দেহযতন I সাঁতার সবিস্তার
সুইমিং। একটি ফুল বডি ওয়ার্কআউট। করা চাই যথানিয়মে। নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে। রইল বিশেষজ্ঞ পরামর্শ
শারীরিক সুস্থতার গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর একটি সাসটেইনেবিলিটি। ব্যায়ামের দীর্ঘমেয়াদি ফল উপভোগ করা যায়, এমন অ্যাকটিভিটিজ সন্ধানের সময় বর্তমান সময়সূচি, লক্ষ্য এবং সামগ্রিক প্রয়োজন খেয়াল রাখা চাই। ফিটনেস রুটিনে কিছু বৈচিত্র্য বজায় রাখাও জরুরি। এর ফলে বিভিন্ন ওয়ার্কআউট স্টাইল ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে এবং সামগ্রিক গতি বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।
সাঁতার এমনই এক ব্যায়াম, যা চমৎকার ফল বয়ে আনে। মানসিক চাপ কমানো, শক্তি বৃদ্ধি করা, হৃদ্পিণ্ডকে ভালো রাখাসহ সাঁতারের রয়েছে নানা উপকারিতা।
এটি একটি ফুল বডি ওয়ার্কআউট, যা শরীরের বেশির ভাগ অংশের জন্য সহায়ক।
আর্থ্রাইটিস, মাল্টিপল স্কে¬রোসিস, অস্টিওপোরোসিস বা জয়েন্টের সমস্যা যাদের রয়েছে, তাদের জন্য সাঁতার বেশ উপকারী। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ আয়োজিত এক গবেষণার অংশ হিসেবে অংশগ্রহণকারীরা তিন মাস ধরে সপ্তাহে তিনবার করে প্রতিবার ৪৫ মিনিট সাঁতার কাটেন। তাতে দেখা যায়, তাদের শারীরিক সীমাবদ্ধতা দূর হয়েছে এবং পেশিশক্তির উন্নতি ঘটেছে। এমনকি জয়েন্টের ব্যথা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে বলেও অনুভব করেন তারা।
যেকোনো শরীরের ধরন, ফিটনেস লেভেল এবং মেডিকেল কন্ডিশনে সাঁতার এক চমৎকার এক্সারসাইজ। যদি ডিজঅ্যাবিলিটি বা ইনজুরি থাকে, তাহলে সাঁতার হতে পারে একটি দারুণ ওয়ার্কআউট। যেকোনো কারণেই হোক, শরীরে যদি ব্যথার অনুভূতি থাকে, এই ওয়ার্কআউটে তা অনেকটাই উপশম হবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
গর্ভবতী অবস্থায়ও সাঁতার কাটা নিরাপদ বলে গণ্য করা হয়; কেননা, এতে আঘাত পাওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। তা ছাড়া এ সময়ে করা যেতে পারে অ্যাকোয়া ব্যায়াম।
সার্টিফাইড পারসোনাল ট্রেইনার এবং রেট্রো ফিটনেস কোচ সানজিদা লুনার মতে, ‘অন্যান্য দৌড়ের মতো কার্ডিও ব্যায়াম শরীরে উচ্চ প্রভাব ফেলে। এসব ব্যায়াম নিতম্ব ও হাঁটুতে মাংসপেশি বৃদ্ধি করে শরীরের সেই জায়গার ওজন চার থেকে পাঁচ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে। অন্যদিকে নিয়ম মেনে সাঁতার কাটলে এ ধরনের সমস্যা অনেকটাই সেরে যায়।’
‘সাঁতারে শরীরের প্রতিটি পেশির ব্যবহার ঘটে। শরীরের মূল অংশ বাহু, কাঁধ ও বুকের পেশিগুলো পানির মধ্যে শক্তি প্রয়োগ করে শরীরকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। এ ছাড়া পানিতে কিক করা অবস্থায় গ্লুটস, হ্যামস্ট্রিংস, কোয়াডস ও পায়ের নিম্নাংশ সক্রিয় থাকে,’ যোগ করেন তিনি।
অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশি এই ফিটনেস কোচ আরও বলেন, ‘সাঁতারের মধ্যে কার্ডিও ব্যায়াম ও স্ট্রেন্থ ট্রেইনিং—উভয়ই অন্তর্ভুক্ত। এটি সম্পূর্ণ শরীরের একটি দুর্দান্ত ব্যায়াম, যা শক্তি ও সহনশীলতা তৈরি করে পেশিকে টোন রাখে।’
অন্যান্য কার্ডিও ব্যায়ামের মতো সাঁতারও হৃদ্পিণ্ড ভালো রাখে। ২০১২ সালে ৬০ বছর বয়সী ৪৩ জনের ওপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি। তাতে অংশগ্রহণকারীদের প্রি-হাইপারটেনশন বা স্টেজ ওয়ান হাইপারটেনশন ছিল। ১২ সপ্তাহ সাঁতার কাটার পর তাদের অ্যাভারেজ সিস্টোলিক রক্তচাপ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। তাদের কার্ডিওভাসকুলার হেলথের উন্নতিও পরিলক্ষিত হয়েছিল। ন্যূনতম আট সপ্তাহ ধরে মাঝারি মাত্রায় সাঁতার কাটলে অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। এটি সিস্টোলিক রক্তচাপ হ্রাস, ভাসকুলারে দৃঢ়তা এবং মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ উন্নত করতে সাহায্য করে।
লক্ষ্য যদি হয় ওজন কমানো, তাহলে ক্যালরি বার্ন করার জন্য সাঁতার কাটা হতে পারে অন্যতম সেরা উপায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৮৫ পাউন্ড ওজনের ব্যক্তি ৩০ মিনিট ধরে সাঁতার কেটে প্রায় ৪২০ ক্যালরি বার্ন করতে পারেন।
বিষণ্নতা এবং মানসিক চাপের ওপর সাঁতারের প্রভাব কেমন, তা নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ফিজিক্যাল এডুকেশন, স্পোর্টস অ্যান্ড হেলথ আয়োজিত এক গবেষণায় অনুসন্ধানকারীরা সাঁতারের আগে এবং পরে ১০১ জনকে নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। তাদের মধ্যে ৪০ জন সাঁতার কাটার আগে মানসিক চাপ ও মৃদু বিষণ্নতা অনুভব করেছিলেন। সাঁতার কাটার পর সেই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় মাত্র ৮।
সূচনা সমাচার
সাঁতার শেখার কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। চাইলে যেকোনো বয়সেই শুরু করা যায়। সানজিদা লুনা বলেন, ‘শিক্ষানবিশ হলে স্থানীয় জিম ও সুইমিংপুলের দ্বারস্থ হয়ে, বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে দীক্ষা নিতে পারেন। পানিতে কীভাবে শরীরের ভারসাম্য রাখতে কিংবা চলাচল করতে হবে, তাহলে তা জেনে যাবেন। ভারসাম্য সম্পর্কে একবার বেসিক আইডিয়া হয়ে গেলে আরও দক্ষতার সঙ্গে সাঁতার কাটতে পারবেন।’
সাঁতারের সঠিক সরঞ্জাম থাকলে এক্সারসাইজ সেশনগুলো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে এবং তা ওয়ার্কআউট সেশনে সহায়তা করতে পারে। সাঁতারে সহায়ক ও শরীরের সঙ্গে জুতসই ফিট এমন পোশাক পরুন। আরও যা থাকা চাই—
তোয়ালে: সাঁতার শেষে নিজের শরীর শুকাতে এবং নিজেকে উষ্ণ রাখতে তোয়ালে রাখুন।
সুইম ক্যাপ: পানির ক্ষতিকর উপাদান থেকে চুলকে সুরক্ষা দেবে এই ক্যাপ। চুল লম্বা হলে সাঁতারের সময়ে ঠিকঠাক সামনে দেখতে পারা কষ্টসাধ্য হতে পারে। এ সমস্যার সমাধানেও দারুণ কাজে দেয় সুইম ক্যাপ। এটি পুলে স্ট্রিমলাইন রাখতেও সাহায্য করবে।
গগলস: এটি চোখকে সুরক্ষা দেবে এবং পানির নিচে ভালোভাবে দেখতে সাহায্য করবে। ভালো কোয়ালিটির গগলস শুধু আরামের অনুভূতিই দেবে, সেটি ফুটো হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও কম।
কিক বোর্ড: অনেক ইনডোর পুলে কিক বোর্ড থাকে, যা সাঁতারুরা ধার নিতে পারেন। অন্যথায়, নিজেকেই এর ব্যবস্থা করতে হবে। শরীরের ওপরের অংশ দিয়ে বোর্ডের দিকে ঝুঁকুন এবং কিক দেওয়ার পাশাপাশি শরীরের নিচের ওয়ার্কআউটে মনোনিবেশ করুন।
পুল বয়: কিক বোর্ডের বিপরীতে এটি হাতের কাজে ফোকাস করতে সাহায্য করবে। একে রাখতে হবে ঊরুর ওপরের অংশে। হাত দিয়ে সাঁতার কেটে শরীর অগ্রসর করার সময় এটি পা ভাসাতে সাহায্য করে।
