আলাপন I আমার কোনো লাইফ নেই থিয়েটার ছাড়া -ঊষা গাঙ্গুলি
ঊষা গাঙ্গুলি। উপমহাদেশের প্রখ্যাত নাট্যনির্দেশক ও অভিনয়শিল্পী। জন্ম রাজস্থানের যোধপুর শহরে, ১৯৪৫ সালে। মাতৃভাষা হিন্দি হলেও বাংলা থিয়েটারে তিনি রেখেছেন অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর। সম্প্রতি এসেছিলেন ঢাকায়। ক্যানভাসের জন্য তাঁর এই বিশেষ সাক্ষাৎকারটি নেন চঞ্চল আশরাফ এবং নাট্যকার ও নাট্যনির্দেশক সাধনা আহমেদ
ক্যানভাস: আপনি অনেকবার বাংলাদেশে এসেছেন। আপনার প্রথম এখানে আসার অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল?
ঊষা গাঙ্গুলি : প্রথমবার বাংলাদেশে থিয়েটারের জন্য এসেছিলাম নাগরিকের ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ফেস্টিভ্যালে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাড়িতে অনেক লোক থাকতেন; ১৫ জন তো হবেই, তারা প্রথমেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমার হাজবেন্ডকে ডেকেছিলেন, তিনি আসেননি; আমাকে, অজিত পান্ডেকে নিয়ে এসেছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে গণনাট্যের ব্যাপারে কিছু বলবার জন্য। সেই প্রথম ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এসেছিলাম। এখানকার অ্যাটমোসফিয়ার দেখে মনে হয়েছিল, এখানে কতো অ্যাকটিভিটিজ হয়! দু-একদিন থেকে চলে গেলাম। পরে যখন নাগরিকের থিয়েটার করতে এলাম, তখন তো চার-পাঁচ দিন ছিলাম। সুন্দরভাবে আমাদের রাখা হয়েছে, থিয়েটার করানো হয়েছে। সবচেয়ে বড় যে ব্যাপার, যখন আমরা থিয়েটার করতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাই, থিয়েটারের দর্শক খুঁজে বেড়াই। দর্শক দারুণ ছিল; মানে থিয়েটারের মানুষ থেকে নিয়ে তরুণেরা, অচেনা-অজানা লোকেরা টিকিট কেটে আসে, মানে একটা দারুণ ব্যাপার ছিল এটা, আমার জন্য।
ক্যানভাস: এবার নাটক নিয়ে কথা হোক। হিন্দি থিয়েটার করেন আপনি; কিন্তু যেহেতু কলকাতায় আপনার বেড়ে ওঠা, কর্মজীবন- সবকিছু, এবং বাংলা থিয়েটারের সঙ্গে একটা গভীর সংযোগ আছে, বাংলাদেশে নাগরিকের একটি নাটকে আপনি নির্দেশনা দিয়েছেন। নাটকটি হলো ‘নামগোত্রহীন মান্টোর মেয়েরা’। তো, ভারতবর্ষের থিয়েটার এবং বাংলাদেশের থিয়েটারের মধ্যে কী পার্থক্য দেখেন? এই দুয়ের মধ্যে কী মিল ও সম্পর্ক আছে বলে আপনার মনে হয়?
ঊষা গাঙ্গুলি: সাউথ-ইস্ট এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি থিয়েটার হয় ভারতে আর বাংলাদেশে। পাকিস্তানে কিছু হয়। শ্রীলঙ্কায়ও। গাঢ় চোখ নিয়ে যদি দেখি আমি, তাহলে বলতে হবে, থিয়েটারের যে শক্তি আছে, মাধ্যমটির যে প্রয়োগ আছে, থিয়েটারটাকে একটা চ্যালেঞ্জ বা স্ট্রাগল করে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার যে চাহিদা আছে, সেটা এখানে বড়। আমরা যারা থিয়েটার করি, জীবনের সত্যটাকে একটা ছোট্ট স্পেসে তুলে আনার চেষ্টা করি- আমাদের জাঁকজমক নেই, রিসোর্সেস নেই, কম্প্রোমাইজিং নেচার বা সমঝোতা আমাদের নয়, আমরা বাজার ধরতে চাই না, জনপ্রিয়তাও চাই না; এসব জায়গা থেকে কোনো অমিল নেই। কষ্ট করে, দল নিয়ে, রিসোর্সেস নিয়ে, দল ভেঙে, আবার তৈরি করে, স্পেস খুঁজে দুই দেশের থিয়েটারটা হচ্ছে। তবু থিয়েটারের একটা সূক্ষ্ম রেখার মতো যে তফাত ঘটে থাকে, আমি দুই দেশের মাঝখানে যখন দাঁড়িয়ে দেখি, সেলিম আল দীনের মতো মানুষের সঙ্গে যখন আমার পরিচয় হয়, আরও বেশি জানি, পড়ি, তখন দেখি আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার যে জায়গাটা আছে, সেটা ছিল ন্যারেটিভসের থিয়েটার, যেখানে রুটসের যে থিয়েটারটা ছিল, ব্রেখ্ট যেখান থেকে নিয়ে নিজের নাটক লিখেছেন, করেছেন, ঢাকা ইউনিভার্সিটি আর জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি এই ন্যারেটিভ নিয়ে কাজ করেছে, নাটকের লেখন থেকে নিয়ে মঞ্চায়ন পর্যন্ত, ধারাটা একদম আলাদা। সেখানে নৃত্য, গীত, শরীর সঞ্চালন- সবকিছু দেশজ জায়গায় চলে যায়। অন্য জায়গায়ও এটা আছে, দক্ষিণ ভারতে আছে, মণিপুরেও আছে; এ রকম ন্যারেটিভ নিয়ে মণিপুরে থিয়েটার হয়, কিন্তু পশ্চিম বাংলায় একটা দীর্ঘ সময়ে, সিক্সটিজ-সেভেনটিজে একটা অ্যাডাপ্টেশন বা ট্রান্সফরমেটেড ভার্সন চলছিল কুড়ি বছর, তারপরে যে রিয়ালিস্টিক থিয়েটার, ওই ভাঙনটা একটু কম হয়েছে।
ক্যানভাস: আচ্ছা, আপনি তো একটা দল গঠন করেছিলেন। সত্তরের দশকে। গঠনের পেছনে কোনো মতাদর্শিক প্রণোদনা ছিল?
ঊষা গাঙ্গুলি: ছিল; খুব বেশি ছিল। দলের ৪২ বছর পরে বলছি, এক বছর আমরা একটা বড় হলে তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে দলের নাম কী হবে, কাজ কী হবে, কীভাবে বলবে- সবচেয়ে বড় কথা, দল কাদের জন্য কাজ করবে, এসব নিয়ে ভেবেছি। আমি যখন থিয়েটার শুরু করেছিলাম হিন্দিতে, প্রায় দুই হাজার দর্শক ছিল; পপকর্ন খেয়ে কলামন্দিরে নাটক দেখতো, এরা ছিল এলিট ক্লাসের দর্শক। সাধারণ মানুষ কিন্তু থিয়েটারের দর্শক ছিলই না। ছাত্ররা ছিল না, গেরস্তরা ছিল না, মার্কেন্টাইল ওয়ার্কাররা ছিল না। নরমাল ক্লাস, মিডল ক্লাসের কেউই ছিল না। তো প্রথম আমাদের কথা ছিল যে একটা বিশাল দর্শক তৈরি করতে হবে; আমরা ভেবেছিলাম দর্শক আমাদের কাছে আসবে না, আমাদেরই দর্শকের কাছে যেতে হবে। সেই রাস্তাটা আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। ১৯৭৬ সালে শুরু হলো মানুষের মধ্যে গিয়ে থিয়েটার করা, দর্শক তৈরি করা; তো প্রডাকশনটাও সে রকম হতে হবে। আমরা যদি ভাবি যে নাটক একটা সামাজিক মাধ্যম, মানুষের কথা যদি তাতে না থাকে, তাহলে নাটক নিয়ে তাদের কাছে যাওয়ার দরকার নেই। আরেকটা কথা, মানুষের কাছে কোনো বিষয় আমরা রিপিট করবো না। একটা ফ্রেশ চিন্তা, ধারা দেব। ওই যে ফিলোসফিটা আমরা তৈরি করেছিলাম প্রথম দিকে, সেটাই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। বেঁধে রেখে দিয়েছে একটা জায়গায়। নড়তে দেয়নি, কম্প্রোমাইজ করতে দেয়নি।
ক্যানভাস: রুদালি কিংবা চন্ডালিকা বা হিম্মতি মাই…
ঊষা গাঙ্গুলি: ফার্স্ট থিয়েটার করলাম ’৭৬ সালে, শিয়ালদার একটা হল ছিল রেলওয়ের, ওখানে আমরা তিনটা নাটক করলাম- চেকভের একটা নাটক করলাম ‘প্রস্তাব’ নামে, ওটায় আমি নির্দেশক ছিলাম; ‘বেচারা ভগবান’ নামে একটা স্যাটায়ার করেছিলাম পিয়ালদেশ পান্ডের, আরেকটা করেছিলাম ভারতেন্দুর ‘আন্ধের নাগরি চৌপাট রাজা’। সেখান থেকে আজ পর্যন্ত আমরা খোলা মনে থিয়েটার করেছি। আমি কোনো ডিরেকশনে যাইনি, ট্রেনিং নিইনি; আমি জাস্ট ড্যান্সার; নাচ থেকে থিয়েটারে এসেছিলাম। নাচের ডিসিপ্লিনটা আমার ছিল, কোরিওগ্রাফিটা ছিল। নাচটাকে আমি ব্যবহার করেছি আমার থিয়েটারে; কিন্তু আস্তে আস্তে দেখি আমাদের ডাকে ডিরেক্টর এম কে রানা এলেন, গোর্কির ‘মা’ করলেন, রুদ্রপ্রসাদ এলেন, তৃপ্তি মিত্র এসে ‘ডলস হাউজ’ করলেন, এরা চলে গেলে আমাদের শোর জন্য রিহার্সালগুলো করতে হতো। সবাই বলতে শুরু করলো, নাটক করবো না কেন! ১৯৮৪ সালে আমি প্রথম ডিরেকশন দিই, সঙ্গে ছিলেন ৫০ জন, এটা ছিল পলিটিক্যাল প্লে, ‘মহাভোজ’, তখনকার ইমার্জেন্সির সময়; তারপর ‘লোককথা’, যাতে ছিল একটা দলিত বাচ্চা মেয়েকে অ্যাবিউজ করার গল্প; ‘হোলি’, ছাত্রদের নিয়ে; ‘রুদালি’ হলো, ‘কোর্ট মার্শাল’ হলো, একের পর এক নাটক হচ্ছে, পলিটিক্যালাইজেশন অব রিলিজিয়ন নিয়ে ‘কাশিনাম’ হলো, সাদাত হাসান মান্টোর তিনটা নাটক হলো। আস্তে আস্তে দেখছি যে আমার রিটেন টেক্সটের প্রতি মোহটা চলে যাচ্ছে; যখন দেখি যে মহাশ্বেতা দেবীর গল্প থেকে নাটক করা, বা রবীন্দ্রনাথের গল্প থেকে, যখন গল্পকে নাট্যরূপ দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো আমি প্রস্তুত করতে যাই, তখন যে কথাটা বলতে চাই, সে কথাটা বলা হয়ে ওঠে না। নিজের দীর্ঘকালীন অনুভব, অভিজ্ঞতা- যেমন একটা রিহ্যাবে গিয়ে অ্যাডিক্টদের দেখেছি, বাচ্চাদের দেখেছি, ‘খোঁজ’ নাটক লিখেছি। ‘অন্তর্যাত্রা’ নাটক লিখেছি। তারপর মেয়েদের ওপর অ্যাবিউজ দেখে, তাদের ইনসিকিউরিটি দেখে ‘মোক্তারা’কে তুললাম। তার আত্মজীবনী পড়ে লিখলাম সেই নাটক। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভয় ছিল। কারণ, আমি যে নাটক করি, তার ভাষা সহজ, সাহিত্যের ভাষায় হিন্দি নাটকও করিনি; রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধরাটা বেশ ঝুঁকির ব্যাপার, তার নানা রকম মানে আছে, শেষ পর্যন্ত ‘চ-ালিকা’ আর ‘মানসী’ করলাম। তরুণ ডিরেক্টর- যেমন গৌতম হালদার, কৌশিক সেনকে ডেকে তাদের নাটক করালাম। ঢাকা থেকে জামিল আহমেদ গেলেন, সুদীপ গেলেন, ওঁরা নাটক করলেন আমাদের এখানে। আমি নিজে পাকিস্তানে গিয়ে নাটক করলাম। এখানে এসে আমি নাগরিকের সঙ্গে নাটক করলাম। তো হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে ভাবলাম যে, কী রকম মজা হয় সাতজন মহিলা ডিরেক্টর যদি থাকেন, সাতজন অভিনেতা থাকেন, অভিনেত্রীও; আর যদি রবীন্দ্রনাথের সাতটা চরিত্র থাকে- ভেবে লাফিয়ে উঠেছি; কিন্তু আমার তো নাট্যকার দরকার। সাধনা আহমেদকে এখানে খুঁজে পেলাম। ফোন করে তাঁকে বললাম, সঙ্গে সঙ্গে দশ দিনের মধ্যে তিনি ‘সপ্তপর্ণী’ নাটকটা লিখে দিলেন। এই সেই সাধনা, এখন আমার সামনে বসে আছেন। এটা একটা ঐতিহাসিক জায়গা তৈরি করলো যে সাতজন ডিরেক্টর- সোহাগ সেন, পশ্চিমবঙ্গে বিখ্যাত মায়া ঘোষের মতো সিনিয়র অ্যাক্টর… আমি কিন্তু নেই এদের মধ্যে… তো আজকে এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থিয়েটারের মানুষ হয়ে আমার মধ্যেও তো প্রশ্ন জাগে, এর পরে কী হবে, এবার কী করা যাবে, এটাই কিন্তু আমাকে থিয়েটারের সঙ্গে বাঁচিয়ে রাখে। আমার কোনো লাইফ নেই থিয়েটার ছাড়া। গড়েছি বিরাট দল- দুশো থেকে বেশি সদস্য, নব্বইজন নারী আছেন, যারা আমাদের দলের অভিনেত্রী। আমাদের একটা স্টুডিও থিয়েটার আছে। সেই অবজ্ঞা যেটা বিনোদিনী পেয়েছিলেন, খেয়া চক্রবর্তী পেয়েছিলেন, তাদের নিয়ে সেই স্টুডিও থিয়েটার বিনোদিনী মঞ্চ, যেখানে পরিকল্পনা, চিন্তা, কাজ হচ্ছে; একটা অল্টারনেটিভ হাব গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। যারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে, প্রয়োগধর্মী কাজ করছে, তাদের একটা স্পেস তৈরি করার জন্য।
ক্যানভাস: আমরা শুনেছি, একসময় আপনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাদের উপর নাটক করেছেন। সেগুলো কী ধরনের নাটক ছিল?
ঊষা গাঙ্গুলি: আমাদের ওখানে ৩০০ ফ্ল্যাটের একটা জায়গা ছিল। আমাদের একটা নাটক আছে, ‘বেটি আই’; সেটা ওখানকার একটা ছাদে করেছিলাম। কন্যাশিশুর জন্ম নিয়ে। আমি মায়ের চতুর্থ কন্যাসন্তান, আমার জন্মের পর মা অনেক কেঁদেছিলেন। আমাদের সমাজটা এমন যে, মেয়েদের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে ভাবতে হয়, আমাদের লড়াই শুরু হলো। আমরা এক ইঞ্চি জমি তৈরি করবো, দুই ইঞ্চি কাদা কেউ ফেলবে, তিন ইঞ্চি জমি তৈরি করবো, পাঁচ ইঞ্চি কাদা ফেলবে। আমাদের রোজ পরিষ্কার করতে হবে, রোজ ভাতের হাঁড়ি চড়াতে হবে, রোজ লড়াই চলবে।
ক্যানভাস: শুরুতে আপনার জায়গা ছিল ভরতনাট্যম। ওখান থেকে এই জগতে এলেন কেমন করে?
ঊষা গাঙ্গুলি: ওটা ছোটবেলার বখা। মা নিয়ে যেতেন সঙ্গে। কনজারভেটিভ ফ্যামিলিতে ছিলাম, তবু নাচ শিখলাম। কনফারেন্সে, সাদার্ন কনফারেন্সে, নিউ এম্পায়ার কনফারেন্সে- সব জায়গায় নাচ করতাম। কিন্তু হঠাৎ একদিন আমাকে ডাকা হলো, গেলাম, অন্য থিয়েটার দল ছিল, নিজে চেষ্টা করে নাটকটা তুললাম। ডিসিপ্লিন ছিল না, ফিলোসফি ছিল না। থিয়েটার কেন করে, ওরা জানতো না, তো এই দলে আমার কী হবে! জানতে তো হবে মাধ্যমটা কী, নইলে করার মানে কী, করে লাভও নেই। সুতরাং কেন করছি, এটা বুঝতে হবে, বোঝাতেও হবে দর্শকদের। আমি খুব জোর গলায় বলি, থিয়েটারে যে শিক্ষাটা আমরা পাই, সেটা বইয়ের শিক্ষা নয়। ওই শিক্ষা মানুষকে চেতনা দেয়, উদ্বুদ্ধ করে, মানবিকতার জায়গায় নিয়ে যায়। যেমন রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি, মানবিকতার ওপর তা দাঁড়িয়ে আছে।
ক্যানভাস: বিশিষ্ট লেখক যারা, দেখা যায়, তারা একটা শূন্যতা পূরণের অভিপ্রায় নিয়ে সৃষ্টিশীলতার জগতে প্রবেশ করেন। সেলিম আল দীনের নাটক থেকে বোঝা যায়, তিনি বাংলা নাটকের যে জায়গাটি শূন্য, তা পূরণ করতে চেয়েছেন। আপনার এ জগতে প্রবেশের পেছনে এ রকম কোনো অভিপ্রায় কাজ করেছে কি?
ঊষা গাঙ্গুলি: এটা তো আমার বলারই কথা নয়। এটা মানুষ বলবে, ইতিহাস বলবে। অডিয়েন্স বলবে। আমি যদি বলি, আমার অহংকার হবে। সেল্ফ অবসেশন হবে। এই প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারবো না। তবে বলতে পারি, কোনো শূন্যতা পূরণের ইচ্ছা নিয়ে আমি নাটকে আসিনি, এসেছি বোধ নিয়ে। মানুষের সংস্পর্শ নিয়ে এসেছি।
ক্যানভাস: নিজের জনপ্রিয়তার দিকে তাকিয়ে আপনার কি কখনো মনে হয়েছে যে সমকালীন জনরুচির সঙ্গে আপনি আপোস করেছেন?
ঊষা গাঙ্গুলি: আমি দর্শকের রুচিকে দেখে কোনো দিন থিয়েটার করিনি। সেটা আমার করার কথাই নয়। আমি তো তার থেকে বেশি দায়িত্ব নিয়ে থিয়েটারে এসেছি। মানুষের রুচি যদি এদিকে-ওদিকে থাকে, তার সংস্কারের কথাও ভেবেছি। তার যদি আঁধারের শিক্ষা থাকে, আলোর শিক্ষা দিয়ে তাকে পাল্টানোর চেষ্টা করেছি। দর্শকের দিকে তাকিয়ে যদি থিয়েটার করি, তাহলে সেটা পপুলার থিয়েটার হয়ে যাবে। ভিড় আসবেই। মাঝে মাঝে তো ভিড় আসেও না। কিন্তু আমার নাটকের দর্শকেরা জানেন, রঙ্গকর্মীদের নিয়ে ঊষাদি যা করবেন, তা থেকে একটা প্রশ্ন, একটা চিন্তা নিয়ে তারা ফিরতে পারবেন।
ক্যানভাস: বলা হয়ে থাকে, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার চাপ নান্দনিকতার ব্যাঘাত ঘটায়, শিল্পগুণ নষ্ট করে। আপনার কী অভিমত?
ঊষা গাঙ্গুলি: আমি সেটা বিশ্বাস করি না। আমার তো মাধ্যমই সামাজিক। আমাদের সমাজে যে ছোট ছোট আনন্দ, যেমন একটা বাচ্চা সাইকেল থেকে চাকা খোলার পর ওটা নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে, এগুলো তো আমি মঞ্চে নিয়ে আসি। জীবনটা আমাদের সে রকম। সুন্দর। জীবনের সুন্দর ও আনন্দদায়ক জিনিসগুলোই মঞ্চে এসে নান্দনিকতা তৈরি করবে। জীবনে যা আছে, সেটাই আমি তুলে নিয়ে আসি ক্যানভাসে। সেই ক্যানভাস তো অসুন্দর হতে পারে না। তবে ওটা ডিরেক্টরের ওপর নির্ভর করে। কোনটা রাখবে, কোনটা ছাড়বে, নির্ভর করে তার ওপর।
ক্যানভাস: এবার আপনার জীবনে ফিরে আসি। আপনি ৭ বছর বয়সে কলকাতায় চলে আসেন। আপনার মাতৃভাষা হিন্দি। নিজের ভাষা থেকে আপনার অবস্থান আরেক ভাষায় গড়ে তুলেছেন। এই যে অভিজ্ঞতাটা, এখান থেকে যখন নিজের মাতৃভাষার দিকে তাকান, তখন কী বোধ করেন?
ঊষা গাঙ্গুলি: আমি কিন্তু বাংলা ও হিন্দি দুটো ভাষাতেই থিয়েটার করছি। আমাদের ‘সপ্তপর্ণী’ বাংলা ও হিন্দি দুটো ভাষাতেই হয়েছে। ড্রাগ অ্যাডিক্টদের নিয়ে যে নাটক ‘ভোর’, সেটার বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি- তিনটি ভার্সনই আছে। কিন্তু যদি আমি শুধু বাংলায় করতাম বা হিন্দিতে করতাম, ভাষাটা আসলে কোনো মানে রাখতো না। কথ্যটা বেশি মানে রাখে। দর্শক টাইটেল দেখছে, সাবটাইটেল দেখছে; আর ইজিপ্ট, সাউথ আফ্রিকা, ইউরোপ, ইন্ডিয়া- সবখানের মানুষের চোখের জল তো একই। দুঃখ একই। হাসিও।
ক্যানভাস : সাধনা আহমেদের সপ্তপর্ণী সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
ঊষা গাঙ্গুলি: খুব ইন্টারেস্টিং ওয়েতে সাধনা রবীন্দ্রনাথের সাতটি চরিত্রকে নিজের প্রতিভা ও অনুভূতি দিয়ে তুলে ধরেছেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, নতুন ডাইমেনশন তিনি দিয়েছেন চরিত্রগুলোর; বিস্ময়কর যে, এত কম সময়ের মধ্যে কী করে কেউ এমন লিখতে পারে! আর একটা কথা- ভাষা ও সংস্কৃতি এক হওয়া সত্ত্বেও বাঙালির দুটো দেশের বাউন্ডারি আছে, তা আমরা যত ভাঙতে পারবো সৃষ্টিশীলতার গুণে, ততো আমাদের এক্সচেঞ্জ হবে, ততো আমাদের চোখ খুলবে, দর্শকেরা নতুন রাস্তা পাবেন, নতুন অভিজ্ঞতা হবে তাদের, নতুন বোধ আসবে। আমাদের সার্ক কান্ট্রিগুলোর মধ্যে যত বিনিময় হবে, ততো ভালো।
ক্যানভাস: আপনার সবচেয়ে সফল নাটক কোনটি বলে মনে করেন? এ নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
