skip to Main Content

টেকসহি I নিউরোকসমেটিকস

মূল লক্ষ্যবস্তু স্নায়ু। যার সঠিক উদ্দীপনায় সেরে উঠবে ত্বকের নানা সমস্যা। বয়স রুখে দেখাবে তারুণ্যোজ্জ্বল

মনের অবস্থা নাকি ফুটে ওঠে মানুষের চেহারায়। বইয়ের ভাষায়, মস্তিষ্কের স্নায়ুর কার্যকারিতার প্রতিচ্ছবি ত্বক! অদ্ভুত শোনালেও সত্যি। শিহরণে লোম দাঁড়িয়ে যাওয়া, লজ্জায় রক্তিম হয়ে ওঠা, ভয়ে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া—তারই বহিঃপ্রকাশ। যেন মন আর ত্বক নিজেদের মধ্যে কথা বলে চলেছে!
এটি বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত যে, ত্বকের স্নায়ুতন্ত্র বা নিউরনে যেসব রিসেপ্টর রয়েছে, সেগুলো ত্বকের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উদ্দীপনার বার্তা মস্তিষ্কে পাঠায়। কিন্তু এ প্রক্রিয়া যদি বাধাগ্রস্ত বা ধীরগতির হয়ে যায়, তাহলে কী ঘটে? মস্তিষ্কের সঙ্গে ত্বকের এ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে ত্বকে নানা সমস্যা দেখা দেয়। ইনফ্লামেশন বা হাই সেনসিটিভিটি তারই উদাহরণ। এমনকি অকালে দেখা দিতে পারে বলিরেখা!
মস্তিষ্ক ও ত্বকের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া এ সংযোগ পুনরায় জুড়ে দেওয়ার লক্ষ্যে স্কিন কেয়ারের জগতে এসেছে নিউরোকসমেটিকস। প্রতিদিন যেসব প্রসাধনী ব্যবহার করা হয়, সেগুলো শুধু ত্বকের ওপরের স্তরেই কাজ করে। অন্যদিকে নিউরোকসমেটিকস এমন সব স্কিন কেয়ার পণ্য, যেগুলো ত্বকে থাকা স্নায়ু রিসেপ্টরগুলোকে এমনভাবে প্রভাবিত করে, যা মস্তিষ্কের সঙ্গে সংযোগ তৈরিতে সক্ষম। কিন্তু স্নায়ু ও ত্বকের সংযোগ বাহ্যিকভাবে কি আদৌ সম্ভব? গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু সক্রিয় উপাদান ত্বকের সংস্পর্শে এলে সেগুলো মনের ভাবকে প্রভাবিত করতে পারে। মূলত ত্বক ও স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়াকে টার্গেট করে নিউরোকসমেটিকস ত্বকের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
ত্বকের স্নায়বিক কার্যাবলি যে বেশ জটিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষের ত্বকে প্রায় ৮ লাখ নিউরন রয়েছে। আছে ১১ মিটার লম্বা স্নায়ু এবং প্রতি বর্গসেন্টিমিটারে প্রায় ২০০ সেন্সরি রিসেপ্টর; যা মস্তিষ্কে উদ্দীপনা বা সংকেত পাঠায়। এসব স্নায়ুর প্রান্ত থাকে ত্বকের এপিডার্মিস ও ডার্মিস স্তরে। মানসিক চাপ ও পরিবেশদূষণের মতো বাহ্যিক কারণে স্বাভাবিকভাবে ত্বক ও মস্তিষ্কের মধ্যকার সংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলাফল ত্বকের সুস্থতা ব্যাহত হয়; দেখা দেয় রোগ। তা ছাড়া মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিউরোরিসেপ্টরের সংখ্যাও কমতে থাকে, রিসেপ্টরগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত স্নায়ুর ফাইবার দুর্বল হয়ে যায়। তাই বয়স যত বাড়তে থাকে, তত বাড়ে ত্বকের পানিশূন্যতা, উজ্জ্বলতা কমতে থাকে, পড়ে ক্লান্তির ছাপ। ফলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্বকযত্নে প্রচলিত প্রসাধনীর বাইরে গিয়ে এমন পণ্য প্রয়োজন, যা মনকে সুস্থ-সতেজ রাখার মাধ্যমে ত্বক ভালো রাখবে।
মেনথল ব্যবহারে ত্বকে আসলে কী অনুভূতি হয়? যেখানে ব্যবহার করা হচ্ছে, সে জায়গাটা ঠান্ডা হয়ে আসে, ব্যথাও কমে যায়। আবার যেমন অ্যারোমাথেরাপি। অ্যারোমাযুক্ত তেল দিয়ে ম্যাসাজ করলে যেমন মানসিক চাপ কমে, তেমনি এটি ত্বককে করে উজ্জীবিত। বর্তমান প্রজন্মের নিউরোকসমেটিকস কোম্পানিগুলো এই ধারণাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। মূলত প্রাকৃতিক ও উদ্ভিদ থেকে নেওয়া অ্যাকটিভ উপাদান থেকে তৈরি নিউরোকসমেটিকস। এটি ত্বকে থাকা কোষের জীবন ও কার্যক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে কাজ করে। অন্যভাবে বললে, এ ধরনের পণ্য কাজ করে বার্ধক্যের প্রভাবের বিপরীত শক্তি হিসেবে। নিউরোকসমেটিকসে থাকা নিউরোপেপটাইডের মতো উপাদান মস্তিষ্কের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য কার্যকর বার্তাবাহক নিউরোট্রান্সমিটারগুলোকে প্রভাবিত করে।
