ছুটিরঘণ্টা I নীল-সবুজের দেশে
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে টইটম্বুর। ভ্রমণার্থীদের রুচির খোরাক মেটাতে দারুণভাবে প্রস্তুত। শ্রীলঙ্কা ভ্রমণের গল্প শোনাচ্ছেন ফারহানা মান্নান
টমটমে চেপে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা এক অর্থে দারুণ। ঢাকা শহরের রাস্তায় সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ঘোরা আর টমটমে শ্রীলঙ্কার কলম্বো শহর ঘুরে বেড়ানো এক কথা নয়। একেবারেই কাছাকাছি কাঠামোর দুটি যানবাহন সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি অভিজ্ঞতার স্বাদ এনে দিল। চ্যাটচ্যাটে ঘাম নেই, ধুলোর রাজ্যের ইচ্ছেমতো বাহাদুরি নেই, প্যাঁ-পে্যাঁ শব্দেও দুই কর্ণ কালা হয়ে যাচ্ছে না! ছিমছাম গোছানো চারপাশ, চারপাশের মানুষ এবং তাদের আচার। চমৎকার ইংরেজি শব্দে কমিউনিকেট করা যাচ্ছে মোটামুটিভাবে সব স্তরের মানুষের সঙ্গে। এ বেশ আরাম আর স্বস্তির বিষয় বটে! ভ্রমণে কমিউনিকেশন গ্যাপের হ্যাপা সামলানো কি আর সহজ কথা?
কোনো দেশে ভ্রমণে গেলে আমাদের দেখার ক্ষেত্রে আগ্রহের জায়গা থাকে কোনগুলো? আমরা সে দেশের দর্শনীয় স্থানগুলো খুঁজি, দেখি। সেই সব জায়গার সাজেশন আগে থেকেই বইপত্র ঘেঁটে কিংবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে জেনে নিই। লঙ্কা ভ্রমণের ক্ষেত্রে এই লিস্ট তৈরির কাজটি সহজ করে দিয়েছে ওয়ান্ডার ওমেন। এরা নানা পেশা, কাজ, ব্যস্ততা ও দায়িত্বের সঙ্গে জড়িত নারীদের একসঙ্গে ভ্রমণের সুযোগ ও সুবিধা তৈরি করে দেয়। এই প্রথমবার আমিও এদের হাত ধরে, পরিবার ছাড়া, একলা ভ্রমণের স্বাদ নিলাম। এ এক অন্য রকম স্বাধীনতা। একটি দেশ, সেখানকার প্রকৃতি দেখার অন্য রকম অনুভূতি। রোজকার নিয়মিত ছকের বাইরে বেরিয়ে পৃথিবীকে দেখার, নিজেকে সময় দেওয়ার, নেটওয়ার্কিং তৈরি করার এক চমৎকার সুযোগ।
দেশ হিসেবে শ্রীলঙ্কা পাহাড় আর পানির মিশেল। বন্দরনায়েকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আমার প্রথম অনুভূতি ছিল: এ যে অতি চেনা শহরের আদলে মোড়া। একটু এগোতেই দুপাশের চিত্রপট বদলে যেতে থাকে উঁচু-নিচু রাস্তার বাঁকে। চারপাশের পাহাড়ের ওপরেই তৈরি নানা বসতি দূর থেকে সবুজের পটে আঁকা প্রকৃতি আর মানবের সম্মিলিত কাজের স্বাক্ষর বহন করে। সবুজ পাহাড়ের ঢালে যেমন মানুষের বাস, তেমনি পাহাড়ের ঢালে চলে চা উৎপাদন।
শ্রীলঙ্কা চায়ের দেশ। এখানে এমন সব চায়েরও দেখা পেলাম, যেগুলোর রং নেই; অথচ নানা রোগপ্রতিরোধের গুণাগুণে ভরপুর। গোল্ড ও সিলভার চায়ের নাম শুনলাম এই প্রথম। এই চায়ের দামও বেশ চড়া। নানা ঘ্রাণের চা এখানে তৈরি হয়। আপেল, সিনামন, লেমন, স্ট্রবেরি, ম্যাঙ্গোসহ বিবিধ ফ্লেভারের চা দেখে আমি রীতিমতো মুগ্ধ! চা উৎপাদন, প্রেজেন্টেশন, তথ্য শেয়ারিং, উৎপাদন প্রণালি শেয়ারিং, টি-টেস্টিং, নানা রকম চায়ের প্রদর্শনীÑ সব মিলিয়ে চা-সম্পর্কিত নানাবিধ কৌতূহল নিবৃত্ত হলো দামরো টি ফ্যাক্টরিতে এসে।
