রম্যরস I বিলিভ ইট অর নট আমি গরু, আপনিও!-সুমন্ত আসলাম
চায়ে ছোট্ট করে চুমুক দিয়ে সাজিদ সাহেব বললেন, ‘দেশের যা অবস্থা, এবার কি মানুষ কোরবানি-টোরবানি দেবে?’
‘যারা দেওয়ার তারা দেবেন। আর যাদের দেওয়ার সামর্থ্য বরাবরের মতো নড়বড়ে, তারা হয়তো দেবেন না।’ নিজের কাপেও চুমুক দিলেন বসির নিয়াজ, ‘তা তুমি কি এবার দেবে?’
‘দেব।’ নিচু গলায় বন্ধুর প্রশ্নের উত্তর দিলেন সাজিদ সাহেব।
‘কী দিবে?’
‘গরু।’
‘তুমি গরু?’ স্মিত হেসে বসির নিয়াজ বললেন, ‘আমিও।’
ড্রয়িংরুমে বসা দুই বন্ধুর কথোপকথনের মাঝে ইফতি ঢুকল হঠাৎ। বসির নিয়াজের ছেলে সে, ক্লাস ফোরে পড়ে। কাঁধের ব্যাগটা পাশের সোফায় ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘শিহাব স্যার আমাকে তো তাহলে ঠিকই বলেছেন!’
বসির নিয়াজ খুব আগ্রহ নিয়ে বললেন, ‘তোমাকে কী বলেছেন শিহাব স্যার?’
‘গরুর বাচ্চা গরু!’ চেহারা হতাশ করে ধপাশ করে সোফায় বসল ইফতি।
২
স্কুলে ‘দ্য কাউ’ রচনা পড়েনি, এমন মানুষ পাওয়া কঠিন ছিল একসময়—দ্য কাউ ইজ আ ডমেস্টিক অ্যানিমেল। শি হ্যাজ ফোর লেগস, টু হর্নস, ওয়ান টেইল…।
স্কুলজীবনের প্রথম ইংরেজি রচনা পড়া আমাদের—দ্য কাউ। কেন ‘গরু’ নিয়েই প্রথম পড়তে হবে আমাদের? আর কি কোনো জীবজন্তু নেই এই দুনিয়ায়, বাংলাদেশে? জীবজন্তু নিয়ে পড়তে হলে তো রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে পড়া দরকার ছিল আমাদের। কারণ, ওটা আমাদের জাতীয় পশু; গরু তো নয়।
গরু নিয়ে জীবনের প্রথম রচনাটা পড়ার উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ আছে। মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে মায়ের দুধের পর প্রথম যে খাবারটা দেওয়া হয় আমাদের, সেটা হলো গরুর দুধ এবং সারা পৃথিবীতে যত পাস্তুরিত ও গুঁড়ো দুধ পাওয়া যায়, তার সবই গরুর দুধ।
স্কুলে ভর্তি হলেন আপনি। নিজের ‘মানুষ’ পরিচয়ের বাইরে যে পরিচয়টা স্যার বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে করিয়ে দেবেন সবাইকে, তা হলো—‘গরু, গরু কোথাকার!’ হাতের বেতটা নাচিয়ে নাচিয়ে তিনি বলেছেন, ‘কিছুই তো পারিস না! তুই তো দেখি আস্ত একটা গরু। দাঁড়া, কত গরু পিটিয়ে মানুষ করলাম, আর তুই তো তুই। তোকেও…।’
স্কুল পেরিয়ে কলেজ, ভার্সিটি। যৌবনের ডাক, ভালোবাসায় পড়লেন আপনি—ফল ইন লাভ। যদি আপনার ব্যক্তিত্বের ঘাটতি থাকে, ঠিকমতো সবকিছু ট্যাকেল করতে না পারেন, তাহলে একদিন দেখবেন—কে যেন আপনার নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে, অবিকল গরুর দড়ির মতো! আর যদি সম্পর্কটা ভেঙে যায়, তাহলে নিজেকে প্রায়ই আবিষ্কার করবেন ঘাসের মাঠে—বসে আছেন, একটা একটা করে ঘাস ছিঁড়ছেন, মুখে দিচ্ছেন, চাবাচ্ছেন; জাবর কাটার মতো।
আচ্ছা, কোন প্রাণী যেন ঘাস খেয়ে জাবর কাটে?
তারপর একদিন সংসার হলো আপনার। কোনো একদিন টের পেলেন—কিসের একটা হাল টেনে যাচ্ছেন আপনি, কাঁধে জোয়াল, পেছনে ছড়ি হাতে কে যেন প্রতিদিন!
পুরো জীবনটাই গরুময়!
৩
গরু কত প্রকার—জানেন?
গরু আছে হরেক রকম। তবে এর মধ্যে অন্য রকম একটা গরু আছে—রাজনৈতিক গরু! নিচের তিনটি উদাহরণে ব্যাপারটা স্পষ্ট জেনে যাবেন আপনি—
ক. টিভিতে কয়দিন ধরে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে—অমুক তারিখে দেশের উন্নয়ন নিয়ে ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ একটা ভাষণ দেবেন মাননীয়…। তারপর থেকে সেই যে টিভি খুলে সেই ভাষণ শোনার জন্য নাওয়া-খাওয়া ভুলে হাসি হাসি মুখে বসে আছেন আপনি…!
খ. সব বিষয়ে জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও, এত কিছু বুঝেও, আপনার অমঙ্গল হবে জেনেও, আপনি যখন ভণ্ড রাজনীতিবিদদের চাপাবাজিতে নিজেকে মজিয়ে ফেলেন, তাদের কথায় ওঠাবসা করেন, অন্যায় আবদার মেটাতে থাকেন, নিজেকে ধ্বংস বা কোরবানি করতে করতে দেশকেও কোরবানি দিয়ে বসেন।
গ. গত দুবার নির্বাচিত হয়েও যে লোক আপনার এলাকায় কিছু করেননি, কিন্তু এবার আবার ভোট চাইতে এসে মুখে ফেনা তুলে বলছেন—উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে দেব এবার দেশ, আর আপনি বেঁধে রাখা কোরবানির গরুর মতো তার কথা শোনেন আর জি ভাই, জি ভাই বলে নিজেও মুখে ফেনা তুলে ফেলেন।
৪
ক্লাস সিক্সে বাংলা দ্বিতীয় পত্রে ‘নদী’ রচনা এলো বার্ষিক পরীক্ষায়, ১০ বছর আগে। কিন্তু ছেলেটি পড়ে গেছে ‘গরু’ রচনা। এখন উপায়?
তবু বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখতে বসল ছেলেটি—
টলটল পানিতে বয়ে যাচ্ছে নদীটি। নদীর নাম করতোয়া। কূলে সবুজ ঘাসের ছড়াছড়ি, বাতাসও বইছে বেশ। এমন সময় একটা গরু এলো ঘাস খেতে। গরুটির চারটি পা, সামনে পা দুটো চিকন। একটা লেজও আছে তার। লেজ দিয়ে মশা-মাছি তাড়াচ্ছে সে। গরুর চোখ দেখে মনে হয়—সব সময় কাজল দিয়ে রাখে সে চোখে। আচ্ছা, মানুষের যদি লেজ থাকত, তাহলে মশা মারা র্যাকেট কিনতে হতো না আমাদের। এতে অনেক টাকা সাশ্রয় করা যেত প্রতিদিন। আর মেয়েরা কাজলের পেছনে যে পরিমাণ টাকা ব্যয় করে, গরুর চোখের মতো মানুষের যদি চোখ হতো, তাহলে কাজল কেনার টাকাও বাঁচত।
১০ বছর পর বাংলা দ্বিতীয় পত্রে রচনা এলো—‘মানুষ’। এখনকার ছাত্রটিও পড়ে এসেছে ‘গরু’। আগের ছাত্রের চেয়ে এবার ছাত্রটি আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে লিখতে লাগল—
মানুষ আর গরু প্রায় একই জাতের প্রাণী। গরুর গলায় একটা চামড়া ঝুলতে দেখা যায়, এটাকে বলে গলকম্বল। কোনো কোনো মানুষের গলায় কাপড়ের তৈরি একটা ফিতা ঝুলতে দেখা যায়, এটাকে বলে টাই।
গরু মোটাতাজা করতে বিভিন্ন ট্যাবলেট বা ওষুধ খাওয়ানো হয় আজকাল, আর ঘুষ খেলেই মানুষ মোটাতাজা হয়ে যাচ্ছে ইদানীং।
কোরবানির গরুর গলায় মালা পরানো হয়, নির্বাচনে জয়ী হলেও মানুষের গলায় মালা পরানো হয়। আরও একটা মিল হচ্ছে—গরুর হাটে গরুরা গুঁতোগুঁতি করে, এর জন্য গরুর মাথায় দুটো শিং থাকে। নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা মারামারি করে, এর জন্য এদের কাছে দা, চাপাতিসহ বিভিন্ন অস্ত্র থাকে।
গরু আজীবন গৃহস্থের হাল টানে, মানুষ আমৃত্যু খেটে যায় সংসারের জন্য। গরুর আর মানুষের মাঝে আরও একটা মিল হলো—গরু বিজ্ঞাপনে মডেল হয়, যেমন ডানো বা অ্যাংকর মিল্ক। মানুষও বিজ্ঞাপনে মডেল হয়, যেমন গরুমার্কা ঢেউটিন।
কিছু কিছু অমিলও অবশ্য আছে গরু আর মানুষের মাঝে—
গরুকে তেল দিয়ে চলতে হয় না, প্রিয়ভাজন হতে মানুষ তেলের আশ্রয় নেয়। গরু মানুষকে কোরবানি দেয় না, মানুষ গরুকে দেয়। মানুষ দুই পায়ে হাঁটে, গরু হাঁটে চার পায়ে। সবচেয়ে বড় অমিল হচ্ছে—একটা গরু কখনো আরেকটা গরুকে শত্রুতা করে খুন করে না, একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে করে!
৫
রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতা লেখার আগেই জুতা আবিষ্কার হয়েছে এ দুনিয়ায়। আর মানুষের অধিকাংশ জুতা বানানো গরুর চামড়া দিয়ে।
আচ্ছা, যদি গরুরা জুতা পরত, কার চামড়া দিয়ে জুতা বানাত তারা?
থাক, আপাতত এটা না জানলেও চলবে।
এবার একটা প্রচণ্ড সত্য কথা বলি—বলুন তো কোন প্রাণীর বাচ্চা মাকে ‘আম্মা’ বলে ডাকে?
অবিকল মানুষের বাচ্চার মতো আরও একটা প্রাণীর বাচ্চা মাকে ‘হাম্বা’ বলে ডাকে, সেটা হচ্ছে গরুর বাচ্চা।
কিন্তু মনোযোগ আর আন্তরিকতা দিয়ে শুনলে বোঝা যাবে—ওটা ‘হাম্বা’ নয়, ‘আম্মা’। পৃথিবীর আর কোনো প্রাণীর বাচ্চা এভাবে মাকে ডাকে না! সুতরাং বিশ্বাস করুন অথবা না করুন—প্রতিটি ‘গরু’ই একেকটা মানুষ, প্রতিটি মানুষই একেকটা ‘গরু’!
ইলাস্ট্রেশন: দিদারুল দিপু