বহুরূপী I বিরিয়ানি ব্যবচ্ছেদ
বিরিয়ানি বাংলাদেশে এতই জনপ্রিয়, কোনো ভোজনরসিক এ দেশের জাতীয় খাবার হিসেবে একে বিবেচনা করলে বোধ করি খুব একটা দোষ দেওয়া যাবে না! ভারতীয় উপমহাদেশে এ খাবার কীভাবে এসেছিল, তা নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। কেউ কেউ মনে করেন, এর উৎপত্তি মধ্যপ্রাচ্যে; কারও মতে, বিরিয়ানি বিস্তারে রয়েছে মোগল সম্রাট শাহজাহানের (১৫৯২-১৬৬৬) স্ত্রী মুমতাজ মহলের বিশেষ অবদান। সে যা-ই হোক, জিভে জল আনা এই খাবারের রয়েছে নানা প্রকারভেদ।
তেহারি প্রথমাবস্থায় ছিল নিরামিষ দিয়ে তৈরি ভাতের রেসিপি, যা ক্ল্যাসিক বিরিয়ানির চেয়ে সামান্য পরিবর্তন করে মুসলিম নবাবদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। ঐতিহ্যবাহী বিরিয়ানিতে যেখানে মাংসের সঙ্গে ভাত যোগ করা হয়, সেখানে চালের সঙ্গে আলু যোগ করা পদটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। কারণ, সে সময় মাংসের দাম হয়ে গিয়েছিল আকাশচুম্বী। আলু ছিল সস্তা বিকল্প হিসেবে সহায়ক। বর্তমানে বাংলাদেশে মাংস যোগে তৈরি বিরিয়ানি খাওয়ার চল সবচেয়ে বেশি। একই সঙ্গে আলুর অস্তিত্বও বিরাজ করছে এই খাবারে। আমাদের দেশে বিশেষত পুরান ঢাকায় এবং ভারতের কাশ্মীরে বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা প্রবল।
যদিও বেশির ভাগ কাচ্চি বিরিয়ানিতে উপাদান হিসেবে থাকে ভাত ও মাংস; তবে এর আছে নানা ধরনের রন্ধনশৈলী। এটি এমন এক ধরনের বিরিয়ানি, যেখানে ম্যারিনেট করা খাসির মাংসকে হান্ডিতে বা মাটির পাত্রে ভাত যোগে একাধিক স্তরে রেখে তাপ দিয়ে রান্না করা হয়। হান্ডির মুখ গমের আটা দিয়ে সিল করে দেওয়া হয় বলে ভেতরে থাকা বাষ্পের উত্তাপে খাবারটি অনেকাংশে রান্না হয়ে যায়। রান্নার পুরো সময়কালে পাত্রটির মুখ একবারও খোলা হয় না। বলে রাখা ভালো, ভারতে কাচ্চি বিরিয়ানিতে খাসির মাংসের পাশাপাশি মুরগির মাংসেরও প্রচলন আছে।
বিরিয়ানির কথা মনে এলেই অনেক ভোজনরসিকের চোখে হায়দরাবাদি বিরিয়ানির ছবি ভাসতে থাকে! খাবারটির মূল উপাদান ভাত, মাংস ও মসলা। পাক্কি বিরিয়ানিতে থাকে রান্না করা ভাত ও মাংস, যা বিকল্প স্তরে তৈরি এবং আগুনের উত্তাপে রান্না করা হয়। হায়দরাবাদি বিরিয়ানির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, এটি অন্য যেকোনো বিরিয়ানির চেয়ে বেশি মসলাদার।
১৮৫৬ সালে আওধের নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ লখনউ থেকে নির্বাসিত হয়ে এলে কলকাতায় প্রচলন ঘটে বিরিয়ানির। সে সময় বর্তমান কলকাতার অন্তর্ভুক্ত মেটিয়াবুরুজ শহরতলিতে আবাস গড়া নবাব নিজের শেফদের পাশাপাশি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন বিরিয়ানির রাজকীয় রেসিপি। তবে স্থানীয় জনগণ হতদরিদ্র হওয়ায় এবং মাংসের দাম ক্রমবর্ধমানের কারণে মাংস মেশানো বিরিয়ানি উপভোগের সামর্থ্য অনেকেরই ছিল না। তাই এতে আলু ও সেদ্ধ ডিমের উপাদান যোগ করা হয়েছিল। কলকাতার বিরিয়ানিতে সাধারণত হালকা মসলা দেওয়া হয়। তবে মেরিনেটে মেশানো মসলার কারণে এই বিরিয়ানির নিজস্ব একটি স্বাদ রয়েছে, তা অনেক ভোজনরসিকের মতেই অনন্য। স্বাদ ও রং যোগ করার জন্য গোলাপজল ও জাফরান সহযোগেও পাকানো হয় এটি।
লখনউর বিরিয়ানি ছিল এক দুর্দান্ত রাজকীয় খাবার। তবে স্বাদের দিক থেকে তেমন মসলাদার নয়। এর গন্ধ তুলনামূলক হালকা। রন্ধনশৈলীতে কলকাতার বিরিয়ানির সঙ্গে অনেকটা মিল থাকলেও পার্থক্য আলুর অনুপস্থিতিতে। সুগন্ধ ও সমৃদ্ধ স্বাদের জন্য এতে মেশানো হয় কয়েক ধরনের মসলা।
ষোড়শ শতাব্দীতে মোগলরা যখন প্রথম ভারত শাসন শুরু করে, তখন থেকেই ‘মুগল কিচেন’ শব্দের প্রচলন। এর পেছনের কারণ, নানা ধরনের খাবার আবিষ্কার, বিবর্তন ও রন্ধনশৈলীতে মোগলদের অবদান। সমগ্র ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়ার সময় তাদের রন্ধনপ্রণালি ও বিভিন্ন খাবারের সংস্কৃতি বিষয়ে স্থানীয়দের মধ্যে কৌতূহল বাড়তে থাকে। মোগল বিরিয়ানি সেই সব খাবারের অন্যতম। বিরিয়ানির এই স্টাইল ইদানীং সাধারণত দিল্লিতে সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে।
ভারতের তামিলনাড়ুর উত্তর অঞ্চলে যেখানে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি, সেখানে এই খাবার বেশ প্রচলিত। ভেলোর জেলার অম্বুর ও বানিয়ামবড়ি নামক দুই প্রতিবেশী শহরের রন্ধনপ্রণালির অংশ হওয়ায় এটি বানিয়ামবড়ি বিরিয়ানি নামেও পরিচিত। এই বিশেষ ধরনের বিরিয়ানির প্রবর্তন করেছিলেন প্রাচীন আর্কোটের (কর্ণাটক) নবাবেরা। তবে টকবেগুনের তরকারি এবং রাইতা ছাড়া খাবারটি অসম্পূর্ণ। এই বিরিয়ানিতে থাকে মাংসের আধিক্য।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট