মনোজাল I ডানাকাটা চোখ
উইংগড আইলাইনার। শুধু ট্রেন্ডের সঙ্গে থাকতেই নয়, ‘অপশক্তি’র নজর থেকে চোখ সুরক্ষা দিতেও!
‘ডানাকাটা পরি’র সঙ্গে পরিচিত হলেও ‘ডানাকাটা চোখ’ উপমাটা অনেকেই হয়তো প্রথম শুনলেন। এটি আসলে একটি বিউটি টার্ম, যদিও এর আক্ষরিক বাংলা ঠিক এমন নয়; বরং ‘ডানাযুক্ত চোখ’ বললে সঠিক হতো! তবে একটু মজা করে বললে টার্মটির বর্ণনার সঙ্গে এই উপমা বেশ মানিয়ে যায়। ইংরেজিতে কথাটি হচ্ছে ‘উইংগড আইলাইনার’। চোখের মেকআপে ট্রেন্ডি, আধুনিক একটি লুক। আপনার চোখকে পপ করার দুর্দান্ত এক উপায়। এই টার্মের সঙ্গে অপরিচিত হতে পারেন অনেকে। ভাবতে পারেন, এর আবার অর্থ কী? প্রকৃত অর্থে, এটি কেবলই একটি নকশা, যার পেছনে তেমন কোনো গভীর অর্থ নেই। তবে আপনি যদি মিসরীয় সৌন্দর্যভাবনায় প্রভাবিত হন কিংবা একটু গভীরভাবে চিন্তা করতে পছন্দ করেন, তাহলে এটি অনেক অর্থ বহন করে, রীতিমতো মন্ত্রশক্তির ক্ষমতা রাখে বলা যায়।
উইংগড বা ডানাযুক্ত আইলাইনারকে বলা হয় শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক, যা একই সঙ্গে জীবনের সীমাবদ্ধতা এবং সীমাবদ্ধতামুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে। প্রায় শতবর্ষ আগে থেকে এই বিশ্বাসকে ভিত্তি করে চলে আসছে এভাবে চোখ সাজানোর ট্রেন্ড। মিসরীয়রা বিশ্বাস করতেন, ডানাযুক্ত আইলাইনারে তাদের চোখ আরও বড় ও উজ্জ্বল দেখাবে, যা তাদেরকে মন্দ আত্মা থেকে রক্ষা করবে। প্রকৃতপক্ষে, তারা এই অনুশীলনের মাধ্যমে এতটাই প্রভাবিত ছিলেন, এমনকি দেব-দেবীদের চিত্রিত প্রাচীন শিল্পকর্মেও এটি ব্যবহার করতেন। তাদের সেই বিশ্বাস বা সৌন্দর্যচর্চা অনুসরণ করেই কি না, জানি না; তবে উইংগড আইলাইনারের সেই ট্রেন্ড বর্তমানেও খুব ভালোভাবে বিরাজ করছে। বিশ্বজুড়ে অনেকে তাদের দৈনন্দিন সৌন্দর্যের রুটিনের অংশ হিসেবে কিংবা বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোতে এভাবে নিজের চোখ সাজাতে ভালোবাসেন। বলা হয়ে থাকে, মৌখিকভাবে কিছু না বলে চেহারার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করার উপায় হিসেবে এটি ব্যবহার করেন তারা। ব্যাপারটি একটু ব্যাখ্যা করা যাক। ধরুন, জাঁকজমকপূর্ণ কোনো অনুষ্ঠানে যেতে বা উপস্থিত থেকেও অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে আপনি লজ্জাবোধ কিংবা নার্ভাস বোধ করেন, হাঁটতে বা নিজের উপস্থিতি নিয়ে অস্বস্তিতে ভোগেন, তাহলে আপনার জন্য পারফেক্ট এই সাজ। কেন? যেন একটি শব্দও না বলে, চোখে আঁকা সুন্দর ডানা দেখিয়ে আপনি হয়ে উঠতে পারেন দৃষ্টি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
মূলত প্রাচীন মিসরে এই ট্রেন্ডের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়, যেখানে নারীরা তাদের চোখকে প্রখর রোদ কিংবা মরুভূমিপীড়িত জমির প্রবাহিত বালু থেকে রক্ষা করার উপায় হিসেবে চোখের ওপরের পাতা বরাবর আইলাইনার পরতেন। পরে ভারতীয় সংস্কৃতির মতো অন্যান্য সংস্কৃতির সঙ্গে এটি যুক্ত হয়ে যায়, যখন জনপ্রিয় অভিনেত্রীরা পর্দায় এটি পরা শুরু করেন। গবেষকদের মতে, এই অভিনেত্রীরা চীনা অভিনেত্রীদের অনুকরণের চেষ্টা করছিলেন, যারা এটি তাদের দৈনন্দিন মেকআপ রুটিনের অংশ হিসেবে পরতেন। পরে এই প্রবণতা জাপান ও কোরিয়ার মতো এশিয়ার অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। তবে এখন আর এটি পর্দার তারকা কিংবা বিশেষ অনুষ্ঠানে পরার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। কালের বিবর্তনে এমন একটি ক্ল্যাসিক বিউটি লুকে পরিণত হয়েছে, যা সৌন্দর্যপিয়াসী নারীরা কয়েক দশক ধরে পরছেন। বিশেষ করে যারা নিজেকে দুঃসাহসিক প্রমাণ করতে চান কিংবা মনে মনে অনেক সাহসী, তারাই এই চর্চায় আগ্রহ বোধ করেন বলে ধারণা করা হয়।
শুনতে বা হঠাৎ দেখতে কঠিন মনে হলেও ব্যাপারটি মোটেই জটিল নয়। আপনি সাহসী হলে নিজেও ট্রাই করতে পারেন। এক সাজেই যদি আশপাশের অশুভ শক্তি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যায়, মন্দ হয় না; তাই না? আঁকার জন্য লিকুইড লাইনার বা পেনসিল ব্যবহার করতে পারেন। তবে খেয়াল রাখা চাই, সেগুলো অতি নরম কিংবা খুব শক্ত যেন না হয়। অবশ্য নরম টেক্সচার আছে—এমন একটি পেনসিল দিয়ে শুরু করলে ভালো। কেননা, হার্ড পেনসিল ব্যবহার করলে উইংগড এফেক্ট তৈরি করা কঠিন হতে পারে। চোখের ওপরের ল্যাশ লাইনে লাইনার লাগিয়ে, আপনার চোখের পাতার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ খালি রেখে দিন (এটিতে কোনো লাইনার রাখবেন না)। তারপর চোখের বাইরের কোণ থেকে শুরু করে পাতার মাঝখানে শেষ হয়ে একটি ঊর্ধ্বগামী বক্ররেখা আঁকুন। ব্যাপারটি যেন ডানার আকৃতি হয়, খেয়াল রাখা চাই। এবার পছন্দসই শেড ব্যবহার করে বাকি চোখের মেকআপটুকু সেরে নিন। ব্যস, হয়ে গেল। এবার আপনি সুরক্ষিত!
মনে হতে পারে, এই সাজ শুধুই তরুণীদের জন্য কিংবা এটি অনেক পুরোনো স্টাইল। তাহলে বলছি, দুটো ধারণাই ভুল। এখানে বয়স কোনো ব্যাপার নয়; সাহসটাই আসল। বিশেষজ্ঞদের মতে, সৌন্দর্যবিশ্বে এটি সব সময়ই ট্রেন্ডে ছিল, থাকবে। বলা হয়, সাজতে পছন্দ করেন, সারা বিশ্বে এমন নারীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ এখনো উইংগড আইলাইনার ব্যবহার করেন। এটি ব্যবহার করার পেছনে প্রত্যেকের নিজস্ব কারণ রয়েছে। তবে সাধারণ কারণগুলো হলো, এটি আপনাকে আরও আত্মবিশ্বাসী এবং সুন্দর দেখাতে সাহায্য করবে। আপনার চোখকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তোলার সহজাত ক্ষমতা রয়েছে এর। তা ছাড়া এটি ব্যবহার ও প্রয়োগ করা খুবই সহজ। যেমন লাতিন আমেরিকার নারীরা বিশ্বাস করেন, উইংগড আইলাইনার অপ্রস্তুত নারীত্ব ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। এর সঙ্গে ব্যক্তিগত প্রেম-ঘৃণারও সম্পর্ক রয়েছে। ওই যে কথায় আছে না—বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর!
আসলে কে কী বিশ্বাস করছেন, তার চেয়ে বড় কথা, বর্তমানে উইংগড আইলাইনার অন্যতম জনপ্রিয় মেকআপ ট্রেন্ড। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আপনিও হয়ে উঠতে পারেন ট্রেন্ডি। তা ছাড়া এটি যেকোনো আকারের চোখেই দারুণ সুন্দর মানায়। একে ক্যাট-আইলাইনার কিংবা ফ্লিক আইলাইনারও বলা হয়; কারণ, এই সাজে আপনি যখন মাথা ঘুরিয়ে তাকাবেন, সাজটিকে একটি বিড়ালের ডানার মতো দেখাবে। অবশ্য যেকোনো মেকআপ লুকের সঙ্গে মানানসই হলেও ব্রাউন ও পিঙ্কের মতো নিউট্রাল আইশ্যাডো রঙের সঙ্গে সবচেয়ে ভালো দেখায়।
একটু ভালোভাবে আয়ত্ত করলেই বুঝবেন, এর কৌশলটি সহজ; তবে প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি তা করতে চান কি না। সৌন্দর্য গবেষকদের মতে, যারা মেকআপ করতে ভয় পান, তাদের এটি অবশ্যই একবার ট্রাই করা উচিত। তাতে তারা আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবেন। আর যারা মেকআপ ভালোবাসেন, তারা তো করবেনই। অন্তত এই বিশ্বাস থেকে যে, এতে তাদের সৌন্দর্য কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। আমাদের দেশে ‘নজর লাগা’ বলে একটি টার্ম আছে না? যারা বিশ্বাস করেন, তাদের সৌন্দর্যে, তারুণ্যে বা জীবনযাপনে নজর লাগার ভয় আছে, তারাও ট্রাই করতে পারেন। মিসরীয়রা শতাব্দী ধরে যে বিশ্বাস থেকে এই বিউটি ট্রেন্ড লালন করে আসছেন, তাতে একেবারেই কোনো সত্যতা নেই, এটি ঠিক স্বীকার করা যায় না। ওই যে বিশ্বাস! আপনি মনেপ্রাণে কিছু বিশ্বাস করলে তা শক্তিতে রূপ নিতে বাধ্য। ট্রেন্ডি, দেখতে সুন্দর এবং মন্দ আত্মা থেকে আপনাকে সুরক্ষিত রাখবে—এই তিন বিশ্বাস থেকে উইংগড আইলাইনার আপনার সঙ্গী হয়ে উঠতেই পারে। তাই না?
রত্না রহিমা
মডেল: জলি
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল