ফিচার I নামে বদনাম!
কুল নাকি কন্ট্রোভার্শিয়াল! এ নিয়েই বাধছে তর্ক-বিতর্ক। বিস্তারিত বর্ণনায় জাহেরা শিরীন
সময়টা ২০১৫। পুরো ব্যাপারটার শুরু সামান্য এক টুইট থেকে। ‘হাও অন আর্থ ইজ দিস আ লিপস্টিক কালার?’ সঙ্গে জুড়ে দেওয়া ক্যাট ফন ডি ব্র্যান্ডের ফায়ার ইঞ্জিন রঙা লিপস্টিক। পৃথিবীতে কী করে এই লিপস্টিক থাকতে পারে, তা নিয়ে সংশয় সুস্পষ্ট পোস্টে। টুইটটি করেছিলেন সেফোরার একজন ক্রেতা। আর দশটা লাল রঙা লিপস্টিকের চেয়ে খুব বেশি ব্যতিক্রম কিছু ছিল না এতে। তাহলে সমস্যা কোথায়? কেনই-বা মামুলি লাল রঙা লিপস্টিকটি নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন সেই ক্রেতা? উত্তর মেলে লিপস্টিকের নামে। আন্ডারএইজ রেড। তাতেই বিপত্তি। অনলাইন সরগরম। সাড়া পড়ে পুরো সৌন্দর্যবিশ্বে। তোপের মুখে ব্র্যান্ডটি। অভিযোগ ওঠে, অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের সেক্সুয়ালাইজ করা হয়েছে। তাদের উপস্থাপন করা হয়েছে যৌন আকাঙ্ক্ষার বস্তু হিসেবে। এমনকি হিউম্যান ট্রাফিকিং অর্থাৎ মানব পাচার প্রচারণার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় ক্যাট ফন ডিকে।
তবে এটাই প্রথম নয়। এ ঘটনার বছর দুয়েক আগে ২০১৩ সালেও পণ্যের নাম নিয়ে বিপাকে পড়তে হয় ভেগান এ ব্র্যান্ডকে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন গোষ্ঠীর তোপের মুখে সেলেবিউটার্ড নামের লিপস্টিক শেডটি সরিয়ে নিতে হয় সব বিউটি স্টোর থেকে। এমন অসংবেদনশীল আচরণের জন্য ক্ষমাও চান ব্র্যান্ড সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু আন্ডারএইজ রেডের নাম নিয়ে বিতর্ক সম্পর্কে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন ফন ডি। বলেন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রতিফলন এই নাম। যার ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। মূলত ষোলো বছর বয়সে জীবনে প্রথম পাঙ্ক রক শো দেখতে গেলে ভেন্যুর দরজা থেকেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল ফন ডিকে। শুধু অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কারণে। সেদিন তার ঠোঁটে ছিল লাল রঙা লিপস্টিক। সেই স্মৃতিচারণা থেকেই লিপস্টিকের নাম দিয়েছিলেন আন্ডারএইজ রেড।
এই ব্যাখ্যার পরপরই কাটতি বাড়ে লিপস্টিকটির। দিন কয়েকের মধ্যেই সোল্ড আউট হয়ে যায় বিউটি স্টোরগুলো থেকে।
শুধুই শব্দ?
সংশ্লিষ্টদের মত, পণ্যের পিগমেন্টের মতোই পাওয়ারফুল হয়ে উঠতে পারে এর নাম। আউট অব দ্য বক্স এ নামগুলো শুনলে পাগলামি মনে হলেও পেছনে রয়েছে বিশেষ মেথড। এলিজাবেথ মিলার, ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসের মার্কেটিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। বিশ্বজুড়ে প্রসাধনশিল্পে পণ্যের নামকরণের এই অপ্রচলিত কৌশল নিয়ে গবেষণা করছেন বহু বছর। তার মতে, পছন্দের ব্র্যান্ডগুলো নিয়ে ক্রেতাদের মনে স্বাভাবিকভাবেই দুর্বলতা সৃষ্টি হয়। তৈরি হয় সুদৃঢ় ব্র্যান্ড-কনজিউমার সম্পর্ক। ফলে ব্র্যান্ডগুলোর এমন বোল্ড নামকরণ বেশির ভাগ সময়ে ক্রিয়েটিভ, কুল আর ফানি মনে হয় ভোক্তাদের কাছে।
সেফোরার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অব মার্চেন্ডাইজিং আর্টেমিস প্যাট্রিকের মতে, ভোক্তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের অভিনব পদ্ধতি হতে পারে এমন নামকরণ। হাসি-ঠাট্টার ছলে ক্রেতাদেরকে ব্র্যান্ডের অংশ করে তোলার অসাধারণ উপায়। যেন চোখ টিপে মুচকি হেসে ক্রেতাদের বলা, ‘ইউ আর ওয়ান অব আস।’
এ তো গেল ব্র্যান্ডের লয়াল কাস্টমারদের কথা। কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠটা কেমন? বিউটি ব্র্যান্ডগুলোর এমন দুঃসাহসিক আচরণে যারা বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। অনেকে তো আবার ভুল ব্যাখ্যা করে ব্যক্তিগতভাবেও নিয়ে ফেলেন। মিলারের মত, এরা টার্গেট মার্কেটের অংশ না হয়েও ব্র্যান্ডের সপক্ষেই কাজ করে ফেলেন। নেগেটিভ মার্কেটিংয়ের এই যুগে অনেকটা মনের অজান্তেই আলট্রা কনজারভেটিভ এসব ক্রেতাও হয়ে ওঠেন ব্র্যান্ড বিল্ডিং ম্যাটেরিয়াল। এখন তো সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে বিউটি ব্র্যান্ডগুলোর কন্ট্রোভার্সি আর ভুল পদক্ষেপগুলো মিনিটেই পৌঁছে যায় বিশ্বের এ-মাথা থেকে ও-মাথা। সে ক্ষেত্রে পণ্যের নাম নিয়ে নানান বিতর্ক সামলে ওঠার সহজ উপায় বাতলে দিয়েছেন মিলার। ইতিবাচক গল্প তৈরির মাধ্যমে প্রাসঙ্গিকতা তৈরি এ ক্ষেত্রে দারুণ কার্যকর।
দ্য অরগ্যাজম ইফেক্ট
১৯৯৯ সাল। মেকআপ আর্টিস্ট ফ্র্যাঙ্কোয়েস নারস বাজারে আনেন স্বচ্ছ, শিমারি পিচি-পিঙ্ক রঙা ব্লাশ; যা দিয়ে চেহারায় পোস্ট কোয়িটাল অর্থাৎ আফটার সেক্স ফ্ল্যাশের অনুকরণে রক্তিম আভা ফুটিয়ে তোলাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। নারস ব্লাশটির নাম রাখেন অরগ্যাজম। তার ভাষ্যমতে, তিনি প্রথমে নামটা ভাবেন, তারপর তৈরি করেন রংটি। অরগ্যাজমের মতো এমন সাহসী নাম ব্লাশটিকে করে তোলে বিউটি ব্র্যান্ডটির মোস্ট আইকনিক প্রডাক্ট, বিশ্বাস নারস-এর।
প্রায় দুই যুগ পেরিয়েছে। সেক্স আজও দেদার বিকোচ্ছে সৌন্দর্যবিশ্বে। ২০১৩ সালে বিউটি ব্র্যান্ড টু ফেসড-এর মাসকারা ‘বেটার দেন সেক্স’ বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে ওঠে তাদের বেস্ট সেলিং প্রোডাক্ট। একই ঘটনা ঘটে বেনিফিট কসমেটিকসের ক্ষেত্রেও। ২০১১ সালে বাজারে আসে তাদের ‘দে আর রিয়েল’ নামের মাসকারা। তারপর? ব্র্যান্ডের নাম্বার ওয়ান প্রোডাক্ট আর সেফোরার টপ সেলিং মাসকারার তকমা—দুটোই এর দখলে। তবে শুধু নামকরণেই যে সব জাদু, তা-ও নয়। এ প্রোডাক্টগুলোর প্রতিটিরই ফর্মুলা দারুণ। সঙ্গে বোল্ড নামের জোড়—ব্যস, প্রোডাক্ট হিট!
বিধিবিরুদ্ধ
নব্বইয়ের দশকে যখন আরবান ডিকের আবির্ভাব ঘটে সৌন্দর্যবিশ্বে, তখন তা পরিচিত হয়ে ওঠে রুল ব্রেকিং ব্র্যান্ড হিসেবে। কারণ, যে সময় সৌন্দর্যের পুরোটাই পিঙ্কে মাখামাখি, তখন তাদের বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন ছিল ‘ডাজ পিঙ্ক মেক ইউ পিউক?’ এ ছাড়া তাদের আইশ্যাডোর নামগুলোও ছিল প্রথাবিরুদ্ধ। কুশ, রোচ, ব্লান্ট—যেন স্টোনারদের কোড ওয়ার্ড! এসব ট্যাবু নামের কসমেটিকগুলো দারুণ আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছিল। তবে সে সময়ের কুল কিডদের রোমাঞ্চিত করতে ব্যর্থ হয়নি। প্রমাণ? ব্র্যান্ডের সে সময়কার সেলস রিপোর্ট। আপোসহীন হওয়ার ফায়দা মিলেছে মুনাফায়। পরে ২০১২ সালে আরবান ডিকের স্বত্ব কিনে নেয় বিউটি জায়ান্ট ল’রিয়েল। সেফোরার টপ সেলিং কালার কসমেটিকস ব্র্যান্ড ছাড়াও মিলেনিয়ালদের মাঝে হটেস্ট ব্র্যান্ড হয়ে ওঠে এটি। ব্যাংক অব আমেরিকার ২০১৫ সালের সমীক্ষা তাই-ই বলে।
২০১৪ সালে বিউটি জায়ান্ট ম্যাকও পড়ে তোপের মুখে; তাদের ডিপ পার্পল রঙা হিরোইন নামের লিপস্টিককে যখন মাদকদ্রব্যের নামের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন কিছু ক্রেতা। ‘তারা নামের বানানটি ঠিকমতো পড়েননি’—এই একটি কথা দিয়েই পরিস্থিতি সামলে নেন ম্যাকের তৎকালীন ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর জেমস গেজার। তবে নাম নিয়ে এই বিতর্কই বিক্রি বাড়ায় লিপস্টিকটির; যা আজও অনেকের উইশলিস্টে আছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, পণ্যের নাম নিয়ে বিতর্ক ব্র্যান্ডগুলোর পিছু ছাড়েনি আজও। এখন যুগ কাইলি কসমেটিকসের বেয়ারলি লিগ্যাল আর জেফরি স্টারের অ্যাবিউসড নামের প্রোডাক্টের। যেগুলোর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা আবারও প্রমাণ করেছে, নাম নিয়ে কন্ট্রোভার্সি মানেই কৌতূহল, আর তাতেই বাড়তি কাটতি।
ছবি: সংগ্রহ