এডিটরস কলাম I আসুন, প্রকৃতি বাঁচাই
বিশ্ব উষ্ণায়নের এই বিপদের কথা ভেবে মানুষকে সতর্ক করে দেওয়ার পর প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা আরেকটি শঙ্কার জানান দিয়েছিলেন এই শতাব্দীর শুরুতেই। তা হলো, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের পর প্রকৃতিতে নেমে আসবে গ্লোবাল ডিমিং
প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে। গ্রীষ্মের আগেই ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছিল, তা এখনো চলছে। প্রায় প্রতিদিন। কোথাও কোথাও টর্নেডো হচ্ছে। খোদ রাজধানীতে দিনের বড় অংশই থাকছে মেঘাচ্ছন্ন। বলতে গেলে নিয়ম করে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। প্রবল ঝোড়ো হাওয়ায় গাছপালা ভেঙে পড়ছে। এমন তো বর্ষায় হওয়ার কথা! গ্রীষ্মের আকাশে থাকবে গনগনে সূর্য, তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে আসবে, হঠাৎ মেঘ জমে কালবৈশাখী হবে; এসবের লেশমাত্র নেই- আছে এই ঠান্ডা হাওয়া নয়তো গা-চুলকানো গরম আর নিয়ম করে ঝড়বৃষ্টি। প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা যে ভবিষ্যদ্বাণী আজ থেকে কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে করেছিলেন, তা আজ দেখছি হুবহু মিলে যাচ্ছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রভাব চাক্ষুষ করছি। টের পাচ্ছি ঋতুচক্র এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, গ্রীষ্মের মৌসুমের ওপর চড়াও হচ্ছে বর্ষাকাল। অন্য ঋতুগুলোর যে কী অবস্থা হয়, তাই ভাবছি। উদ্বিগ্ন হচ্ছি। আমরা জেনে এসেছি, প্রকৃতি নিজের নিয়মেই চলে, সেভাবেই তাকে চলতে দিতে হয়। নইলে প্রকৃতির অংশ মানুষও বিপন্ন হয়ে পড়ে।
এই যে গ্রীষ্মকে আমরা তার মতো করে পাচ্ছি না, তাতে বোঝা যাচ্ছে, প্রকৃতিকে নিজের নিয়মে থাকতে দেয়া হয়নি। অথবা, তাতে বাধা দেয়া হয়েছে নানাভাবে। বন উজাড় করে, গাছপালা কেটে আমরা নগর গড়েছি; কিন্তু প্রকৃতির সেই শূূূন্যস্থান পূরণ করতে পারিনি। নদী, জলাশয় আর পুকুরের স্বাভাবিকতা নষ্ট করেছি, ভরাট কিংবা দূষিত করেছি। জল, বাতাস ও মাটি কার্বন ও অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদানে ভরিয়ে ফেলেছি। ফলে, প্রকৃতি এখন আমাদের শাস্তি দিতে শুরু করেছে। জীববৈচিত্র্য তো নষ্ট হয়েই চলেছে, কত রকমের রোগবালাই দেখা দিচ্ছে!
বিশ্ব উষ্ণায়নের এই বিপদের কথা ভেবে মানুষকে সতর্ক করে দেওয়ার পর প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা আরেকটি শঙ্কার জানান দিয়েছিলেন এই শতাব্দীর শুরুতেই। তা হলো, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের পর প্রকৃতিতে নেমে আসবে গ্লোবাল ডিমিং। সূর্যের আলো ও তাপ দ্রুত কমে আসতে থাকবে এবং এর প্রভাবে অক্সিজেন কমে আসবে। স্বাভাবিকভাবে জীবজগৎ বিপন্নতা ও ধ্বংসের দিকেই যাবে। সে জন্যই স্টিফেন হকিংসহ অন্য বিজ্ঞানীরা মানুষকে নতুন বাসস্থানের সন্ধান করতে বলেছেন।
এ মুহূর্তে এত দূরের কথা না ভেবে এখনকার কথা ভাবাই ভালো। সুইফট টাটল পৃথিবীর কক্ষপথে এসে এই গ্রহকে আঘাত করবে- বার্তাটি যখন মহাকাশবিজ্ঞানীরা দিয়েছিলেন নব্বইয়ের দশকে, তখন তারা এ-ও বলেছিলেন- ভয়ের কিছু নেই, মানুষ তার জ্ঞান দিয়ে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারবে। হ্যাঁ, মানুষের আত্মরক্ষা ও বিকাশ জ্ঞানের জোরেই হয়েছে; তবে কা-জ্ঞানের বাইরে মানুষ যা কিছু করেছে, তার সবই ডেকে এনেছে বিপদ। এই যেমন ফলন বাড়ানোর জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, জেনেটিক্যালি মডিফাইড শস্যের উৎপাদন, ফল ও সবজি তাজা রাখার জন্য ক্ষতিকর মাত্রায় ফরমালিন প্রয়োগ, নদীতীরে শিল্পকারখানা স্থাপন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ইত্যাদি।
প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের সম্পর্ক নিবিড় ও গভীর। প্রকৃতিতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে এর প্রভাব মানুষের ওপর পড়বেই। দিন যত যাচ্ছে, তত দেখছি, মানবিক মূল্যবোধ বিপর্যস্ত হচ্ছে। অসহিষ্ণু, অধৈর্য, আত্মসর্বস্ব মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। নিষ্ঠুরতা লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে চলেছে। মাঝেমধ্যে ভাবি, ষড়ঋতুর অকৃত্রিম হাওয়া, আলো আর জলে বাঙালির জীবনে যে মায়ামমতা ছিল, তার তুলনা পৃথিবীর কোথাও মিলবে না। হায়, সেই দিন আজ কোথায় হারালো! বাংলার প্রকৃতিই বাঙালিকে ভালোবাসার কাঙাল বানিয়েছে; কিন্তু প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে আজ সে নিজেকে প্রেমহীনতার দিকে, ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু সবার কাছেই কি এমনটা প্রত্যাশিত? সবাই কি দল বেঁধে এই আত্মঘাতী কর্মকান্ড নেমে পড়েছে? একটা সমাজের সবাই মনুষ্যত্বহীন হতে পারেন না। যারা হন, তাদের সংখ্যা আঙুলে গোনা যায়, এখন হয়তো একটু বেড়েছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভালো মানুষই সমাজে সবচেয়ে বেশি। তারা ঐক্যবদ্ধ হলে, সচেতন হলে, সক্রিয় হলে এ-জগৎ অনিরাপদ আর অসুন্দর হওয়ার কথা নয়। একটা কথা প্রায়ই শুনি- ভালোরা বিচ্ছিন্ন, মন্দরা দলবদ্ধ বলেই পৃথিবীতে এত সমস্যা; মন্দের দাপট আর ভালোদের ত্রাহি দশা।
তবু আশাবাদী হতে চাই। ভরসা করি মানুষের ওপর, তাদের জ্ঞানে ও কর্মে আমাদের অশেষ আস্থা। তবে ওই যে বললাম, কা-জ্ঞানের প্রয়োগ বেশি জরুরি। কোনো কাজের আগে আমাদের ভাবা দরকার, ফল বা পরিণতি কী হতে পারে। এতেই আমাদের বিবেচনাবোধ শাণিত হবে, নিজের স্বার্থে অন্ধ না হয়ে প্রকৃতি ও মানুষের কল্যাণে কাজ করতে পারবো। অন্তত পরিবেশের ক্ষতি করবো না। প্রকৃতি পুনরুদ্ধার ও রক্ষায় সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে সক্রিয় হলে এই পৃথিবীতে সুস্থ ও সুন্দরভাবে বাঁচতে পারবো। আমাদের মনের অশুচিও দূর হবে।