ক্যান্ডি শহর ঘুরে, নুয়ারা এলিয়া হয়ে, এল্লা থেকে, মিরিসা হয়ে আমাদের যাত্রা শেষ হয়েছিল কলম্বো শহরে। ক্যান্ডি শহরের প্রধান আকর্ষণ টেম্পল অব দ্য স্যাক্রেড টুথ রেলিক। টেম্পলে ঢোকার আগে জুতা খুলে নিতে হয়। অফ-শোল্ডার পোশাক পরে এখানে কেউ আসেন না। শর্টস পরাও নিষিদ্ধ। শর্টস পরিহিত পর্যটকদের জন্য ওড়না ভাড়া করে গায়ে জড়িয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। টেম্পলের মূল দরজা দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের নানা আচার-অনুষ্ঠান। ছবি তোলায় কোথাও কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই; তবে বুদ্ধমূর্তির দিকে পেছন ফিরে ছবি তোলা বারণ। পুরো টেম্পলটি বেশ পরিচ্ছন্নভাবে যত্ন করে রাখা। টেম্পল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে নজরে পড়ল শিশুদের আঁকা ছবি নিয়ে এক চমৎকার প্রদর্শনী। টেম্পলে এমন প্রদর্শনীর আয়োজন আমার এই প্রথম দেখা। একই সঙ্গে মনে হলো, যেকোনো অবস্থান থেকেই শিশুদের জন্য কাজ করা, শিশুদের কাজকে সামনে আনা, ওদের সৃজনশীলতাকে বাহবা জানানো সম্ভব। উপাসনা, প্রদর্শনী, কাঠামোগত সৌন্দর্যসহ সবকিছু মিলিয়ে এই স্থান তাই এক অন্য রকম আবেগের আলোড়ন তৈরি করে, যা এককথায় প্রশান্তি ও প্রশংসার!
নুয়ারা এলিয়াতে দর্শনীয় স্থান একাধিক। ভিক্টোরিয়া পার্ক, গ্রেগরি লেক, সিতা আম্মান কোভলি, বোটানিক্যাল গার্ডেন, রামবোডা ফলস- এসব স্থান ঘুরেফিরে দেখা হলো। থাকার জন্য বেছে নিয়েছিলাম মিরাজ কিংস কটেজ। নুয়ারা এলিয়া চমৎকার পরিচ্ছন্ন শহর। সাজানো গোছানো। আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে ওখানে পৌঁছে বাংলাদেশের কালবৈশাখীর সাক্ষাৎ পেলাম। রাতে কটেজে ঠান্ডায় কাঁপুনি ধরে গেল। উষ্ণ সময়ের দেশে শীতের কাঁপুনি সত্যিই বিস্ময়ের! ওসব হালকা বা পাতলা চাদরে আর আমার হয়নি। একেবারে সোয়েটার পরে, সোজা কম্বলের নিচে ঢুকে, গা গরম করা ছাড়া উপায় ছিল না। দারুণ বিষয় হলো, প্রতিটি হোটেলেই ছিল চমৎকার চা ও কফির আয়োজন। আর গরম পানির স্নানে উড়ে গেছে সারা দিনের ভ্রমণের সব ক্লান্তি! শ্রীলঙ্কার আরেকটি প্রশান্তি হলো সোনালি ডাবের পানি। যেমন মিষ্টি, তেমন তার রং! আমাদের দেশি ডাবের সঙ্গে তুলনা করলে শ্রীলঙ্কার সোনালি ডাবে লবণাক্ত স্বাদ পাইনি। বাংলাদেশি ডাবের পানি বেশ হৃদয় শীতল করা; তবে স্বাদ কিছুটা নোনতা। অবশ্য, দুই রকমের ডাবই প্রশান্তির!
শ্রীলঙ্কা ভ্রমণে কেউ যাবেন, অথচ ট্রেনের অভিজ্ঞতা নেবেন না- এমনটা সাধারণত হয় না। কারণও আছে। ট্রেন জার্নির আনন্দ চারপাশের পাহাড়ের সৌন্দর্যে ঘেরা। ধবধবে সাদা মেঘ আকাশ থেকে নেমে পাহাড়ের চূড়ায় মিশে গেছে। ছুটতে থাকা ট্রেনের দরজার ধার ঘেঁষে দাঁড়ালে মেঘের পানির ছাট লাগে গায়ে। অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ, এমন মানুষ ট্রেনের দরজার মুখের হাতল ধরে ঝুলে নাটকীয় ভঙ্গিতে ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারেন না; যদিও এ ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন জরুরি, সে কথা বলা বাহুল্য। তবে ট্রেন স্টেশনের চিত্র কিছুটা ম্লান। একটি অতি পুরোনো চেহারার আদল নিয়ে দাঁড়িয়ে। ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাস ও সেকেন্ড ক্লাস- দুই ধরনের বগিই ছিল। সেকেন্ড ক্লাসের দশা সাধারণ পাবলিক ট্রান্সপোর্টের মতোই। বসার সিট পাওয়া সৌভাগ্যের! টিকিট কেটে বসার সিট পাবার আশা শতভাগ করা যায় না। সেকেন্ড ক্লাসে উঠে তাই অনেকটা পথ দাঁড়িয়ে পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি রাখা চাই। আমার অবশ্য চলন্ত ট্রেনের দরজার ধারে বসে পা ঝুলিয়ে দেওয়ার অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম হলো।
মিরিসার সৌন্দর্যের মূলে সমুদ্র। কোকোনাট ট্রি হিলে দাঁড়িয়ে সাগর দেখার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল। আর্দ্র আবহাওয়া ছিল নোনতা স্বাদের! সামুদ্রিক বাতাসের ঘ্রাণ ছিল লোনা! বৃষ্টিতে ভেজা লাল আঠালো মাটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাঁটায় বিড়ম্বনা তৈরি করেছিল। আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে দূর থেকে হাতছানি দেওয়া সমুদ্রের পানি হৃদয়ে সৃষ্টি করেছিল অধরা অনুভূতি। দূর থেকে ছুটে আসা পানির স্রোতের দৃশ্য ছিল চোখের জন্য এক রোমান্টিক আরাম! কিছুক্ষণ বসে থেকে উপভোগ না করতে পারলে এ দৃশ্য হৃদয়ে ধারণ করা কঠিন।
শ্রীলঙ্কা সবুজ পাহাড়ের দেশ, নীল সমুদ্রের দেশ। আবহাওয়ার ভেল একেক শহরে একেকভাবে বদলে যাওয়ার দেশ। কলম্বোতে পৌঁছে টমটমে করে শহর ঘুরে পেলাম দেশটির আরও নানা রূপ ও রসের পরশ। যাওয়ার আগেই জেনেছিলাম, বিভিন্ন রকম দামি পাথর ওখানে কিনতে পাওয়া যায়। ব্লু সাফায়ার আমার বিশেষ পছন্দের। সন্ধানও পেলাম। কানে ঝোলানো দুলে নান্দনিক শৈলীতে বসানো। দাম আকাশছোঁয়া বলা যাবে না। সামর্থ্য থাকলে কেনা সম্ভব।
লঙ্কার আরেক সৌন্দর্য সামুদ্রিক মাছের বৈচিত্র্য। ক্র্যাব খেতে চাইলে কলম্বো শহরের মিনিস্ট্রি অব ক্র্যাব উপযুক্ত ডাইন-ইন প্লেস। ভালো জাপানিজ খাবার শ্রীলঙ্কায় বসে খেতে চাইলে ১১ গাল্লি ফেইস টেরেসের নিহোনবাসি সঠিক জায়গা। ইন্টারন্যাশনাল স্বাদের নানা খাবারের খোঁজ করলে ২ আলফ্রেড হাউসের গ্যালারি ক্যাফে উপযুক্ত স্থান। তা ছাড়া শ্রীলঙ্কান খাবারের স্বাদ পেতে চাইলে নানা রেস্তোরাঁ আছে প্রতিটি শহরে। নারকেলের দুধে রান্না সবজি ও মাছের স্বাদ চমৎকার। টুনা মাছের নানা রকম প্রিপারেশন আমি এই সফরে পরখ করে দেখেছি। দেশে ক্যানড টুনা দিয়ে স্যান্ডউইচের স্বাদ বেশ লাগে। সেই তুলনায় শ্রীলঙ্কার ফ্রায়েড টুনা কিংবা নারকেলের দুধে রান্না টুনার টেস্ট একেবারেই ভিন্ন; মজার। স্বাদ দারুণ হলেও টুনা রান্নার পর মাছের টেক্সচার বেশ হার্ড পেলাম। তাতে অবশ্য মাছের নিজস্ব ঘ্রাণের গুণাগুণ নষ্ট হয়নি একেবারেই। আরেকটি মজার খাবার কোকোনাট আইসক্রিম। ঢাকায় এর স্বাদ নেওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল আমার। তবে শ্রীলঙ্কায় এই আইসক্রিমের স্বাদ পাওয়া গেল চকলেট ফ্লেভারের অন্য ধারার মিশ্রণে। সৃজনশীল মিশ্রণ হলেও খেতে অবশ্য খুব একটা ভালো লাগছিল না! বরং নারকেল কোরা দিয়ে মিশিয়ে এর ইউনিক স্বাদ ফুটিয়ে তুলতে পারলে ভালো হতো, এ আমার ব্যক্তিগত ধারণা। আরেকটি বিষয়, শ্রীলঙ্কা নানা রকম খাবারের দেশ হলেও তাতে ভারতীয় খাবারের প্রভাব বেশ স্পষ্ট!
এ দেশে ঘুরতে এসে নানা রকম অ্যাকটিভিটির সুযোগ রয়েছে। হর্স রাইডিং, বোট রাইডিং, সুইং, মাউন্টেইন ক্লাইম্বিং, সুইমিংসহ অনেক কিছু করে সময় কাটানো যায় দারুণভাবে। আমার মনে হয়েছে, এখানে প্রকৃতি এত রিচ, তাই রং, তুলি আর ক্যানভাস নিয়ে চমৎকারভাবে সময় কাটানো হবে আরামদায়ক। একে বলা যায় ফুড ফর সোল! যদিও সংক্ষিপ্ত সময়কালের সফরের কারণে আমি রং আর তুলি নিয়ে বসার সুযোগ পাইনি; তাই পরবর্তী ভ্রমণের জন্য এ ইচ্ছা তুলে রাখলাম।
বুক লাভারদের জন্য সমস্যা হলো, এখানকার পাবলিক লাইব্রেরি বিকেল পাঁচটার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। সময় সংক্ষিপ্ত হলে, বসে সময় নিয়ে পড়ার সুযোগ বের করা কঠিনÑ তা তো জানা কথাই। অবশ্য বুকস্টোরের সন্ধানও পেয়েছি অবশেষে, কলম্বো শহরে এসে। গাল্লি ফেস শপিং মলে। বিল গেটসের হাউ টু প্রিভেন্ট নেকস্ট প্যানডেমিক, আনুক আরুদপ্র্যাগাসামের আ প্যাসেজ টু নর্থ, হাইমিন সুনিমের দ্য থিংস ইউ কেন সি ওনলি হোয়েন ইউ স্লো ডাউন ছিল আমার কেনার তালিকায়। দ্য এইজ অব এম্প্যাথি কিনতে না পারার দুঃখটা নিয়েই ফিরতে হয়েছিল ওজন সমস্যার কারণে। তবে শিশুদের জন্য চমৎকার সব বইয়ের দেখা মিলেছে। মুগ্ধ হয়েছি ওদের জন্য উপযুক্ত চমৎকার খেলার সামগ্রী দেখেও। স্টিম (STEAM=science, technology, engineering, art and mathematics) ইন আর্লি চাইল্ডহুড নিয়ে কাজ করি বলেই এ ধরনের খেলার সামগ্রী দেখে আমার মুগ্ধতা বেড়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে হিউম্যান বডি সম্পর্কে শিশুদের খেলার মাধ্যমে শেখানোর জন্য উপকরণ সাধারণত একেবারেই পাওয়া যায় না; অথচ শ্রীলঙ্কায় এর দেখা পেলাম! খেলতে খেলতে মানবদেহের ইনটেস্টাইন কীভাবে কাজ করে, হার্ট কী করে কাজ করে- সে সম্পর্কে জানার এক চমৎকার খেলার বাক্স পেয়ে গেলাম। তবে এই কনসেপ্ট কাজে লাগিয়ে লো কস্ট ম্যাটেরিয়াল দিয়ে আমার সেন্টার ‘শৈশব’-এ শিশুদের জন্য লার্নিং ম্যাটেরিয়াল আমরা নিজেরাই বানিয়ে নিচ্ছি! যদিও এমন তৈরি উপকরণ হাতের কাছে পেলে লার্নিং পরবর্তী স্টেজে পৌঁছে যেত সহজেই।
শুরুতে বলছিলাম না, একটি দেশ ভ্রমণে কী দেখার থাকে? দেখার থাকে সেই দেশের শিল্প, সংস্কৃতি, মিউজিয়াম ও শিক্ষা। মন্টেসরি ট্রেনিং একাডেমির দেখা পেলাম শিক্ষকদের জন্য। একাধিক পেইন্টিং এক্সিবিশন ঘুরে বোঝার চেষ্টা করলাম এ দেশের আর্টিস্টরা রং ও ক্যানভাস নিয়ে কীভাবে ভাবেন, কাজ করেন। পেইন্টিংয়ের পাশাপাশি এর বাঁধাইও এক শিল্প! একটি কাজ বেশ দারুণ লাগল। লাল মাটির ওপর শ্রীলঙ্কান ফন্টের কাজ বাঁধাই করা! এ দেশের মাটির রং লাল। একটি দেশের মাটিও শিল্প ও সংস্কৃতির আওতায় কত সৃজনশীলভাবে আনা যায়, সেই উদাহরণ পেয়ে মুগ্ধ হলাম। আরও দেখলাম এ দেশের অলংকারের ক্ষেত্রে দেশি ফন্ট, কৃষ্টি, কালচার ও পশুর আদলের ব্যবহার। বিশেষ করে হাতির দাঁতের নানা কাজ। হাতির শেপের অলংকার এত নান্দনিক! আসলে কতভাবেই তো একটি দেশের ভাবমূর্তি নানা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। এই পৌঁছে দেওয়ার ধরনেই দেশটির মানুষের দেশপ্রেম ও একাত্মবোধ ফুটে ওঠে। অলংকারগুলো ছুঁয়ে মনে হলো, এমন তো আমাদের দেশেও হতে পারে। আমরা তৈরি করতে পারি। যদিও আমাদের দেশে রয়েছে মাটির নানা কাজ। আছে নানা ম্যাটেরিয়ালের ব্যবহার। এই ব্যবহারে বাড়তে পারে সবুজ ও লালের প্রয়োগ। হাজির হতে পারে গ্রামবাংলার নব উপস্থিতি। সৃজনশীলতার তো কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। হয়ও না!
শ্রীলঙ্কা স্পা লাভারদেরও দেশ। নানা রকমের বাহারি হারবাল প্রোডাক্টের দেখা মেলে এখানে। আছে নানা রকম মদ ও ওয়াইনের দোকান। বাহারি পানীয় থরে থরে সাজানো। নানা মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে তা কেনায় ব্যস্ত; আর কিছু পর্যটক ওখানে পৌঁছেই খোঁজ নেন স্পার রাইট শিডিউলের। ওখানকার মানুষ বোঝেন, সারা দিনের হাঁটাহাঁটির পর ফুট মাসাজ কতটা আরামদায়ক। হোটেলগুলোর কাছে-ধারে খোঁজ করলে কিংবা ভালো মানের হোটেলেই মিলে যায় স্পার সুবিধা।
আমার বরাবরই মনে হয়, একটি দেশকে শুধু পাহাড়, পানি বা দর্শনীয় স্থান দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। বুঝতে গেলে সে দেশের মানুষকে দেখা চাই। যাওয়া চাই তাদের কাছাকাছি। এর জন্য কফি প্লেসগুলো নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এক কাপ কফি খেতে খেতে চারপাশের মানুষ দেখতে দেখতে জানা হয়ে যায় তাদের রুচির প্রকৃতি। বোঝা যায় খাবারের ধরন, বোঝা যায় আলাপের উষ্ণতা। ছোঁয়া যায় কমিউনিকেশনের গতি। তবে পাঁচ বা ছয় দিনের সফরে সেটা আর কতখানি সম্ভব? তবু ইচ্ছা জাগে এমন ভ্রমণের, যেখানে শুধু দেশ বা দর্শনীয় স্থান দাপিয়ে বেড়ায় না; বরং জায়গা করে নেয় মানুষ, মানুষের চিন্তা, কাজ ও সম্ভাবনা! আর দেখুন না কী চমৎকারভাবে একটি দেশ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে রাজনৈতিক সমস্যা মোকাবিলা করে! এ-ও তো দেখার ও শেখার বিষয়, নাকি? আসলে জয়টা মানুষের। মানব সন্তানের জন্ম না হলে একটি দেশ থেকে আরেকটি দেশকে এত সূক্ষ্মভাবে আলাদা করা সম্ভব হতো কি? কাজেই জয়তু মানুষ। জয় হোক মানব জন্মের। শুভেচ্ছা আর শুভকামনায় মুড়িয়ে তাই বিদায় জানালাম শ্রীলঙ্কা নামক এক দেশকে, যেখানকার মানুষ চরম রাজনৈতিক লঙ্কাকান্ডের পরও এমন চমৎকারভাবে ঘুরে দাঁড়াতে জানেন!
ছবি: লেখক ও ইন্টারনেট