টেকসহি I নৃশংসতা নিবৃত্তে
নিরীক্ষায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বিশ্বের নানা দেশে। অনেক ফ্যাশন ব্র্যান্ডই মেনে চলছে সেই নিয়ম। বাড়ছে ব্যক্তিসচেতনতাও
গেল কয়েক বছরে ফ্যাশন বিশ্বে উল্লেখযোগ্য হারে কাটতি কমেছে ক্রুয়েল ম্যাটেরিয়ালের। ফ্যাশন-সচেতনেরাও তাদের ক্লজেট থেকে কমিয়ে এনেছেন অ্যানিমেল ডিরাইভড ম্যাটেরিয়াল। অর্থাৎ পশু থেকে সংগৃহীত উপাদানে তৈরি পোশাক। কারণ? ক্রুয়েলটি। কখনো বন্য পশু ফাঁদে ফেলে, আটকে রেখে হত্যা তো কখনো অ্যানিমেল ফার্মিংয়ের মাধ্যমে মাস-প্রোডাকশনের জন্য নির্দয়ভাবে সংগৃহীত হচ্ছে ফ্যাশনেবল পোশাকের কাঁচামাল। সব ক্ষেত্রেই পশুদের এত পীড়া দেওয়ার কারণ—একটা কোট, ব্যাগ অথবা জুতা তৈরি। যার ঘোর বিরোধী এখনকার ফ্যাশন-সচেতনেরা। আর হবেন নাই-বা কেন, বন্য পশুদের অধিকার লঙ্ঘন করার পাশাপাশি আটকে রেখে অত্যাচার করে, মেরে ফেলার নজির ফ্যাশন বিশ্বে মেলা। কারণ, লাক্সারিয়াস ব্র্যান্ডগুলোর এক্সোটিক স্কিনে তৈরি নানা ফ্যাশনেবল আইটেমের অন্যতম কাঁচামাল যে বাঘ, ভালুক, হরিণ, জেব্রা, অস্ট্রিচ ও কুমির, সাপের মতো নানা সরীসৃপ প্রাণীর চামড়া আর পালক। অন্যদিকে ফার্মিংয়ের মাধ্যমে বেড়ে ওঠা পশুদের আজীবনই খাঁচায় পুরে রাখা হয়, মারা হয় এবং পরবর্তী সময়ে নানা পেইনফুল ট্রিটমেন্ট আর ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহারে সংগ্রহ করা হয় কাঁচামাল। অনেক সময় জ্যান্ত অবস্থাতেই ছাড়িয়ে নেওয়া হয় চামড়া। অপরিণত অবস্থায় হত্যার প্রমাণও মেলে অহরহ। শুধু ভালো মানের কাঁচামাল সংগ্রহ করার জন্য। কিন্তু সেই অধিকার কি ফ্যাশন বিশ্বের আছে আদৌ? এ নিয়ে সোচ্চার এখন অনেক ফ্যাশন ব্র্যান্ড, ডিজাইনার থেকে শুরু করে অনুরাগীরা। এমনকি পেটা (পিপল ফর দ্য এথিক্যাল ট্রিটমেন্ট অব অ্যানিমেলস) তৈরি করে দিয়েছে চটজলদি সহজ উপায়ে ক্রুয়েলটি ম্যাটেরিয়াল শনাক্তের গাইডলাইন। ক্রুয়েলটি ফ্রি, ভেগান ক্লদিং কেনার জন্য।
লেদার এবং এক্সোটিক স্কিন
উৎস: গরু, শূকর, ছাগল, ক্যাঙারু, উটপাখি, বিড়াল কিংবা কুকুর—লেদার সংগৃহীত হয় এসব পশুর চামড়া থেকে। প্রায়শই পণ্যে আলাদা করে লেবেল করা হয় না বলে কোথা থেকে চামড়া এসেছে বা কিসের চামড়া দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, তা সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয় না। সাপ, অ্যালিগেটর, কুমিরের মতো সরীসৃপের চামড়া ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে ‘এক্সোটিক’ হিসেবে গণ্য করা হয়। যা থেকে তৈরি হয় হ্যান্ডব্যাগ, জুতাসহ নানা ধরনের পণ্য।
জটিলতা: চামড়ার একটা বড় অংশ আসে গরু থেকে। দুধ ও মাংসের জন্য যেসব গরু হত্যা করা হয়, সেগুলোর চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে ফ্যাশন অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই একে মাংস এবং ডেইরি ইন্ডাস্ট্রির বাই প্রোডাক্ট বলা হয়। কিন্তু সন্দেহ রয়েছে এর সত্যতা নিয়ে। পরিবেশের জন্য লেদার সবচেয়ে ক্ষতিকর কাঁচামাল। কারণ, গরু, ছাগল বা সাপ—যে উৎস থেকেই চামড়া তৈরি করা হোক না কেন, ট্যানিং ও ডায়িংয়ের মাধ্যমে মানুষের পরার উপযোগী হয়ে থাকে; যার ফলে পরিবেশ বিপজ্জনকভাবে দূষিত হয়।
বিকল্প: অ্যানিমেল ফ্রি লেদার দারুণ জনপ্রিয় এখন বিশ্বজুড়ে। হাই কোয়ালিটি অ্যানিমেল ফ্রি লেদার তৈরি হয় নানা রকম উপাদান থেকে। নন-অ্যানিমেল মাইক্রোফাইবার, রিসাইকেলড নাইলন, পলি ইউরেথিন বা পিউ ছাড়াও রয়েছে মাশরুম ও আনারস থেকে তৈরি প্ল্যান্ট বেসড লেদার। টপ শপ কিংবা জারার মতো সাশ্রয়ী ব্র্যান্ড থেকে স্টেলা ম্যাককার্টনি এবং বেবের মতো হাই এন্ড ডিজাইনার ব্র্যান্ডগুলোতে দেদার বিকোচ্ছে এসব অ্যানিমেল ফ্রি লেদারের ফ্যাশন আইটেম, ‘ভেগান লেদার’-এর লেবেলে। শিগগির বাজারে মিলবে ল্যাবরেটরিতে উৎপাদিত বায়ো-ফ্যাব্রিকেটেড লেদার; যা দিয়ে ফ্যাশন বিশ্বে অ্যানিমেল ফ্রি লেদারের চাহিদা অনায়াসেই মেটানো সম্ভব হবে—বিশ্বাস সংশ্লিষ্টদের।
উল, শারলিং, ক্যাশমের, আনগোরা
উৎস: উল সংগৃহীত হয় ভেড়া অথবা ভেড়ার বাচ্চা থেকে। শারলিং হচ্ছে রোমসহ ভেড়ার চামড়া। আনগোরা হচ্ছে খরগোশের পশম, আর ক্যাশমের হচ্ছে কাশ্মীরি ছাগলের চুল।
জটিলতা: আবহাওয়ার প্রতিকূল তাপমাত্রা থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ঠিক ততটুকু উল গজায় একটি ভেড়ার গায়ে। তাই যখন এটা চেঁছে ফেলা হয়, পশুগুলোর বেঁচে থাকা ভীষণ কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে। এমন সব তথ্যও থামাতে পারেনি উল ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে। শুধু উল সংগ্রহ করেই ক্ষান্ত নয়, তাদের কান ছিদ্র করে দেওয়া, লেজ কেটে ফেলা এবং পুরুষ ভেড়াদের জননশক্তি নষ্ট করে দেওয়ারও নজির রয়েছে। তা-ও কোনো ধরনের ব্যথানাশক প্রয়োগ না করেই। এ ছাড়া উল পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। ভূমির ক্ষতিসাধন ছাড়াও পানিদূষণ এবং আবহাওয়া পরিবর্তনেও নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে উলের। ভেড়ার বাচ্চা, ছাগল আর খরগোশের ওপর একইভাবে নানা অত্যাচার চালানো হয়, মেরেও ফেলা হয় ফ্যাশনের নানা পণ্য উৎপাদনের জন্য।
