মনোজাল I দ্য বেডটাইম সিগন্যাল
শুধুই কি শরীরের আরাম! নাকি মিলবে মানসিক প্রশান্তিও? বিতর্ক চলছে বহু আগে থেকে
রাতে কী পরে ঘুমানো হয়? ব্যাপারটা একান্ত ব্যক্তিগত। কিন্তু এ নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে। আজকাল অনিদ্রা রোগ কেমন বেড়েছে, তা নিশ্চয় জানা আছে। এর প্রধান কারণগুলোর একটি কিন্তু পোশাক। পশ্চিমা বিশ্বে রাতে কিছু না পরে ঘুমানোর হার অনেক বেশি, তুলনায় পুবদেশীয় সভ্যতায় এমনতর চর্চা যথেষ্ট কম। এর মধ্যে আবার বেশির ভাগের অভ্যাস দিনে পরা পোশাকেই রাতে ঘুমিয়ে যাওয়া। সেটিও সঠিক নয়। অতিমাত্রায় কিংবা একদম কিছু গায়ে না দিয়ে ঘুম—দুটোকেই ভুল বলছেন গবেষকেরা। তাহলে সঠিক কী? সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে নিজ শরীর সম্পর্কে জেনে নেওয়া জরুরি।
অনেকের হয়তো জানা নেই, মানব শরীর একটি চলমান ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রিত হয়, যা সার্কেডিয়ান রিদম নামে পরিচিত। আলো ও তাপমাত্রার পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ার একটি চক্রাকার চেইন; যাকে সহজ করে বললে দেহের অভ্যন্তরীণ টাইমকিপার বলা যেতে পারে। এই অবচেতন চক্রের প্রতিক্রিয়াগুলো মেজাজ, শরীর ও মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হিসেবে প্রকাশ পায়। রাত যত গভীর হয়, দেহের তাপমাত্রা ক্রমাগত কমে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাই ঘুম ভাঙার প্রবণতা চোখে পড়ে, বেশির ভাগ সময় পায় ক্ষুধা। বিশ্রামের সময় শরীর যে তাপমাত্রায় পৌঁছায়, তার ওপর ভিত্তি করে ঘরের আদর্শ তাপমাত্রা হলো ৬৬ থেকে ৭০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এই হিসাব ব্যক্তির ওপর ভিত্তি করে কয়েক ডিগ্রি এদিক-সেদিক হতে পারে; তবে এটি প্রায় সর্বজনীন। কিন্তু এসবের সঙ্গে পোশাকের কী সম্পর্ক? আছে এবং তা অনেক গভীর। কারণ, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পোশাক শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। তবে সব নয়, যেটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি পায়জামা। তরুণদের মাঝে খুব জনপ্রিয় পিজে হিসেবে। বিক্ষিপ্ত মনকে একটি পরিচালনাযোগ্য রুটিন প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করতে পারে এই পোশাক। এক কাপ স্লিপিটাইম টি, একটি ভালো বই আর একটি পায়জামা যদি প্রতিদিনকার স্লিপ রুটিনের অংশ হয়ে ওঠে, তাহলেই সমস্যা কমতে শুরু করবে। এই মন্তব্য ঘুম ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অ্যালেক্স দিমিত্রির। তার মতে, দিন শেষে কাজের পোশাক খুলে ফেলার মধ্যে যে স্বস্তি মেলে, তেমনি এ পায়জামাগুলোও আসন্ন ঘুমের সময়কে স্মরণ করিয়ে দেয়।
