সঙ্গানুষঙ্গ I বিন্দু বিবর্তন
কস্তুরী, চন্দন, কুমকুম, কাজল, কাঁচপোকা কিংবা পাতা কাটা নকশার সেকেলে টিপের রূপরেখায় বদল ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু কদর কি কমেছে? তারই খোঁজ করেছেন নওরিন আক্তার
সুতি শাড়ি। সঙ্গে মাঝে সিঁথি করে টেনে বাঁধা খোঁপা। চোখে কাজলের ছোঁয়া, কানে ছোট্ট টপ দুল। পরিপাটি এই সাজের পরেও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, কী যেন একটা নেই। দুই ভুরুর মাঝখানে একটি গোল টিপ যদি টুপ করে বসে যায়। ব্যস! নিমেষেই সাজে চলে আসবে পূর্ণতা। শুধু কি শাড়ি, কামিজ আর কুর্তি-জিনসের সঙ্গে দিব্যি টিপ পরছেন এখনকার নারীরা। একসময় টিপ ছিল সাজের পরিচায়ক। এখন সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যক্তিত্বের অংশ। ফলে সাজটা পরিপাটি হোক কিংবা একটু এলোমেলো, পূর্ণতা আসছে টিপের উপস্থিতিতে।
বিন্দু থেকে ব্যাপ্তি
সংস্কৃত বিন্দু শব্দ থেকে উৎপত্তি বিন্দি শব্দের। এর অর্থ ছোট কণা বা ফোঁটা। নারীর সাজে টিপের প্রচলন ঠিক কবে শুরু হয়েছিল, সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট তথ্য না থাকলেও ইতিহাস এবং প্রাসঙ্গিক বই-পুস্তক ঘেঁটে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। ইতিহাসের অলিগলি বইয়ের লেখক জিয়াউল হক বলছেন, এই রীতি চালু হয়েছে প্রায় ৯৫০০ থেকে ১১৫০০ বছর আগে থেকে। বাল্মীকি যুগে জাতিভেদ বা শ্রেণিভেদ বোঝাতে বিভিন্ন রঙের টিপ পরার চল ছিল। আবার বিবিসির একটি প্রতিবেদন বলছে, টিপকে দূরদৃষ্টি প্রকাশক হিসেবে প্রতীকীভাবে ব্যবহার করা হতো একসময়। ধীরে ধীরে নারীর সাজে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করেছে এটি। কেউ কেউ আবার ধারণা করেন, কাজলের টিপ, সিঁদুরের টিপের প্রচলন শুরুর পর থেকেই রূপবদল হতে থাকে এর। সত্তরের দশকের চলচ্চিত্রগুলোতে দেখা গেছে গোলাকার টিপ পরনে নায়িকাদের। ভুরুর বেশ খানিকটা ওপরেই পরার প্রচলন ছিল সে সময়। ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, অভিনয়শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার পরতেন বড় গোলাকার টিপ। এভাবেই যুগের পর যুগ ধরে দোর্দ- প্রতাপে টিকে থেকে টিপ হয়ে উঠেছে সাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
চাঁদ, তারার মেলা
গোলাকার টিপের আবেদন চিরন্তন। তবে কালের বিবর্তনে এর আকার ও ধরনে এসেছে আমূল পরিবর্তন। গোলের পাশাপাশি বেশ লম্বা একটা সময় পাথরের টিপ ফ্যাশন অঙ্গনে জায়গা দখল করে ছিল। এরপর দেখা গেছে লম্বা ও চৌকোর দাপট। পানপাতা ও ওভাল আকৃতির টিপও নজর কাড়তে শুরু করে একসময়। এমনকি চাঁদ, তারার আদলও টিপ হয়ে জুড়ে বসে কপালে, সাজে বৈচিত্র্য আনতে।
টিপ যখন ক্যানভাস
সাজপোশাকে ছিমছাম থাকাই এখন ট্রেন্ড। মিনিমাল সাজের সঙ্গে ব্যালেন্স করতেই বুঝি বোল্ড টিপ বেছে নিতে শুরু করেন ফ্যাশনপ্রেমীরা। যদিও একরঙাগুলোর আবেদন চিরন্তন; তবে টিপকে সাজাতে নানা ধরনের নিরীক্ষাকেও সাধুবাদ জানিয়েছেন তারা। ফ্যাশন-সচেতনদের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়েই একরত্তি টিপকে ক্যানভাস বানিয়ে চলছে নানা কর্মযজ্ঞ। এই ট্রেন্ডের শুরু হয়েছিল বিবি প্রোডাকশনের হাত ধরে। তাদের রিকশা পেইন্ট ও ফুলেল নকশার টিপ তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে তরুণীদের কাছে। টিপ নিয়ে নতুন এই নিরীক্ষা শুরুর পর রাতারাতি বদলে যায় টিপের ক্যানভাস। রংতুলির ছোঁয়ায় কখনো ফুল, কখনো প্রজাপতি আবার কখনো কলকির নকশা জুড়ে বসতে শুরু করে এতে। জ্যামিতিক নকশায় সেজে উঠতে থাকে। বিভিন্ন চার্ম, বিড আর ঝুমকা বসিয়েও সৌন্দর্যবর্ধন শুরু হয় টিপের। এর ক্যানভাস এতই জীবন্ত হয়ে ওঠে, কখনো মনে হয় হঠাৎ উড়ে আসা একটি রঙিন প্রজাপতি বুঝি পথ ভুলে বসে পড়েছে কপালে! কিংবা তুলির আঁচড়ে কপালের ঠিক মাঝ বরাবর ফুটে উঠেছে আস্ত একটি ফুল।
স্টাইলিংয়ে স্টেটমেন্ট
গোলাকার বা চাঁদ আকৃতির টিপই যে পরতে হবে এমন নয়। ব্যতিক্রমী সব টিপ ব্যবহার করে নিজস্ব স্টাইল স্টেটমেন্টে সেজে উঠছেন অনেকে। যেমন বড় একটি টিপের নিচে কুমকুমের রং অথবা কাজলের লাইন টেনে আনকোরা স্টাইল করে নেওয়া যায়। অনেকে আবার বিভিন্ন ধরনের টিপ দিয়ে কপালে এঁকে নিচ্ছেন নানা ধরনের চিহ্ন। যেমন দাঁড়ির মতো লম্বা টিপের নিচে ছোট্ট একটি গোল টিপ, হয়ে গেল বিস্ময়বোধক চিহ্ন! ওভাল আকৃতির টিপ লম্বা করে না বসিয়ে চওড়া করে কপালে বসিয়ে ওপরে রংতুলি দিয়ে এঁকে নেওয়া হচ্ছে সূর্য। মোটকথা, টিপের গতানুগতিক ধারায় বড়সড় যে পরিবর্তন এসেছে, সেটি ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। চিরন্তন বাঙালি ফ্যাশন থেকে বোহো স্টাইলে জায়গা করে নিয়েছে অতটুকুন এই অনুষঙ্গ।
মডেল: তুবা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল