, জ্যাজ, ব্লুজ, বাউলগান থেকে শুরু করে তিনি করেননি, এমন জনরা পাওয়া মুশকিল! নিজের অসংখ্য সৃষ্টি থেকে বেছে নেওয়া তিনটি গানের অনুভূতি জানব তার কাছ থেকে
নারায়ণগঞ্জে জন্ম আমার। সেখানেই বেড়ে ওঠা। নারায়ণগঞ্জ প্রিপারেটরি ইংলিশ স্কুলে পড়াশোনার হাতেখড়ি। মিশনারি স্কুল। তখন প্রধান শিক্ষক ছিলেন মিসেস হাবার্ট; স্কটিশ ভদ্রমহিলা। পিয়ানো বাজিয়ে গান শেখাতেন। আমি প্রথম গান শিখেছি তার কাছে। চার-পাঁচ বছর বয়সে স্কুলের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলাম। ধর্মীয় সংগীত। সেই কোরাসের লিড অংশ ছিল ১০ লাইনের মতো। সেই অংশ গাওয়ার জন্য মিসেস হাবার্ট আমাকেই মনোনীত করেছিলেন। এ জন্য রিহার্সাল করেছিলাম সাত দিন। কিন্তু অনুষ্ঠানের দিনই পড়ে গেলাম প্রচণ্ড জ্বরে। তবু ওষুধ খেয়ে চলে গেলাম স্কুলে। পুরস্কার বিতরণের সময় হঠাৎ ডাকা হলো আমার নাম। যেহেতু কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিইনি, তা ছাড়া ক্লাসের মেধাতালিকায় প্রথম থেকে তৃতীয় স্থানেরও অধিকারী নই, তাই কোনো ক্যাটাগরিতে আমার পুরস্কার পাওয়ার কথা নয়। ফলে নিজের নাম শুনে অবাক হয়ে গেলাম। পরে দেখলাম, গানের জন্য বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে আমাকে। সেটিই মঞ্চে আমার প্রথম গান গাওয়া এবং প্রথম কোনো পুরস্কার পাওয়া। সেই থেকে আমার গানের যাত্রা শুরু। এরপর কত গানই তো গেয়েছি! জনপ্রিয়তাও পেয়েছে অনেকগুলো।
চিঠি
এই গান একটি রোমান্টিক প্রেক্ষাপটে লেখা, যা আমার জীবনের বাস্তবিক অনুভূতি তুলে ধরেছে। কোনো ধরনের কল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয়নি। আর জনরা হিসেবে বললে এটি একটি র্যাগে গান। ‘চিঠি’ আমার লেখা, সুর করা প্রথম বাংলা গান। খুব স্বাভাবিকভাবেই এর সঙ্গে আমার আত্মার টান রয়েছে। নিজে লিখতে পারি, সুর করে গাইতে পারি—এমন অভিব্যক্তি ছিল আমার জন্য নতুন। ফিডব্যাকের প্রথম সেলফ টাইটেল অ্যালবাম যখন বের হয়, তখন নানা কারণে ব্যান্ডের সঙ্গে ছিলাম না। যোগ দিই ‘উল্লাস’ অ্যালবামে। সেটি ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত। ‘চিঠি’ ওই অ্যালবামেরই গান। তবে গানটি নিয়ে কাজ করি এরও দুই বছর আগে, ১৯৮৫ সালে।
আমার বেশির ভাগ গানই ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আসা। এই গানের চতুর্থ লাইন ‘ডাকপিয়নের অসুখ হয়েছে’। সে সময় আমার স্ত্রী থাকত আসামে। তখন আমাদের মধ্যে লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপ। সময়টা ১৯৮৪-৮৫ সালের দিকে। সে সময় পরস্পরের মাঝে চিঠি চালাচালি চলত। তখন ন্যূনতম ১৫ দিন লাগত একজনের চিঠি আরেকজনের কাছে পৌঁছতে। হঠাৎ করে মাস দুয়েকের জন্য চিঠি আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। দেড়-দুই মাস পর হঠাৎ দেখি, একসঙ্গে ৩-৪টি চিঠি নিয়ে ডাকপিয়ন এসেছেন। কারণ জানতে চাইলে বললেন, অসুখে পড়েছিলেন। মূলত সেখান থেকেই গানটির শুরু—‘আজ তোমার চিঠি/ যদি না পেলাম হায়/ নাকি ভেবে নেব/ ডাকপিয়নের অসুখ হয়েছে।’
খুঁজি তোমাকে খুঁজি
