ফিচার I বসন থেকে অসনে
ভাবা হয়ে থাকে, ফ্যাশন জগতের সঙ্গে খাবারের সম্পর্ক মধুর নয়! তাই বলে তারা খাওয়াতে পছন্দ করেন না, তা নয়। বাণিজ্য সম্প্রসারণেই হোক, কিংবা ভোক্তাদের বাড়তি কিছু দেবার বাসনা থেকে, নামিদামি ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো বিশে^র নানা দেশে শুরু করেছে খাবারের ব্যবসা। এখানে রসনা যেমন তৃপ্ত হবে, তেমনি মিলবে ফ্যাশনের উপাদানও। নতুন এই ধারায় গা ভাসানো বিখ্যাত কয়েকটি ফ্যাশন ব্র্যান্ডের ফ্যাশন-কাম-ফুড শপের খবর জানাচ্ছেন তানিয়া সুলতানা
১৯২১ গুচি, সাংহাই
বিশ্বখ্যাত ইতালিয়ান ফ্যাশন ব্র্যান্ড গুচি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে চীনের সাংহাই শহরে শুরু করে প্রথম রেস্টুরেন্ট ‘১৯২১ গুচি’। সাংহাইয়ে হোয়াইহা লু সড়কের আইএপিএম লাক্সারি শপিং মলের চতুর্থ তলায় অবস্থিত এই অভিজাত রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করতে হয় গুচি স্টোরের ভেতর দিয়ে। এখানকার ইতালিয়ান মেন্যুর সমাহার থেকে বেছে নেয়া যেতে পারে সমুদ্রবিলাসী ব্যঞ্জন কিংবা বিচিত্র স্বাদের সব পাস্তা; আছে রিসোত্তো। চেখে দেখা যেতে পারে স্টেকও। অবশ্য জিভে জল আসা সব ডেজার্টের কথা বাদ দেয়া যায় না। পঞ্চতারকা হোটেলে ক্যাফের তকমা পাওয়া ‘১৯২১ গুচি’ রসনালয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারতে একজনের খরচ হবে অন্তত ১৫০ ইউয়ান। বাংলাদেশি টাকায় তা হাজার দুয়েক টাকা। ফাইভ স্টার বলে কথা; তা-ও আবার গুচি। তবে নৈশাহারে সেটা হয়ে যাবে দ্বিগুণ।
আলফি’জ, হংকং
ব্রিটিশ ফ্যাশন অ্যাকসেসরিজ ব্র্যান্ড ডানহিল এবং হংকংয়ের কি প্রাইভেট মেম্বারস ক্লাবের যৌথ উদ্যোগ আলফি’জ। হংকংয়ের প্রিন্স বিল্ডিং শপিং মলে এই ব্রিটিশ রেস্টুরেন্ট-কাম-বারের অভিযাত্রা ২০১০ সালে। ডানহিল স্টোরের মধ্যেই রয়েছে রেস্টুরেন্টের প্রবেশপথ। কালোর প্রাধান্যে করা হয়েছে আলফি’জ-এর চোখধাঁধানো অন্দরসজ্জা। বার এবং রেস্টুরেন্টকে অল্প জায়গার ভেতর আলাদা করা হয়েছে রঙ ব্যবহারের মুনশিয়ানায়। এখানে পাওয়া যাবে সকাল, দুপুর ও রাতের খাবার আর বিভিন্ন প্রকার পানীয়। রসনাবিলাসের বাহারি আয়োজনে ক্ল্যাসিক ব্রিটিশ মেন্যুর ফিশ অ্যান্ড চিপস যেমন আছে, তেমনি রয়েছে স্কটিশ স্মোকড স্যামন, ইয়র্কশায়ার পুডিং। কোহল আর ওয়াইনের সমাহারও হৃদয়গ্রাহী। আর আলফি’জ-এর ককটেল তো লা জবাব।
বার লুস, মিলান
অভিজাত ইতালিয়ান ফ্যাশন ব্র্যান্ড প্রাদা; মিলান শহরের শিল্প-সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত ফন্দাজিওনি প্রাদা কমপ্লেক্সে চালু করেছে ক্যাফে ‘বার লুস’। ২০১৫ সালে। নান্দনিক অন্দর আর আন্তরিক পরিবেশের জন্য প্রসিদ্ধ। বিখ্যাত মার্কিন পরিচালক ওয়েস অ্যান্ডারসন সজ্জায় প্রাধান্য দিয়েছেন পঞ্চাশ ও ষাট দশকের ইতালিয়ান সৌন্দর্যবোধকে। সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখে প্রথাগত ইতালিয়ান ক্যাফের আদলে গড়ে তোলা বার লুসে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া কিংবা একান্তে বই পড়ে সময় কাটানো যায় অনায়াসে। বিভিন্ন স্ন্যাকের পাশাপাশি মেলে কফিসহ গলা ভেজানোর রসাল আয়োজন।
বেইজ অ্যালান দুক্যাস, টোকিও
ফ্রেঞ্চ ফ্যাশন ব্র্যান্ড শ্যানেল ও তারকা শেফ অ্যালান দুক্যাসের মিলিত প্রয়াস ফ্যাশনেবল রেস্টুরেন্ট বেইজ অ্যালান দুক্যাস। টোকিওর গিনজা এলাকায় ২০০৪ সালে এই রেস্তোরাঁ খোলা হয়। শ্যানেলের নিজস্ব বুটিক ডিজাইনার পিটার ম্যারিনোর ডিজাইনে তৈরি এই রসনালয়ে রয়েছে ফ্রেঞ্চ ও জাপানি খাবারের বিপুল সমাহার। ফরাসি ও জাপানি রসনাসংস্কৃতির মেলবন্ধন আর অভ্যন্তরের মনোরম রোম্যান্টিক পরিবেশের কারণে রেস্টুরেন্টটি হংসমিথুনদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। মেন্যুতে রয়েছে গ্রিল্ড হোউবু ফিশ, কিউসু বিফ, মিশহ্যান্টন পোর্ক, হোক্কাইডো ভিল ছাড়া নানা স্বাদের চকলেট ডেজার্ট। আর পানীয়র ব্যবস্থাও বিপুল। বেইজের সুস্বাদু লাঞ্চের সেট মেন্যুর জন্য জনপ্রতি গুনতে হয় প্রায় ছয় হাজার ইয়েন। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকা। আর ডিনারের সেট মেন্যুর দাম পড়বে চৌদ্দ হাজার ইয়েনের মতো।
ক্যাফে দিওর, সিউল
ফ্যাশন দুনিয়ার প্রথম সারির ব্র্যান্ড দিওর। বিখ্যাত ফরাসি ডিজাইনার ক্রিস্তিয়ঁ দিওর ব্র্যান্ডটির প্রতিষ্ঠাতা। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে দিওরের সবচেয়ে বড় বিক্রয়কেন্দ্রে চালু করেছে নিজস্ব রেস্টুরেন্ট ‘ক্যাফে দিওর’। টিউলিপ ফুলের আকারে নির্মিত দিওর ফ্ল্যাগশিপ সেন্টারের পাঁচতলায় কাচঘেরা এই ক্যাফের বিলাসী ডিজাইন অতিথিদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। তাই পছন্দের জিনিসটি কিনে ক্যাফে ডিওরে সময় কাটাতে চাইবেন যে কেউ। ক্যাফে দিওর বিখ্যাত মূলত তার নানা স্বাদের পেস্ট্রির কারণে। কারিগরও সুবিখ্যাত। বিশিষ্ট পেস্ট্রি শেফ পিয়ের হেরমি। ক্যাফে দিওরের কেক আর পেস্ট্রি তৈরি হয়ে থাকে ঋতুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে।
ইম্পোরিও আরমানি ক্যাফে, দুবাই
জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড আরমানির প্রতিষ্ঠাতা ইতালিয়ান ফ্যাশন ডিজাইনার জর্জিও আরমানি। আরমানিও চালু করেছে নিজস্ব রেস্টুরেন্ট। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রাণকেন্দ্র বিলাসী শহর দুবাইয়ে। এই ফুড শপের নাম ইম্পোরিও আরমানি ক্যাফে। ২০১৫ সালের মে মাসে চালু হওয়া রেস্তোরাঁটি দুবাইয়ের অন্যতম শীর্ষ বিপণিকেন্দ্র শপিং মল অব এমিরেটসে অবস্থিত। আরমানি বিক্রয়কেন্দ্রের এক কোণের এই রেস্তোরাঁ-কাম-বারে শপাররা মিটিয়ে নিতে পারেন তাদের রসনা। অর্থাৎ রথ দেখা আর কলা বেচা সারা যায় একসঙ্গে। বিভিন্ন প্রকার ইতালিয়ান সেট মেন্যুতে আছে সকালের নাশতা, লাঞ্চ এবং ডিনারের জন্য। আছে আ লা কার্তে। মেলে ভারী খাবারের পাশাপাশি কফি, রেক, পেস্ট্রির সঙ্গে মিলবে নানা ধরনের হালকা থাকার। দুবাই ছাড়াও বর্তমানে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ইম্পোরিও আরমানি ক্যাফে শাখা ছড়াতে শুরু করেছে।
রালফ’স কফি, নিউইয়র্ক
ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল পণ্যের আমেরিকা ব্র্যান্ড রালফ লরাঁ নিউইয়র্ক সিটিতে চালু করেছে একটি কফি শপ। নাম রালফ’স কফি। নিউইয়র্কের ফিফটিফিফথ স্ট্রিটের অ্যাভিনিউ ফাইভে পোলো রালফ লরাঁ আউটলেটে অবস্থিত এই কফি শপ। এখানে পাওয়া যায় এসপ্রেসো হট অ্যান্ড কোল্ডসহ নানা স্বাদের কফি। কফিপ্রেমীরা আরও পাবেন কয়েক প্রকার চা, স্ন্যাক আর মাফিন, স্কন, কুকি, মিনি পাই, পেস্ট্রি ও স্যান্ডউইচ। এখান থেকে চাইলে যে কেউ রালফ’স কফির নিজস্ব কফি বিন সংগ্রহ করতে পারবেন। এ ছাড়া যে কেউ নিজের জন্য সুভ্যেনির হিসেবে নিয়ে যেতে পারেন টি-শার্ট, মগ ও ক্যাপ।
থমাস’স ক্যাফে, লন্ডন
ফ্যাশন দুনিয়ার ক্লাসিক্যাল যুগের অগ্রপথিক টমাস বারবেরি। তার চিন্তা ও সাধনায় গড়ে উঠেছে বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন, লাইফস্টাইল অ্যাকসেসরিজ ও কসমেটিকস ব্র্যান্ড বারবেরি। লন্ডনভিত্তিক এই ব্র্যান্ড তাদের প্রতিষ্ঠাতার নামানুসারে চালু করেছে থমাস’স ক্যাফে। ১২১ রিজেন্ট স্ট্রিটে বারবেরির বিক্রয়কেন্দ্রের এই ক্যাফেতে মিলবে সকাল, দুপুর ও রাতের খাবার। সুস্বাদু ইংলিশ মেন্যুর পাশাপাশি রয়েছে সালাদ ও স্ন্যাক আইটেম। এ ছাড়া আছে কফি ও চায়ের সমাহার। অল্প পরিসরে সুন্দর ইন্টেরিয়র আর সাদা-কালো মার্বেল পাথরের মেঝের কারণে এখানে আসা ভোজনবিলাসীদের সময় বেশ আনন্দেই কাটে। খাবারের দাম বারবেরির পণ্যের মতো উঁচু নয়, বরং সাধারণের সাধ্যের মধ্যেই।
ভোগ লাউঞ্জ, ব্যাংকক
বিশ্বজুড়ে আলোচিত ফ্যাশন মুখপত্র ভোগ ম্যাগাজিনও খাবারের ব্যবসায় নাম লিখিয়েছে। রেস্টুরেন্টের নাম রাখা হয়েছে ‘ভোগ লাউঞ্জ’। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের মাহানাখন ভবনের ছয়তলায় স্টাইলিশ ভোগ লাউঞ্জের চটকদার মার্বেলের মেঝে, চামড়ায় মোড়ানো সোফা আর মনোরম পরিবেশ আরও বেশি সুন্দর হয়ে উঠেছে ১৯২০ সালের ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কল্যাণে। প্রশস্ত পরিসরেই সাজানো হয়েছে পুরো জায়গা। বারকে আলাদা করা হয়েছে সবার সুবিধার জন্য। এ ছাড়া বিশাল উঁচু চত্বরে বসে খেতে খেতে দিনরাতের ব্যাংকক শহরেও চোখ বুলিয়ে নেওয়া যায়। মেন্যু লিস্টে রয়েছে নানান পদের খাবার। শেফ হিসেবে এখানে রয়েছেন ভিনসেন্ট থিয়েরি। ফ্যাশন ম্যাগাজিনের রেস্টুরেন্ট বলেই হয়তো এখানে আসা ভোজনবিলাসীদের ড্রেস কোড ঠিক করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া প্রতি বৃহস্পতিবার থাকে লাইভ মিউজিক।
ছবি: সংগ্রহ