‘ফ্যাশনের রাজধানী’খ্যাত ফ্রান্সের প্যারিসে গত ২৩ অক্টোবর ২০২৩ অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশি ফ্যাশন ডিজাইনার সামি আলমের বিশেষ শো– ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। প্যারিসের পাঁচ তারকা হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল প্যারিস লা গ্র্যান্ডের বলরুমে অনুষ্ঠিত এই ফ্যাশন শো ছিল ‘দ্য রাইজ অব বেঙ্গল টাইগার: বাংলাদেশ-ফ্রান্স ট্রেড ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৩’-এর অংশ। এম্ব্যাসি অব বাংলাদেশ প্যারিস এবং এম্ব্যাসি অব ফ্রান্স বাংলাদেশের সহযোগিতায় বাংলাদেশ সিকিউটিরিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিআইডিএ) যৌথভাবে এই ইভেন্টের আয়োজন করেছিল। তাতে দুই দেশের কূটনীতিকসহ বিশেষ অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।
আয়োজনের এতদিন পরও ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ আন্তর্জাতিক ও দেশি ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে এখনো রয়েছে আলোচনায়। এই কালেকশন ও শো ঘিরে ক্যানভাসের সঙ্গে সম্প্রতি বিশেষ আলাপে অংশ নিয়েছেন সামী আলম।
ক্যানভাসের সঙ্গে আলাপে সামি আলম:
ক্যানভাস: ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ কালেকশনের আইডিয়াটি কীভাবে পেলেন?
সামি আলম: আমি যখন ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন একাডেমি অব প্যারিসে ফ্যাশন-এ মাস্টার্স করছিলাম, একটা এক্সচেঞ্জ সেমিস্টারের জন্য এক সেমিস্টার ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে লোরেনজো দি মেদিচি ফ্যাশন স্কুলে যেতে হয়। ফ্লোরেন্সে থাকা অবস্থায় প্রায় দোকানদারদের দেখতাম যেকোনো ফ্যাশন পণ্য, লেদার পণ্য ও জুয়েলারি ‘মেড ইন ইতালি’ বলে অনেক প্রভাবিত করার চেষ্টা করত, এবং অনেক দোকানেই তারা এটা অনেক গর্ব করেও বলত। তখন মনে হলো, ওরা ‘মেড ইন ইতালি’ ট্যাগটাকেই সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ডিং স্লোগান বানিয়ে ফেলেছে এবং এটা একদিনে হয়নি, এর পেছনে আছে শত বছরের শ্রম, সময়ের সঙ্গে নিজেদেরকে এগিয়ে নেওয়া এবং প্রচুর গর্ব ও বিশ্বাস। এবারের কালেকশনে ব্যাপারটা অনেকটা তেমনই।
‘মেড ইন বাংলাদেশ’ সব সময় ফাস্ট ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর টি-শার্ট, জিন্স, হুডি– এসবের পেছনে ট্যাগে দেখা যায়, এবং বহির্বিশ্ব আমাদেরকে সেভাবেই চেনে। আমি ‘মেড ইন বাংলাদেশ’কে পেছনের ট্যাগ থেকে এই কলেকশনের মাধ্যমে সামনে নিয়ে এসে আমাদের জাতিগত গর্ব হিসাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। ধন্যবাদ বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটিকে এই ফ্যাশন শোয়ের জন্য আমাকে নির্বাচন করায়; ধন্যবাদ ফ্রেঞ্চ এম্ব্যাসি বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ এম্ব্যাসি ফ্রান্সকে আমাকে এই শোয়ের জন্য উপযোগী মনে করার জন্য।
ক্যানভাস: এই কালেকশনে আপনি কোন কোন বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন? কী কারণে?