বিকল্প: ভেগান শারলিং ছাড়াও আরামদায়ক ক্রুয়েলটি ফ্রি সোয়েটার মিলছে এখন অহরহ। এইচঅ্যান্ডএম, জারাতে পাওয়া যাবে উল ফ্রি কোট আর অন্যান্য অ্যানিমেল ফ্রেন্ডলি ক্লোদিং। পিছিয়ে নেই হাই এন্ড ডিজাইনার ব্র্যান্ডগুলোও। ম্যানুফ্যাকচারাররাও তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অভিনব এবং উন্নত মানের সব ক্রুয়েলটি ফ্রি ম্যাটেরিয়াল তৈরিতে ব্যস্ত এখন। যেগুলো পরিষ্কারে পানি কম খরচ হবে, শুকাবে জলদি এবং পরিবেশবান্ধবও।
ফার
উৎস: ফ্যাশন বিশ্বে বহুল ব্যবহৃত এটি। মূলত পশুর ত্বকের সঙ্গে একদম ঘেঁষে থাকা পশম থেকে সংগৃহীত হয়। ভালুক, শিয়াল, মিঙ্ক, খরগোশ, র্যাকুন, এমনকি কুকুর আর বিড়ালেও রেহাই নেই ফার ইন্ডাস্ট্রি থেকে।
জটিলতা: বন্য প্রাণী হত্যার পাশাপাশি ফার্মে পালিত পশুগুলোর ওপরও নিদারুণ অত্যাচার চালানো হয় ফার সংগ্রহের জন্য। কোনো কোনো পশুকে আজীবন খাঁচায় পুরে রাখা হয়। এ ছাড়া ইলেকট্রোকিউটেড, গ্যাসড এবং পয়জনডও করা হয় ফার সংগ্রহের আগে। এ ক্ষেত্রে অনেক পশু মারা যায়। মারা না গেলেও আজীবন ব্যথা, ভয় ও একাকিত্বের মতো নানা সমস্যা দেখা দেয় পশুগুলোর মাঝে।
বিকল্প: গ্যাপ ইন্ক, এইচঅ্যান্ডএম এবং জারার স্বত্বাধিকারী ইন্ডিটেক্স—বিশ্বের তিনটি বড় ব্র্যান্ড বর্তমানে সম্পূর্ণ ফার ফ্রি নীতিতে চলে। সম্প্রতি গুচি এবং মাইকেল করসও ফার ব্যানের ঘোষণা দিয়েছে। নরওয়ে থেকে ঘোষণা এসেছে ফার ফার্মি ব্যান করার। বিকল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ফারের সব অপশন।
সিল্ক এবং ডাউন ফেদার
উৎস: রেশম পোকা তার গুটি তৈরির জন্য যে তন্তু বোনে, মূলত সেটা থেকেই তৈরি হয় সিল্ক। আর ডাউন হচ্ছে পাখির ত্বকের সবচেয়ে কাছাকাছি পালক, যা মূলত হাঁস থেকে নেওয়া হয়। পাফি জ্যাকেট থেকে বিছানা-বালিশ তৈরির জন্য। এ ছাড়া অন্যান্য পাখির পালক ব্যবহৃত হয় পোশাক ও অ্যাকসেসরিজ সাজানোর জন্য।
জটিলতা: রেশমের গুটি থেকে রেশম সংগ্রহের জন্য পোকাগুলোকে ফুটন্ত গরম পানিতে ছেড়ে দেওয়া হয় জীবন্ত অবস্থায়। এ ছাড়া চামড়ার পরপরই তালিকায় আসে সিল্কের নাম, যা পরিবেশের জন্য বেশি বিপজ্জনক। আর ডাউন সংগ্রহের জন্য জ্যান্ত পাখির দেহ থেকে টেনে টেনে পালক ছিঁড়ে নেওয়া হয়।
বিকল্প: নাইলন, মিল্কউইড—পড ফাইবার, পলিয়েস্টার, সিল্ক কটন ট্রি এবং রেয়ন হচ্ছে অ্যানিমেল ফ্রি সিল্কের জুতসই অপশন। এগুলো সহজলভ্য এবং সুলভ। বাজারে ডাউন ফ্রি ফ্যাশনের বিকল্পও মিলবে। শুধু খুঁজে নেওয়ার দেরি।
জাহেরা শিরীন
ছবি: সংগ্রহ