ত্বকের স্নায়ুতন্ত্র আসলে কীভাবে কাজ করে, তার একটি সহজ উদাহরণ দেখা যাক। দিনের পর দিন কাজের চাপ বাড়তে থাকলে দেখা যায়, ধীরে ধীরে ত্বক নিস্তেজ হয়ে আসছে। এমনকি একটা সময়ের পর ত্বক বেশি বয়স্ক দেখানো শুরু করে, ফোলা ফোলা ভাব চলে আসে। এর কারণ, স্ট্রেস হরমোন হিসেবে পরিচিত ‘কর্টিসল’ নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয় মানসিক চাপ। আর এ হরমোনের অত্যধিক নিঃসরণ দেহের কোলাজেনকে প্রভাবিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব ক্ষেত্রে নিউরোপেপটাইড যুক্ত কসমেটিক ব্যবহার করে কার্যকরীভাবে কর্টিসলের নিঃসরণ কমিয়ে আনা সম্ভব।
নিউরোকসমেটিকস নামক এই অত্যাধুনিক নতুন প্রসাধনী কীভাবে ত্বকের কার্যকারিতা পরিবর্তন করতে পারে, তার আরও একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। নিউরোকসমেটিকসের কিছু পণ্যে বিটা-এন্ডরফিন (আরেক ধরনের নিউরোপেপটাইড) থাকে, যা ব্যথা কমায় এবং ত্বকের সুরক্ষা আবরণকে রক্ষা করে, সুস্থ কোষের সংখ্যা ও কোষগুলোর কার্যকারিতা বাড়ায়। এমনকি এই উপাদান সরাসরি নার্ভ ফাইবারেও কাজ করে। এতে করে বাহ্যিক উদ্দীপনায় ত্বক তুলনামূলকভাবে কম প্রতিক্রিয়া দেখায়, যা অতি সংবেদনশীল ত্বকের জন্য পথ্যসম!
যদিও উদ্ভিদের নিউরোঅ্যাকটিভ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী, এমনকি সহস্রাব্দ ধরেই পরিচিত, এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালিত হয়েছে কিছুদিন আগেই। নিউরোকসমেটিক সায়েন্সের উদীয়মান ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে একটি হলো এন্ডোক্যানাবিনয়েড সিস্টেমের গবেষণা। এ সিস্টেম মস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ মডুলেশন নেটওয়ার্ক। নব্বইয়ের দশকে আবিষ্কৃত এ প্রক্রিয়া মস্তিষ্কের প্লাস্টিসিটি থেকে শুরু করে শেখা, স্মৃতি ধারণ করা, ভয় বা প্রতিরক্ষামূলক আচরণের মতো কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। খাদ্য গ্রহণ, শক্তি সঞ্চয়, পুষ্টির স্থিতাবস্থা—এসবের নিয়ন্ত্রণে থাকে এটি। মস্তিষ্কে এন্ডোক্যানাবিনয়েড সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ না থাকলে নানা মানসিক সমস্যা যেমন অ্যাংজাইটি, হাইপারঅ্যাকটিভিটি, সাইকোসিস ও বিষণ্নতার মতো গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই এন্ডোক্যানাবিনয়েড রিসেপ্টরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সাম্প্রতিক আবিষ্কার শুধু মস্তিষ্কের সুস্থতার জন্য নয়, বরং বাহ্যিক সুস্থতার জন্যও সমানভাবে যুগান্তকারী।
নিউরোকসমেটিকসের ধারণা একেবারেই নতুন হওয়ায় গবেষকেরা এখনো বুঝে উঠতে পারেননি, ঠিক কেন কিছু নির্দিষ্ট উপাদান এ ক্ষেত্রে কাজ করে। তবে বেশির ভাগ গবেষণায় দেখা গেছে, ত্বকে ডিহাইড্রেশন এবং চাপ কমানোর মতো বিষয় মোকাবিলা করতে বেশ কার্যকর নিউরোকসমেটিকস। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, নিউরোকসমেটিকসের পণ্যগুলো ত্বকের লালচে ভাব ও প্রদাহ কমায়; একই সঙ্গে অকালবার্ধক্য ও ব্রণের সমস্যা কমাতেও কাজ করে। নিউরোকসমেটিকসে ব্যবহৃত প্রাকৃতিক উপাদান ত্বকের মাইক্রোবায়োমের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বজায় রাখে। তাই কোনো ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার না করেই উজ্জ্বল ও পরিষ্কার ত্বক পাওয়া সম্ভব নিউরোকসমেটিকসের মাধ্যমে, এমনটাই ধারণা বিশেষজ্ঞদের।

 সাদিয়া আফরিন শায়লা
মডেল: মাশিয়াত
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top