ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য বারবি
লাইফ ইন প্লাস্টিক, ইটজ ফ্যান্টাস্টিক। আর তাতেই মাতোয়ারা পুরো ফ্যাশন বিশ্ব। কখনো ডিজাইনারদের অনুপ্রেরণার অংশ তো কখনো শীর্ষস্থানীয় সব ব্র্যান্ডের অ্যাম্বাসেডর। এ বছরের সেরা ট্রেন্ডসেটারের তকমা এরই মধ্যে তার দখলে। দেশি-বিদেশি তারকাদের কাছে রীতিমতো অনুকরণীয় তার স্টেটমেন্ট স্টাইল। কে সে?
মাত্র সাড়ে এগারো ইঞ্চি লম্বা এই ইনফ্লুয়েন্সার। যার ইনস্টাগ্রাম ফলোয়ার ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন। তাই তো প্যারিস আর নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকের রেড কার্পেটে নিয়মিত দেখা মেলে তার। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সব ব্র্যান্ডের নানা আয়োজন ছাড়াও তার সরব উপস্থিতি গোল্ডেন গ্লোব, মিয়ামির আর্ট বেসেল, ফোর্বসের ওমেন সামিট, কোচেলাসহ নানা ইভেন্টে। পরনে ডিওর, শ্যানেল, মসকিনো, ভ্যালেন্টিনো আর অস্কার দ্য লা রেন্টার ডিজাইনারওয়্যার। এই ডিজিটাল পেইড ইনফ্লুয়েন্সারের রয়েছে ফুলপ্রুফ টিম। ডিজাইন, মার্কেটিং কমিউনিকেশন, ডিজিটাল আর পাবলিসিটিতে বিভক্ত। যেকোনো ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সারের ড্রিম টিম। তবে ফ্যাশনে তার এই দাপট আজকের নয়, সেই আশির দশক থেকে।
বলা হচ্ছে বারবির কথা। ঠিকই শুনেছেন। আমেরিকান টয় কোম্পানি ম্যাটেলের ফ্যাশন ডল, যা বাজারে আসে ১৯৫৯ সালে। মূলত পঞ্চাশের দশকের নারীদের গতানুগতিক গৃহিণী সুলভ রূপ পাল্টে স্বতন্ত্র আর স্বাবলম্বী লুকে দেখতে চেয়েছিলেন বারবির প্রতিষ্ঠাতা রুথ হ্যান্ডলার। তারই সুস্পষ্ট প্রকাশ এই প্লাস্টিকের পুতুলের পোশাকে। আশির দশকে তো রীতিমতো পপ কালচার আইকনে পরিণত হয় বারবি। তার পোশাক ডিজাইন করতে শুরু করেন বাঘা বাঘা ডিজাইনার। ওত কতুর থেকে হাই স্ট্রিট পোশাক পরিহিত বারবির দেখা মেলে বাজারে। তার নিজস্ব স্টাইল স্টেটমেন্টও দখল করে নেয় ট্রেন্ডচার্ট। হেড টু টো পিঙ্কে রঙিন হতে শুরু করে ফ্যাশনিস্তাদের ওয়্যারড্রোব।
২০০০ থেকে ২০০৯ সালের তারকাদের কল্যাণে চালু হয় বারবিকোর ট্রেন্ড। প্যারিস হিল্টন, নিকোল রিচি আর ব্রিটনি স্পিয়ারসের হাত ধরে। সে সময়কার ফ্যাশন ট্যাবলয়েডগুলোর কাভারেই মেলে জ্বলজ্বলে প্রমাণ। যার সব কটিই ছিল হাইপার ফেমিনিন। পিংক আর গ্লিটারের উচ্ছ্বসিত উপস্থিতি তাতে নজর কাড়ে। চলচ্চিত্রেও বারবি আলোড়ন তুলেছিল সে সময়। ক্লুলেস, লিগ্যালি ব্লন্ড, এবং পরবর্তী সময়ে মিন গার্লস—এসব চলচ্চিত্রের নারী চরিত্রগুলোকে পর্দায় দেখা যায় চোখধাঁধানো, উজ্জ্বল গোলাপিতে। যা সে সময় উসকে দেয় বারবিকোর ট্রেন্ডের জনপ্রিয়তা। শূন্য দশকের শেষের দিকে পপ স্টাররা ফ্যাশনে এই ট্রেন্ডকে শীর্ষে পৌঁছে দিতে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। আরিয়ানা গ্র্যান্ডের হাইপার ফেমিনিন স্টাইল থেকে র্যাপার নিকি মিনাজের পিঙ্ক উইগ, বারবির লোগোসহ চেইন—সবেতেই ছিল বারবিকোর ভাইবের সুস্পষ্টতা। সে সময় নিকি ফ্যানরা নিজেদের ‘দ্য বারবজ’ বলে ডাকতে শুরু করেন।
সম্প্রতি আবার আলোয় ফিরেছে। ২০২২ সালের ‘ইয়ার ইন ফ্যাশন’ রিপোর্টের মাধ্যমে জানা যায়, টপ ট্রেন্ড ছিল বারবিকোর। টাইমলাইনে দেখা যায় এর পিক টাইম ছিল জুন মাস। সে সময় অভিনেত্রী মার্গো রোবি অল-হট পিঙ্ক ওয়েস্টার্ন আউটফিটে দর্শকদের সামনে আসেন। এর পরপরই টিকটকে ট্রেন্ডিং হয়ে ওঠে বারবিকোর। পিঙ্ক পোশাকে মানুষের ঝোঁক বোঝা যায় এই হ্যাশট্যাগ ব্যবহারের ব্যাপকতায়। হাই ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডে ২০২২ সালে পিয়েরেপাওলো পিচোলির অল পিঙ্ক ভ্যালেন্টিনো শো ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে বারবিকোরের অবস্থান আরও পোক্ত করে। তৈরি হয় প্যান্টনের শেড।
পারসনস স্কুল অব ডিজাইনের ফ্যাশন কমিউনিকেশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর এমিলি হাগারড বারবিকোরের প্রত্যাবর্তন বিষয়ে বলেন, প্লেফুলনেস এই ধারা এগিয়ে যেতে ভূমিকা রেখেছে। পোস্ট-কোভিড দুনিয়ায় মানুষ ডোপামিন ড্রেসিংয়ের মাধ্যমে পোশাকের মাঝে আনন্দ খুঁজে বেড়ান। এতে উজ্জ্বল রঙের চাহিদা বেড়েছে। কালারে ‘ফিল গুড’ ভাইব প্রাধান্য পাচ্ছে। স্টাইল ও কমফোর্ট—দুয়ের প্রতিই আগ্রহ দেখাচ্ছেন ফ্যাশনিস্তারা।
তিনি যোগ করেন, বারবিকোর ট্রেন্ডটি সুন্দর তো বটেই, খুব জটিলও নয়। যা মনে বেঁচে থাকার জয়, উচ্ছ্বাসের উদ্ভব ঘটাতে সহায়ক।
এ ছাড়া গেল মাসে বারবি চলচ্চিত্রের পর্দা উন্মোচনও একটি শক্তিশালী প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে এ ট্রেন্ড উসকে দিতে। সিলভার স্ক্রিনে বারবিকে নতুন করে আবিষ্কারের পর ক্রেতাদের শপিং বিহেভিয়ারে দেখা গেছে বারবি ক্রেজ। কাটতি বেড়েছে অল পিঙ্ক আউটফিটের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটকে দেখা দিয়েছে #বারবিকোর-এর ব্যবহার। অবশ্য, এর শুরু গত বছর। এখন অব্দি ৩৬৫ মিলিয়ন ভিউ পেয়েছে এই ট্যাগ। রাজনৈতিক কলহ, অর্থনৈতিক ও মহামারির অস্থিরতার মাঝে বারবির ফ্যান্টাসি স্বস্তিজাগানিয়াই বটে।
হাগারডের মতে, অল পিঙ্কে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা প্রকাশিত হয় বলে ধারণা রয়েছে। বোল্ড এই রঙের সুবিধাজনক বিষয় হচ্ছে, যেকোনো দামের মধ্যে এই কালার শেডের পোশাক ও অনুষঙ্গ পাওয়া যায়। ফলে কোয়াইট লাক্সারির মতো বিলাসবহুল ট্রেন্ডের চেয়ে এর অনুসরণ তুলনামূলক সহজ।
ফ্যাশন হিস্টোরিয়ান ও কিউরেটর ডার্নেল জামাল লিসবির মতে, বারবিকোরের বর্তমান জনপ্রিয়তা প্রকাশ করে, পুতুলটি প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে আসার পর থেকে আজকের সময় পর্যন্ত সমাজ কতটুকু এগিয়েছে। একসময় বারবিকে শুধু হাইপার ফেমিনিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা হলেও এখন অনেক ক্ষেত্রেই এটি কনভারসেশন স্টার্টার। বারবিকে নিয়ে আলোচনার অতশত বিষয়বস্তুই একে এত বছর টিকিয়ে রাখতে প্রভাব রেখেছে বলে ধারণা তার। করপোরেট মার্কেটিং থেকে শুরু করে সমাজ, লিঙ্গ, বর্ণ, সামাজিক অবস্থান—কোথায় নেই বারবির বোল!
বারবি উন্মাদনায় ডিজাইনার লেবেলগুলোর আগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে নিয়মিত। কোলাবোরেশন করেছে বিশ্বের প্রথম সারির বহু ব্র্যান্ড। সত্তরের বেশি শীর্ষস্থানীয় ফ্যাশন ডিজাইনার বানিয়েছেন টাইনি সাইজ বারবি ড্রেস, যা শোভা পেয়েছে বারবির গায়ে।
১৯৮৫ সালে ডমিনিকান ফ্যাশন ডিজাইনার অস্কার ডে লা রেনটা বারবিকে ইয়েলো টপ আর ব্ল্যাক স্লিট গাউনে সামনে আনেন। এটাই ছিল বারবির প্রথম ডিজাইনার পার্টনারশিপ। বছর দশেক পর ১৯৯৫ সালে ডোনা ক্যারেন বারবিকে সাজান নি লেন্থ কালো মিডিতে। সঙ্গে ছিল লাল স্টোল। এর পরের বছর ক্যালভিন ক্লেইন বারবিকে উপস্থাপন করেন স্পার্কলিং ডেনিম মিনি স্কার্ট আর জ্যাকেটে। ১৯৯৬ সালে নিকোল মিলারের বারবি আসে স্নিগ্ধ-সুন্দর রূপে। সাদা রঙের পোশাক ও অনুষঙ্গে হোয়াইট ফেইরি বারবি। একই বছরে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় লাক্সারি ওমেন ব্র্যান্ড এসকাডা নিয়ে আসে বারবি। বেবি পিঙ্ক আর কালো রঙা গাউনে!
১৯৯৭ সালে আসে ক্রিশ্চিয়ান ডিওরের বাববি ডল। কালো লং প্লিটেড স্কার্ট, সঙ্গে বেইজ কালার ব্লেজার, আর মাথায় ঝুড়ির মতো দেখতে হ্যাট। পায়ে ব্ল্যাক হাই হিল শু। সে বছর আমেরিকান ফ্যাশন ডিজাইনার বিল ব্লাসও নিয়ে আসেন বারবি। ব্রাইট ইয়েলো গাউনের সঙ্গে কোমরে সাদা-কালো লং বো নজর কাড়ে। ১৯৯৯ সালে আরেক আমেরিকান কস্টিউম ডিজাইনার নোলান মিলার ফিরোজা গাউনে সাজান বারবিকে। সঙ্গে ছিল কালোর উপস্থিতি। জমকালো বারবিকে সে বছর আরও একবার দেখা যায়। পাম রয়্যাল বারবি নিয়ে আসেন ডিজাইনার বায়রন লারস।
বারবেরি বারবি নিয়ে আসে ২০০১ সালে। লং ট্রেঞ্চ কোটের সঙ্গে নীল চেকের ইনার, স্টোল আর ব্যাগের সঙ্গে নি লেন্থ বুটে আসে বারবি। ২০০৫ সালে ফারারি বারবিকে সোনালি পেনসিল স্কার্ট পরিয়ে নিয়ে আসে। টপে লেয়ারিং স্টাইলের রেড লং জ্যাকেট। পায়ে লং বুট আর ব্যাগে সম্পূর্ণ সাজ। জুহায়ের মুরাদ পিচ আর ব্ল্যাকের কম্বিনেশনে তৈরি গাউন পরিয়ে উপস্থাপন করেন বারবিকে। কালো ফ্লোর টাচ গাউনে বারবি আসে জিভাঁশির লেবেলে। সাল তখন ২০০০। জুসি কতুরের বারবি ডল দেখা দিয়েছে ২০০৪ সালে। এই বছর ৪৫ বছর পূর্ণ করে বারবি। বব ম্যাকির গাউনে বার্থ ডে গার্ল বারবিকে দেখা যায়। পিজে অল ডে কনসেপ্টের পোশাকেও দেখা যায়। ২০০৪ সালে পল ফ্রাঙ্কের ডিজাইন করা নাইট স্যুটে। আকাশি আর লাল রঙের প্রাধান্য ছিল তাতে।
২০০৬ সালে স্যুট পরিহিত বারবিও আসে। অফিস অ্যাটায়ারের সঙ্গে জুতসই অনুষঙ্গ হিসেবে ছিল জুতা, বেল্ট আর হ্যান্ডব্যাগ। এটি ছিল রালফ লরেনের সঙ্গে কোলাবোরেশন। ২০০৭ সালে বারবির জন্য ব্রাইডাল গাউন ডিজাইন করেন লেবানিজ ডিজাইনার রিম আকরা। র্যাপ ড্রেসের প্রতিষ্ঠাতা ডায়ান ফন ফারস্টেনবার্গ বারবিকে দিয়েছিলেন এয়ারপোর্ট লুক। পাসপোর্ট, লাগেজ হাতে হট পিংক র্যাপ ড্রেসে। ভেরা ওয়াং বারবিকে সাজিয়েছিল সাদা গাউনে, ব্রাইডের বেশে। ২০১৩ সালে মালিবু বারবি আসে বাজারে। জাপানিজ-আমেরিকান ডিজাইনার ট্রিনা টার্কের নকশা করা পোশাকে। টু পিস ফ্লোরাল বিকিনি আর লেইসি হোয়াইট কাভার আপে। ২০১৪ তে লঞ্চ করা হয় কার্ল লেগারফেল্ডের বারবি। কালো-সাদার দুর্দান্ত সেই লুক। সঙ্গে অক্সিডাইজড জুয়েলারি আর সানগ্লাসে বোল্ড লুক।
বারবি বরাবরই নিজের মতো করে অবস্থান জানান দিয়েছে গেল চৌষট্টি বছর। যুগে যুগে মুগ্ধ করেছে ভক্তদের। সেট করছে ট্রেন্ড। প্রিয় পুতুলের ফ্যাশন অনুসরণ আনন্দের বৈকি!
ফ্যাশন ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট
Hi. Are you guys welcoming and giving chance to newcomers for photoshoots?