সামি আলম: ক্রিয়েশনের জায়গা থেকে এই কলেকশনে গুরুত্ব দিয়েছি দেশি টেক্সটাইলের ওপর। এখানে জামদানি দিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করেছি, নকশিকাঁথাকে কনটেম্পরারি সিলুয়েটে বসিয়েছি, মসলিনের ট্রান্সপারেন্সি ব্যবহার করে কিছু নতুন কাজ করেছি। এ ছাড়া পাট, লুঙ্গি, টাঙ্গাইল তাঁত, গামছাসহ কমবেশি দেশীয় টেক্সটাইলের ব্লেন্ড পুরো কলেকশনে রয়েছে। অবশ্য শুধু দেশি টেক্সটাইল দিয়ে পুরো কালেকশন বানানো হয়নি ; এখানে দেশি টেক্সটাইলের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন মার্কেটে ব্যবহৃত ডেনিম, লেদার, শিফন, সুয়েড, গ্যাবার্ডিনসহ অনেক টেক্সটাইল ব্লেন্ড করে লুকগুলো ডিজাইন করা হয়েছে।
কনসেপ্চুয়াল জায়গা থেকে এই কলেকশনটা বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটা কাল্পনিক রসায়ন; অনেকটা ‘প্যারালাল ইউনিভার্সে’র মতো বলতে পারেন । এখানে যেমন গ্রামবাংলার ছবি উঠে এসেছে; আবার কোথাও কোথাও বিভিন্ন চরিত্র যেমন কৃষক, নববধু, বাউল, জমিদারের কনটেম্পরারি ফ্যাশন ট্রান্সলেশন করা হয়েছে; আবার কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি ট্রিবিউট দেখা গেছে। অন্যদিকে, ফ্রেঞ্চ রেভোলুশনের সময়ের ফ্যাশনের আমেজ রয়েছে কোথাও; ভিক্টর হুগোর উদ্ধৃতি রয়েছে রিকশা আর্ট স্টাইলে; আবার ফ্রেঞ্চ জনপ্রিয় বই ‘লো পুতিত প্রান্স’-এর চরিত্র দা লিটল প্রিন্স রয়েছে।
এটি এমন একটি কালেকশন যেটি সম্পূর্ণ আমার ভেতর থেকে আসা দুটি কালচারের অবিচ্ছেদ অনুভূতি নিয়ে করা এবং দুটি দেশের যে কেউ কোথাও না কোথাও নিজেকে খুঁজে পাবে এখানে।
ক্যানভাস: আপনার অন্য কালেকশনগুলো থেকে এই কালেকশন কোন দিক থেকে আলাদা?
সামি আলম: এটা প্যারিসে আমার দ্বিতীয় ফ্যাশন শো। ২০২২ সালে আমি ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন একাডেমি অব প্যারিসের গ্রাজুয়েট হিসেবে আমার কলেকশনের একটা শো হয়। তা ছাড়া আমি আড়ংয়ের হারস্টোরি ব্র্যান্ডের সিনিয়র ডিজাইনার হিসেবে আমার সিনিয়র ও কলিগদের নিয়ে একসঙ্গে কাজ করে সারা বছর অনেকগুলো কালেকশন করি। কিন্তু এই কলেকশনটি সম্পূর্ণ একটা আলাদা উদ্দেশে করা। এখানে দেশ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সম্ভাবনা এবং প্যারিসের মতো ফ্যাশন ক্যাপিটাল ও ফ্রেঞ্চ দর্শক জড়িত।
এই কলেকশনটির ব্যাপ্তি ব্যক্তি সামি কিংবা ডিজাইনার সামি থেকে অনেক বড়। কালেকশন ক্রিয়েশনের জায়গা থেকেও এই কলেশনে চিরাচরিত কিছু ব্যাকরণের বাইরে কাজ করা হয়েছে; যেমন ফ্যাব্রিক ও কালারের সরাসরি সংসক্তি না রাখা, কিংবা একটা সিঙ্গুলার ধাপে কোরিওগ্রাফ না করা, একইসঙ্গে ক্যারেক্টার ও কনটেক্সট দিয়ে স্টোরিটেলিং করা। এই এপ্রোচ সচরাচর দেখা যায় না; কিন্তু এর আগেও অনেক গ্লোবাল ডিজাইনারদের ফ্যাশন শোতে করা হয়েছে, এবং এখনো হচ্ছে। এই কালেকশনেরটা ‘ডিজরাপটিভ স্টোরিটেলিং’ স্টাইলে করা। সেই জায়গা থেকে বলব, এই কালেকশনের গল্প সত্তাটা আমার অন্য যেকোনো কাজ থেকে সম্পূর্ণই আলাদা। তা ছাড়া দেশকে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে গিয়ে করার গর্ব করার মতো করে দেখানোর ব্যাপার ছিল একজন বাংলাদেশি ডিজাইনার হিসেবে, এজন্য এটা সব সময়ই আলাদা।
ক্যানভাস: যেকোনো ডিজাইনের ক্ষেত্রে আপনি মূলত কোন বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন?
সামি আলম: আমি মনে করি ডিজাইনার হিসেবে আমরা সব সমই একটা ‘লার্নিং অ্যান্ড এক্সপ্রেসিং’-এর যাত্রায় থাকি। আমার বর্তমান জায়গা থেকে আমি ডিজাইনিংয়ের সময় গুরুত্ব দিই ডিজাইনটার উদ্দেশ্য নিয়ে– কী জন্য করা, কার জন্য করা এবং এটা আমি কোথায় দেখতে চাই। আর শৈল্পিক জায়গা থেকে গ্লোবাল ফ্যাশন এস্থেটিক এবং এক্সপেরিমেনটেশনের সঙ্গে দেশীয় ঐতিহ্যের মিশ্রণ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে– হোক সেটা ফ্যাব্রিক, এম্ব্রডারি, কনসেপ্ট অথবা সিলুয়েটে।
ক্যানভাস: একজন ডিজাইনারের মধ্যে কোন বৈশিষ্ট্য বা গুণগুলো থাকা উচিত বলে মনে করেন? কিংবা, একজন উদীয়মান বাংলাদেশি ডিজাইনার যদি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে চায়, নিজেকে তার কীভাবে তৈরি করা উচিত বলে মনে করেন?
সামি আলম: একজন বাংলাদেশি ডিজাইনার হিসাবে আমার মনে হয়, আমরা অনেক ক্ষেত্রে ফ্যাশন ডিজাইনে পিছিয়ে থাকলেও আমাদের সম্ভাবনা অনেক উন্নত দেশের চেয়েও বেশি, শুধু যদি সঠিক দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। একজন উদীয়মান বাংলাদেশি ডিজাইনার যদি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে চান, তাহলে তার দুটি দিকে নিরবিচ্ছিন্ন ফোকাস থাকতে হবে: ১. ফ্যাশন নলেজ: গ্লোবাল ফ্যাশন হিস্ট্রি, ফ্যাশন মার্কেট, নামকরা ডিজাইনারদের বায়োগ্রাফি, তাদের কাজ ও কাজের পেছনের গল্প, পাশাপাশি দেশি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে প্রবল জ্ঞান; ২. ফ্যাশন এক্সপারটিস: প্যাটার্নমেকিং, সারফেস ডিজাইন, ফ্যাব্রিক ম্যানুপুলেশন, সাস্টেইনিবিলিটি, জিরো ওয়েস্ট– এসব নিয়ে দক্ষতা থাকা চাই। এটা একদিনে অর্জন করা সম্ভব নয়; সময় দিয়ে নিজেকে গড়তে হবে, তবেই সম্ভব।
ক্যানভাস: ডিজাইনার হিসেবে আপনার মূল লক্ষ্য কী?
সামি আলম: ডিজাইনার হিসেবে আমার মূল লক্ষ্য বাংলাদেশকে যতটুকু পারি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, নতুনদেরকে এগিয়ে দেওয়া এবং নিজেকে একজন বাংলাদেশি ডিজাইনার হিসেবে আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে প্রতিষ্ঠিত করা।
ক্যানভাস: ডিজাইনার হিসেবে আপনার বেড়ে ওঠার গল্প…
সামি আলম: ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকার অভ্যাস থাকলেও বড় হতে হতে গতানুগতিক ধারায় জীবনে কিছু করার ধারণায় হারিয়ে যেতে থাকি। কিন্তু ২০১০ সালে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ ঢাকা আয়োজিত ‘Allons en France’ নামে একটি ক্রিয়েটিভ রাইটিং অ্যান্ড ডিজাইনিং কনটেস্ট জিতে আমার প্রথম প্যারিস যাওয়ার সুযোগ ঘটে। ওটাই আমার প্রথম কোনো ক্রিয়েটিভ কাজের স্বীকৃতি। ওই অভিজ্ঞতা আমার মধ্যে অনেকটাই পরিবর্তন আনে এবং নিজের স্বপ্নের দিকে আগাতে সাহস দেয়। তারপর দেশেই ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে অনার্স শেষ করে আড়ংয়ে ডিজাইনার হিসেবে জয়েন করি।
২০১৯ সালে আড়ং-এর ‘ফুল ফান্ডেড এমপ্লয়ি স্কলারশিপ’ পেয়ে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন একাডেমি অব প্যারিস-এ পড়তে যাওয়ার মতো সম্মান ও সৌভাগ্য হয় আমার। ২০২২ সালে আমি মাস্টার্স শেষ করি এবং আমার প্যারিসে ফ্যাশন শো অনুষ্ঠিত হয়। আমার এই যাত্রায় আমি সেগুলোই করেছি, যেগুলো আগের প্রশ্নে একজন উদীয়মান বাংলাদেশি ডিজাইনারের আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে চাইলে করা উচিত বলে মনে করি বলেছি।
ক্যানভাস: ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ কালেকশন ও প্যারিসে অনুষ্ঠিত শোয়ের ক্ষেত্রে আপনার জন্য চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল কোনগুলো? সেগুলো কীভাবে সামাল দিয়েছেন?
সামি আলম: আসলে যেকোনো আন্তর্জাতিক ইভেন্ট নিয়ে কিছু চ্যালেঞ্জ তো থাকেই। পুরো কালেকশন বানানো থেকে শুরু করে ফ্যাশন শোয়ের মিউজিক, কোরিওগ্রাফি, স্টোরিটেলিং, মডেল, ব্যাকস্টেজে ম্যানেজমেন্ট– সব কিছুর জন্য দুই দেশ মিলিয়ে সঠিক টিম গঠন করে শেষ পর্যন্ত সুন্দরভাবে ফ্যাশন শো করাটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। আমরা গর্বের সঙ্গে ফ্যাশন শোটা করতে পেরেছি দর্শকের অবিরাম তালির মাধ্যমে, এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
ক্যানভাস: এই ফ্যাশন শোতে আপনার সবচেয়ে বড় পাওয়া কী?
সামি আলম: আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া হচ্ছে বাংলাদেশের ফ্যাশনকে প্যারিস পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া, ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্যারিসের অপেরা বল রুমের মতো আইকনিক একটা জায়গায় বিভিন্ন দেশের দর্শকের সামনে নিজেদেরকে তুলে ধরা। প্যারিসের ১৫ জন মডেলের পাশাপাশি, আমাদের টিমে পাঁচজন বাংলাদেশি মডেল ছিলেন– মাশিয়াত, স্পৃহা, সিম্মি, মারিয়াম ও শিলা। আরও ছিলেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য কোরিওগ্রাফার আজরা মাহমুদ এবং আমার সহকারী দুজন সম্ভবনাময় তরুণ ডিজাইনার নিশান রহমান ও তাবাস্সুম মিম। দেশের ইন্ডাস্ট্রিকে প্যারিসে নিয়ে শো করার গর্বটা বলে বোঝানো কঠিন।
ক্যানভাস: আপনার বর্তমান ব্যস্ততা কী নিয়ে?
সামি আলম: বর্তমানে আড়ং-এর হারস্টোরি নিয়ে ব্যাস্ততা যাচ্ছে। পরের বছরের নতুন কালেকশন, ক্যাম্পেইন প্ল্যান ইত্যাদি নিয়ে আপাতত ব্যস্ত আছি। পাশাপাশি ‘মেড ইন বাংলাদেশ’-এর গল্প নিয়ে ছোট একটি ভিডিও স্টোরি করব, ওটাতে একটু সময় দিচ্ছি।
- রুদ্র/ ক্যানভাস অনলাইন