যেখানে যেভাবে
চাইলে ইনডোর বা আউটডোর—যেকোনো পুলে সাঁতার কাটা যেতে পারে। স্থানীয় জিম, কমিউনিটিভিত্তিক পুল হতে পারে সম্ভাব্য বিকল্প। তবে এসব জায়গায় সাঁতার কাটার কিছু নিয়ম রয়েছে। সাঁতারের বিভিন্ন লেভেলের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ল্যাপ থাকে বলে চাইলেই অন্যান্য সাঁতারুর সঙ্গে একই লেনে সাঁতার কাটা যাবে না।
কোনো এক্সারসাইজ প্রোগ্রাম শুরুর আগে সব সময় যথাযথ বিশেষজ্ঞ কিংবা চিকিৎসকের অধীনে চেকআপে থাকা জরুরি। তিনি যদি সাঁতার কাটার ব্যাপারে কোনো সাহায্যের প্রয়োজন উপলব্ধি করেন, তাহলে বিভিন্ন সাঁতারের গিয়ার ব্যবহারে পরামর্শ দিতে পারেন।
নতুনদের জন্য
এই ব্যায়ামে যথাসম্ভব পুল বয় ও কিক বোর্ড ব্যবহার করুন। এগুলো যে কাউকে নিয়মিত ল্যাপে সাঁতার কাটতে সাহায্য করে। সেই সঙ্গে ওয়ার্কআউটকে উত্তেজনাপূর্ণ রাখার জন্য এগুলো দুর্দান্ত।
‘আপনি কতগুলো ল্যাপ করতে যাচ্ছেন বা কতক্ষণ সাঁতার কাটার পরিকল্পনা করছেন, তা আগে থেকে ঠিক করে তবেই পুলে আসা ভালো। যদি সাঁতারে নতুন হয়ে থাকেন, তাহলে পুলের দৈর্ঘ্য চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। পুলের এক মাথা থেকে অপর মাথায় প্রতিবার এসে না থেমে একবারে কিছু সময় সাঁতার কাটার চেষ্টা করুন,’ বলেছেন সানজিদা।
কিক বোর্ড ও পুল বয় ব্যবহার
প্রথমে এক ল্যাপ (পুলের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত) সাঁতার কাটুন।
দ্বিতীয় ল্যাপের জন্য একটি কিক বোর্ড ব্যবহার করুন; এ পর্যায়ে এগিয়ে যেতে শুধুই পায়ের ওপর নির্ভর করুন।
তৃতীয় ল্যাপের জন্য একটি পুল বয় ব্যবহার করুন; এ ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে শুধু হাতের ওপর নির্ভর করুন।
ফুল বডি ওয়ার্কআউটের জন্য ১৫ থেকে ২০ মিনিট ধরে ওপরের তিনটি ধাপ পুনরাবৃত্তি করুন।
৫ মিনিট রিপিট
পুলের উভয় প্রান্তে ১৫ থেকে ৩০ সেকেন্ড বিরতি নিয়ে পাঁচ মিনিট ধরে সাঁতার কাটুন।
পরবর্তী পাঁচ মিনিটের জন্য কিক বোর্ড ব্যবহার করুন।
ফুল বডি কার্ডিও ওয়ার্কআউটের জন্য তিনবার পুনরাবৃত্তি করুন।
সাঁতার কাটা ও পানিতে হাঁটা
প্রথমে এক ল্যাপ সাঁতার কাটুন।
তারপর যেখান থেকে শুরু করেছিলেন, দ্রুত হেঁটে সেখানে ফিরে আসুন। পানিতে হাঁটার সময় যেন ডুবে না যান, সে জন্য গভীর পানিতে বোয়েন্সি বেল্টের প্রয়োজন হতে পারে।
১৫ থেকে ২০ মিনিট ধরে এ চর্চার পুনরাবৃত্তি করুন।
সুইমিং এক্সারসাইজে ব্রেস্ট স্ট্রোক, ব্যাক স্ট্রোক ও সাইড স্ট্রোক শেখারও পরামর্শ দিয়ে থাকেন সানজিদা লুনা। যদিও এগুলো সম্পূর্ণ বডি ওয়ার্কআউট; এর পাশাপাশি ব্যাক স্ট্রোক পা শক্তিশালী করবে এবং সাইড স্ট্রোক শরীরের কোর ও পার্শ্বকে শক্তিশালী করতে রাখবে ইতিবাচক ভূমিকা।
সাঁতার এমন এক ব্যায়াম, যা সব বয়সের ক্রীড়াবিদদের উপকারে আসতে পারে। তবে পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার আগে নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া চাই। অন্যদিকে, সাঁতার নিয়ে কোনো উৎকণ্ঠা কিংবা জিজ্ঞাসা থাকলে একজন হেলথ প্রফেশনালের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া জরুরি।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট