ট্রিবিউট I সুষমা ও সৌন্দর্যে সুলতান
এস এম সুলতান। কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী। চলছে তার জন্মশতবর্ষ। এ উপলক্ষে তার প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি। লিখেছেন চিত্রশিল্পী সিলভিয়া নাজনীন
‘আমার ছবির ব্যাপার হচ্ছে সিম্বল অব এনার্জি। এই যে মাসলটা, এটা যুদ্ধের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, সয়েলের সাথে যুদ্ধ। তার বাহুর শক্তিতে লাঙলটা মাটির নিচে যাচ্ছে, ফসল ফলাচ্ছে। শ্রমটা হলো বেসিস। আর আমাদের এই অঞ্চল হাজার বছর ধরে এই কৃষকের শ্রমের উপর দাঁড়িয়ে আছে। অথচ সেই কৃষকদের হাজার বছর ধরে মারা হয়েছে।… আমি কৃষকের হাজার বছরের এনার্জিকে, ওদের ইনার স্ট্রেন্থকে এক্সজারেট করে দেখিয়েছি। কাজের ফিলিংসটাকে বড় করে দেখিয়েছি।’
—এস এম সুলতান
সুলতানের চিত্রকলার বিষয়বস্তুতে গ্রামবাংলার সাধারণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, শ্রমজীবী মানুষ, সদা কর্মোদ্দীপক, সংগ্রামী, তেজদীপ্ত ও সুগঠিত নর-নারীদেহ ও তাদের জীবনপ্রণালি বিশেষত্ব আরোপ করেছে। তিনি বলেছিলেন, তার ছবিতে মিকেলাঞ্জেলো বা ভিঞ্চি অর্থাৎ পশ্চিমের প্রভাব থাকতে পারে; কিন্তু তার ছবির উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ আলাদা, বিষয়বস্তু ও পরিবেশ আলাদা। সুলতানের নারীদেহ দেখে অজন্তা-ইলোরা অথবা কালীঘাটের পটের কথা মনে পড়লেও সেগুলো যে সুলতানের ‘মানুষ’, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলার সাধারণ মানুষকে তিনি বিষয় হিসেবে বেছে নিলেও চিত্রশৈলীর বিচারে তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়।
শিল্পী এস এম সুলতান ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট নড়াইলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তার চিত্রকর্মে গ্রামীণ জীবনের আবহ, সংস্কৃতি এবং মানবিক আবেগের সারাংশকে ধারণ করেছিলেন। অসচ্ছল পরিবারে জন্ম নেওয়া সত্ত্বেও তার ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ আর বাবার উৎসাহে অনুমান করা যায়, সুলতান শিল্পের পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন শৈশবেই।
২.
ছবি আঁকার ক্ষেত্রে শিল্পী এস এম সুলতানের বৃহদাকার ক্যানভাসের প্রতি আকৃষ্টতা বিশেষ লক্ষণীয়। হয়তো সে কারণে আমরা তার চিত্রকর্মসমূহের প্রধান অংশ বিশাল আকৃতির ক্যানভাসের মধ্যে দেখতে পাই। তার ছবির বিষয়বস্তুতে যেহেতু নিসর্গবাদ একটি মূল অবয়ব জুড়ে রয়েছে, তাই তা প্রকাশের জন্য বড় আকারের চিত্রপট প্রয়োজন। চর দখল-২, হত্যাযজ্ঞ, যাত্রা, খেত-দখল, ধান মাড়াই-১, আমার গ্রাম, গ্রামের দুপুর, জমি কর্ষণ, মাছ কাটা, শাপলা তোলা প্রভৃতি ছবির ক্যানভাস আমাদের সে কথাই জানান দেয়।
শিল্পী সুলতানের স্বতন্ত্র শৈলীর মধ্যে কখনো বাস্তববাদ, কখনো অভিব্যক্তিবাদ আবার কখনো পরাবাস্তববাদকে পুনর্নিমিত হতে দেখা যায়। এ ছাড়া আমরা লোকশিল্পের উপাদান আর অনুষঙ্গকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারি তার চিত্রমালায়। তার ছবির রং হিসেবে আমরা দেখি আইভরি ব্ল্যাক, স্যাপগ্রিন, কোবাল্ট ব্লু, ইয়েলো অকার, বার্ন্ট সিয়ানা, ভিরিডিয়ান গ্রিন ইত্যাদির আধিক্য। যদিও এই রংগুলো তিনি নানান ভেষজ, প্রাকৃতিক উপাদান থেকে নিয়েছেন। মাধ্যম হিসেবে কাগজে কয়লা দিয়ে ড্রইং ছাড়াও জলরং আর তেলরঙের ব্যাপ্তি বিশেষ বিবেচ্য সুলতানের চিত্রকর্মে।
শিল্পী এস এম সুলতানের ছবিতে বিষয়ের নমনীয়তা, গভীর ও উপরিতলের সম্পর্ক এবং দৃশ্যমান মূল্যবোধের সার্বিক নির্মিতি দেখে ধারণা করা যায়, তিনি অনেক বেশি সংবেদনশীল ছিলেন। এসব ছবিতে ক্যানভাস অপরিবর্তনশীল কোনো সরল সাধারণ পরিসর নয়, বরং গাঢ় ও পুরু রং, তার বাঙ্ময় প্রয়োগ এবং বর্ণবিন্যাস বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা দেয়। একই রঙের নানা মাত্রায় প্রয়োগ সংবেদনশীলতা ও সজীবতা তৈরি করে। পাশাপাশি বিভিন্ন রঙের ব্যাপ্তি, কম্পোজিশনের ভিন্নতা অবাধ সুষমা প্রকাশ করে। রং যখন তার সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়, ফর্মও তখন তার শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করতে সক্ষম হয়। সুলতানের ছবিতে কর্ষিত জমি, ফসলের খেত, বৃক্ষ-বনভূমি, ছনের ঘর ইত্যাদি কম্পোজিশন, ফর্ম, রং ও সুলতানের ব্যক্তিত্ব প্রকাশের একটি ভঙ্গিমাত্র। সুলতানের চিত্রকর্মগুলো শুধু চিত্র নয়, বরং শক্তিশালী আখ্যান, যা দর্শকদের কাছে গভীর অভিব্যক্তিপূর্ণ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে।
আমরা তার ছবিতে প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি গ্রামের সাধারণ মানুষ, কৃষক, জেলে, গৃহবধূ, কৃষাণীর অক্লান্ত পরিশ্রম আর সংগ্রামকে দেখতে পাই। তার চিত্রপটে এই অঞ্চলের প্রকৃতির সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক, তাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক অবস্থার চিত্র খুঁজে পাই। আমাদের আবহমান বাংলার প্রতিবেশ তার প্রতিটি পরিসরকে সমৃদ্ধ করেছে। আর তিনি আমাদের সমৃদ্ধ করেছেন তার শিল্পচেতনা দিয়ে।
৩.
আর্ট কলেজে নিয়মমাফিক শিল্পশিক্ষা শেষ না করেই ১৯৪৪ সালে সুলতান ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। কলকাতা ছেড়ে ভারতের অন্যান্য রাজ্যে ছবি আঁকার বিষয়বস্তু খুঁজে বেড়িয়েছেন। কাশ্মীরে কাটিয়েছেন ১৯৪৪-৪৬। একে তো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছিল, আবার তখন কাশ্মীরের রাজনৈতিক অস্থিরতাও দেখা দিয়েছিল। এর মধ্যে তিনি আঁকছিলেন কখনো যুদ্ধের ছবি, কখনো অনাহারকৃত শরণার্থীর মুখ, কখনো ছিন্নমূল পরিবারের আর্ত-চেহারা আর কিছু ব্যক্তিগত প্রতিকৃতি। সুলতানের সংগ্রহে পুরোনো সেই সময়ের কোনো কাজ পাওয়া যায়নি, এই সময়ের কাজ সম্ভবত তিনি সব বিক্রি করে দিয়েছিলেন। জানা যায়, তিনি এ সময়ে প্রধানত নিসর্গ-দৃশ্যই এঁকেছিলেন—বাংলার ও কাশ্মীরের। তার প্রায় সকল নিসর্গ-চিত্রায়ণই স্মৃতিনির্ভর ছিল। এ কারণে তার ছবিতে আদর্শায়নের একটি প্রবণতা দেখা যায়। এবং একই সঙ্গে তা সংবেদনশীল। বিশেষ করে স্থানীয় গ্রামীণ লোকজন তার ক্যানভাসে এসেছিল।
সুলতানের ছবি আঁকার স্বাচ্ছন্দ্য ছিল অবিশ্বাস্য। ধারণা করা যায়, তিনি কখনো দীর্ঘ সময় নিয়ে ছবি আঁকতেন না। তিনি অস্থির প্রকৃতিরও ছিলেন। ফলে সুলতান কখনো সুচারুভাবে তার ছবি শেষ করেছেন বলে মনে হয় না। বরং তার বেশির ভাগ কাজই স্কেচ-পর্যায়ের ছিল। জলরঙে আঁকা বাংলার নিসর্গ-দৃশ্যের সহজ-সরল বর্ণবিন্যাস, যেখানে আকাশ ও নদীর অবাধ বিস্তার, অদৃশ্য হতে থাকে দিগন্ত, নারকেল গাছ, নৌকা, জেলে—সাধারণ গ্রামীণ পরিবেশকে উপস্থাপন করে। তেলরঙে আঁকা কাশ্মীরের নিসর্গ-চিত্রায়ণ ছিল খুবই বর্ণিল। বাংলার নিসর্গ-দৃশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্রপটে করা কাশ্মীরের সেই বেগুনি রঙের পর্বত, বিচিত্র ঝোপঝাড়, গাছ, নদী ও হ্রদের ছবিগুলো দর্শকদের সামনে অন্য এক সুলতানকে দাঁড় করিয়ে দেয়।
কাশ্মীরে তিনি যে সময় কাটিয়েছেন, তার একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব দেখা গিয়েছিল পরবর্তী সময়ে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর, লাহোর, করাচি পেরিয়ে তিনি আরও দূরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড ও ইউরোপ সফরে গিয়েছিলেন এবং বেশ কিছু প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি নড়াইলে ফিরে যান। নিজেই বলেছিলেন, তিনি যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করেই দেশে ফিরে এসেছিলেন। কারণ, নিজের পরিবেশ, মানুষের জন্যই তিনি ছবি আঁকতে চেয়েছেন সব সময়। আর এ সময়ে তার চিত্রকর্মে প্রধান উপজীব্য হয়ে উঠেছিল ‘মানুষ’।
৪.
শিল্পী সুলতানের চিত্রকর্মকে বিশ্লেষণ করলে ইম্প্রেশনিস্ট ধারায় গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী পল গগাঁর শিল্পীজীবনকে উল্লেখ করতে হয়। গগাঁ প্যারিস থেকে চলে গিয়েছিলেন প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর জেগে থাকা তাহিতি দ্বীপের ভূমিপুত্রদের লৌকিক মায়াজগতে, বুর্জোয়া চিত্রপ্রকরণ থেকে তিনি নিজের শ্রেণিচ্যুতি ঘটিয়ে চিত্রকল্প ও বাস্তবতাকে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। আধুনিকতার বিচ্ছিন্নতাবাদ, ব্যক্তিবাদবিষয়ক চিন্তাগুলোকে তাহিতি সিরিজের চিত্রমালার মধ্য দিয়ে তিনি উন্মোচন করেছিলেন। যাপন করেছিলেন এক সরল সাধারণ, প্রকৃতি সান্নিধ্যের নিবিড় মানুষের জীবন। নাগরিক জীবনের সুখ-দুঃখ, গরিমা উপেক্ষা করে শিল্পের অভিমুখ পরিবর্তন করে নিয়েছিলেন অনায়াসে। আর সুলতানের প্রতিবেশ ভিন্ন, সভ্যতার বিপরীতের এক মায়ার জগৎ, কৃষিসর্বস্ব বাংলাকে তিনি স্বপ্নবাস্তবতায় পুনর্নির্মাণ করেছিলেন।
শিল্পী সুলতান বাংলার লোকায়ত জীবনের গল্প এমনভাবে এঁকেছেন, যেখানে মানুষের সংগ্রামী জীবনের কোনো ক্লেদ নেই; আছে গৌরব। কৃষকের শীর্ণকায় দেহ নয়, বরং পেশিবহুল দেহসৌষ্ঠব। নারী আলাদা ম্রিয়মাণ নয়, বরং কোমল আর সবল। তিনি মনে করতেন, মানসিক শক্তি পেশির মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করা শিল্পের নতুন ধারার সূচনা ঘটাতে পারে। সংগ্রাম মানুষকে কঠিন করে তোলে; ভঙ্গুর নয়। চিত্রপটে কখনো কখনো তিনি গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের শ্রেণি-দ্বন্দ্ব, বৈষম্য, বিদ্রোহ অর্থাৎ বাস্তবতার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলোকে তথাকথিত আধুনিক দর্শকদের সামনে উপস্থিত করে গেছেন।
শিল্পী সুলতানের চিত্রকর্মকে দর্শক কীভাবে দেখছেন, ব্যাখ্যা করছেন, তা প্রাসঙ্গিক বর্তমান সময়ে। দরিদ্র দেশের কৃষকদের এমন ‘দেহ’ বেশ প্রশ্নের উদ্রেক ঘটায়। ভারতীয় ষড়ঙ্গের রীতিকে এই ‘মানুষ’ উপেক্ষা করে কি? প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যে ‘আদর্শিক’ রূপের ইঙ্গিত দর্শক দেখতে পায় না শিল্পী সুলতানের চিত্রমালায়। বরং সুলতান নতুন ‘আদর্শিক’ ধারণা নির্মাণ করেছেন তার চিত্রপটে। বাংলার নিজস্ব রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক কাঠামোতে সুলতানের ‘মানুষ’ প্রচ্ছন্নভাবে বিষাক্ত অসাম্যকে বিনাশ করে। সুলতানের ‘দেহের অতিরঞ্জন শক্তি’ তার সামর্থ্যের আধার হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। সমগ্র মানব ইতিহাসের গৌরবকে শিল্পী এস এম সুলতান ইঙ্গিত করেছেন তার চিত্রকর্মে। তিনি মানব সভ্যতার আদিমতাকে পুনঃগ্রহণ করেছেন; আর প্রত্যাখ্যান করেছেন আধুনিক জীবনের চাকচিক্যকে। আর তিনি শিল্পীজীবনকে নির্মাণ করেছেন সম্পূর্ণ দ্বিধাহীন স্বকীয়তায়। এই জগতের উৎপাদনের প্রধান চালিকাশক্তিকে বিষয় হিসেবে নির্বাচনের পাশাপাশি ভেষজ রং, নানান উপাদান, করণকৌশল, চিত্রের মাধ্যম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিজস্ব শৈলীকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন অনায়াসে।
শিল্পচর্চায় এই নিবেদিতপ্রাণ শিল্পী বাঙালি তথা সমগ্র মানবজাতিকে জীবনের চিরন্তন সত্যের সম্মুখীন করেছেন। এই শিল্পসাধকের এক শ বছর উদ্যাপনের প্রাক্কালে আমাদের শিল্প-ইতিহাসকে পুনর্পাঠের তাগিদ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হয়ে ওঠার গল্প, প্রচলিত মূল্যবোধের বিরোধিতা, অধিকার ও দায়িত্বের সম্প্রসারণ, শারীরিক সামর্থ্যের রূপায়ণের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হবার প্রেরণা জোগায়।
ছবি: সংগ্রহ