এই গানও আমার লেখা। আশিকুজ্জামান টুলু আর আমার যৌথ সুর। এ গানের সঙ্গে আমার আবেগ জড়িত। ‘খুঁজি তোমাকে খুঁজি’কে অনেকেই রোমান্টিক গান মনে করেন। তবে আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে এমন একটি সত্তা থাকে, যাকে খোঁজার কথা বলা হয়েছে এ গানে। গানের কিছু লাইন, ‘তোমাতে আমাতে এই ছাড়াছাড়ি/ হয়ে গেছে বড্ড তাড়াতাড়ি/ তুমি বুঝলে ভুল নতুবা আমি/ আর মানুষ বলল, এই ভুল বোঝাবুঝি’—এগুলোতে নিয়মিত ভুল-বোঝাবুঝির বার্তা আছে, যা প্রেম অথবা যেকোনো সম্পর্কে ঘটতে পারে। ‘চুপি চুপি সারা রাতই কত না কথা হয়েছে/ শুয়ে পাশাপাশি/ আবার মানুষ ভাববে ভুল নতুবা তুমি/ তাই সাক্ষী রেখেছি এই দূরালাপনী’—এই কথাগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে একান্ত মনোভাব। এখানে পাশাপাশি শুয়ে কথা বলা বলতে ফোনে কথা বলে পাশে থাকা বোঝানো হয়েছে। তাই তো দূরালাপনীর কথা বলা হয়েছে।
সত্যিকার অর্থে, ভালোবাসা ব্যাপারটাই এলোমেলো। একটা ঝড়ের মধ্য দিয়ে তা অনেক সময় প্রবাহিত হয়। ভালোবাসা এমন এক অনুভূতি, যেখানে কাকুতি-মিনতির ব্যাপার থাকবেই। তাই গেয়েছি, ‘এলোমেলো ভালোবাসা, কাকুতি মিনতি/ মিছেমিছি খেলা/ এ মানুষ করুক না করুক উপলব্ধি/ আমার বিধাতার তাতে/ নেই কোনো আপত্তি।’ আমি বোঝাতে চেয়েছি, আমাদের এ সবকিছুতে কেউ উপলব্ধি করতে না পারলেও কোনো আপত্তি নেই। আমরা চাইলে প্রেম-ভালোবাসা করতেই পারি, তাতে নিশ্চয় বিধাতারও কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। আশিকুজ্জামান টুলুর সংগীতায়োজনে ফাঙ্ক জনরার এই গান ১৯৯৫ সালে একটি মিক্সড অ্যালবামে প্রকাশ পেয়ে বেশ সাড়া ফেলেছিল।
ধন্যবাদ হে ভালোবাসা
আমার লেখা ‘গীতিকবিতা’ সিরিজের গান এটি। ‘গীতিকবিতা ২’। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে একটি কালো অধ্যায় ছিল, যখন প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে অ্যাসিড নিক্ষেপের প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। দু-এক দিন পরপর সংবাদপত্রের পাতায় এমন খবর পাওয়া যেত। পরবর্তীকালে কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের কারণে এ ধরনের অপরাধ অনেকাংশে কমে এসেছে। আমার মতে, একজন মানুষ যখন ভালোবেসে চলে যায়, তখন অনেক কিছু দিয়েও যায়। সবকিছু নিয়ে যায়, এমন নয়। চলে যাওয়া মানুষটি যে আমাকে ভালোবেসেছিল এবং দুঃখ দিয়েছিল, সে জন্য তার একটি ধন্যবাদ প্রাপ্য। অন্যথায় আমি এই পরিপূর্ণ মানুষ হতে পারতাম না।
গানটির কথা ও সুরে আমি যা বলার চেষ্টা করেছি, তা হলো—লাভ ইজ আ জার্নি। জ্যাজ, রক ও ফিউশন জনরার এ গানে গেয়েছি, ‘ভেসে যাও নেই কোনো আশ্রয়/ ভেসে যাও নেই কোনো পিছুটানের সংশয়।’ খেয়াল করে দেখুন, একটা মানুষের জীবন থেকে যখন কেউ চলে যায়, তখন সে কতই-না হতাশ ও একা অনুভব করে। তাই গেয়েছি, ‘আমি স্বপ্নহীন পৃথিবী আঁকড়ে রবো,/ ভরাডুবির আশঙ্কাতে’ অথবা ‘আমি স্বপ্নহীন পৃথিবী আঁকড়ে রবো,/ চোরাবালির নিমজ্জনে।’ এ গানে আমি চেয়েছিলাম গভীর চিন্তাভাবনা থেকে কিছু লেখার, যা গতানুগতিক প্রেমের গানের চেয়ে আলাদা হবে। তাই জীবনের গভীর চিন্তাধারা ও অঙ্গীকারকে তুলে ধরেছি গানের কথায়। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ফিডব্যাকের ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ অ্যালবামে মুক্তি পায় গানটি। এতকাল পরেও গানটি এই প্রজন্মের তরুণদের ভাবায়, তা আমার বেশ ভালো লাগে।
অনুলিখন: ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সংগ্রহ