ঘুমের ক্ষেত্রে পায়জামার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য অনেকগুলো কারণও দেখানো হয়েছে। যেমন পায়জামা আরাম ও প্রশান্তির অনুভূতি দেয়। অনুপযুক্ত পোশাক বা উন্মুক্ত শরীর তীব্র অনিদ্রার কারণ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সুন্দর ঘুমের জন্য বিশেষভাবে তৈরি একটি পিজে সেট শরীরের জন্যও ভালো বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যারা একদম খালি গায়ে বা বক্সার পরে ঘুমান, তাদের জন্য বিষয়টি যে একেবারেই অনুচিত, তা রীতিমতো প্রমাণ করে দেখানো হয়েছে। কীভাবে? গবেষকদের মতে, মানবদেহ এক রাতে প্রায় তিন লাখ মৃত ত্বককোষ তৈরি করে। প্রতি ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার। আর প্রতিটি ঘুমের চক্রের প্রায় এক-চতুর্থাংশ সময়জুড়ে ঘাম তৈরি হয়। সুতরাং, কেউ নগ্ন বা অর্ধনগ্ন হয়ে ঘুমালে, ঘাম সরাসরি বিছানার চাদরে লেগে যাবে। তারপর সেটি শরীরের সঙ্গে মিলেমিশে একধরনের অস্বস্তির জন্ম দেবে অজান্তেই। এতে সাউন্ড স্লিপ বাধাগ্রস্ত হবে। আর যদি পায়জামা পরা থাকে, তা শরীর ও চাদরের মধ্যে একধরনের দেয়াল হিসেবে কাজ করবে। পায়জামাকে বলা হয় প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার নিশান।
তবে উল্টো যুক্তিও আছে। অনেকের মতে, পায়জামা ক্ষেত্রবিশেষে শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। পায়জামা ছাড়া খুব ঠান্ডা অনুভূত হওয়ার সঙ্গে এটি পরলে শরীর গরম হয়ে ওঠার প্রবণতাও তৈরি হতে পারে। ২০১৯ সালে এ বিষয়ে একটি সম্পূর্ণ সমীক্ষা করা হয়েছিল। বিছানায় যাওয়ার আগে যা পরা হচ্ছে, তা ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে কি না, সেটি নিরূপণই ছিল মূল উদ্দেশ্য। সেই গবেষণায় পাওয়া গেছে, স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছাড়াই প্রাপ্তবয়স্কদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পরিবেশের তাপের তারতম্যই যথেষ্ট। আরও বলা হয়েছে, সিনথেটিক কাপড় দিয়ে তৈরি পায়জামা ঘুমানোর জন্য উপযুক্ত নয়। তাই পায়জামা কেনার সময়, পলিয়েস্টার, রেয়ন বা স্প্যানডেক্স এড়িয়ে চলা ভালো। এগুলো শরীরকে অতিরিক্ত গরম করে তুলতে পারে; যা অনেক সময় অনিদ্রার কারণ হয়ে ওঠে। সুতি পায়জামার ক্ষেত্রে সেই সমস্যা অবশ্য নেই। তবে পিয়ার-রিভিউড মেডিকেল জার্নাল অ্যান্ড্রোলজিয়াতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় মিলেছে পিজে নিয়ে নেতিবাচক তথ্য। বলা হয়েছে, পায়জামা পরে ঘুমানোর অভ্যাস থেকে সৃষ্ট ‘জেনিটাল হিট স্ট্রেস’ শুক্রাণুর গুণমান কমিয়ে দিতে পারে। সঙ্গে আঁটসাঁট আন্ডারওয়্যারের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। মোদ্দাকথা, কেউ যদি বিছানায় বটম পরতে পছন্দ করেন, সে ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ফাইবারে তৈরি, ঢিলেঢালা এবং অনায়াসে বাতাস চলাচল করতে পারে এমন কিছু বেছে নেওয়াই উত্তম।
তবে এখানেই শেষ নয়, পায়জামা নিয়ে মিলেছে নেতিবাচক তথ্যও। ২০১৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুমের সময় পার্টনারের সঙ্গে স্কিন-টু-স্কিন কন্ট্যাক্টের ফলে অক্সিটোসিন নিঃসরণের মাত্রা বাড়ে। এটি একধরনের হাইপোথ্যালামিক নন-পেপটাইড, যা সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, সুস্থতা ও অ্যান্টিস্ট্রেসের মাত্রা বাড়ার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু পায়জামা পরলে স্কিন-টু-স্কিন কন্ট্যাক্ট ব্যাহত হয়। ফলাফল, নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সম্পর্কে।
রত্না রহিমা
মডেল: মাহি
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ক্যানভাস