ঊষা গাঙ্গুলি: আমি এটা বলি কী করে! তবে ‘রুদালি’ নিয়ে লোকেরা বড্ড বেশি বলে; এবার এনএসডিতে এটা হয়েছিল, আমার সিগনেচার প্রডাকশন হয়ে গেছে এটি, এখন লোকেরা ভীষণ দেখতে চায়। এটা মানুষের নাটক, কান্নার পেশা ধরেও যে মানুষ বাঁচতে চায়, তাই দেখিয়েছি এতে। ‘লোককথা’ খুব অন্য রকম নাটক, আমার মনে হয়।
ক্যানভাস: এবার পাশ্চাত্য নাটক নিয়ে আলাপ করতে চাই। উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইউরোপে যে নতুন নতুন নাট্যতত্ত্বের উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছিল, আঙ্গিক ও বিষয়ে যে নিরীক্ষা ও ভাঙচুর হয়েছিল- তাতে বোঝা যায়, ওখানকার নাটকে বারবার পরিবর্তন ঘটানোর কিংবা নাটকের বিদ্যমান থেকে উত্তরণের চেষ্টা হয়েছে। আমাদের এখানে এই প্রচেষ্টার চেহারাটা কেমন?
ঊষা গাঙ্গুলি: এভাবে তুলনা করে দেখলে চলে না। আমি প্রায় সব দেশে নাটক করেছি- জার্মানিতে, লন্ডনেও; ওদের তো স্পেস বা রিসোর্সের চিন্তা নেই, তার ওপর সরকারি সহযোগিতা আছে। সংস্কৃতির মধ্যে থিয়েটারে ওদের যে এক্সপেন্ডিচার, আমাদের তো সে তুলনায় শূন্যও নেই। থিয়েটারটাকে আমাদের দেশে সেভাবে বোঝা হয়নি। ঠিক আছে, না হলেও ভালো, বরং আরও ভালো। চ্যালেঞ্জ হবে। তবে ইউরোপের নাটক যেভাবে ভাঙছে, প্রভাবটা আমাদের দেশে পড়ছে। রিয়ালিজম, স্তানিস্লাভস্কি থেকে বেরিয়ে আমরা ব্রেখ্টের দিকে গেলাম, সেখান থেকে অগাস্ট ব্যোলের রীতিতে গেলাম, একের পর এক স্কুল আমরা ফলো করেছি।
ক্যানভাস: একটা নাটকের সফলতা বিবেচনার জন্য আপনাকে যদি বলা হয়, কোন কোন মানদন্ডে তা করবেন?
ঊষা গাঙ্গুলি: আমি দর্শক হিসেবে বলবো, যে নাটকটি দেখছি, বুঝতে চাইবো তা কমিউনিকেট করছে কি না, কনভিন্স করছে কি না। নকল কি না, নাড়া দিতে পারছে কি না। ওই কমিউনিকেশনটা ইজ দ্য মেইন থিং উইদ মি। সাজসজ্জা, জমক, লক্ষ লক্ষ টাকার সেট আমাকে প্রভাবিত করে না। সিম্পল বাট পাওয়ারফুল মঞ্চই আমার পছন্দ। তাতে চ্যালেঞ্জ থাকে। আমি নতুন ধারাকে খুব সাপোর্ট করি। তরুণেরা যখন লেস রিসোর্স নিয়ে ইমাজিনেটিভ থিয়েটার করে, যাতে ইমেজারি আছে, সিম্পল স্টেজে যারা অভিনয়শক্তি দিয়ে ইমেজ তৈরি করে, তাদের পছন্দ করি। সেই সঙ্গে কোরিওগ্রাফি, মিউজিকে যদি ক্রিয়েটিভিটি দেখি, ভালো লাগে। আমি টোটাল থিয়েটারে বিশ্বাস করি। কিন্তু আমি বলার কে, কোন নাটকটি ভালো কিংবা মন্দ! যে যার রাস্তা পেয়েছে, তাতে চলুক না। কে কী করেছে, তা তো ইতিহাসে থাকে।
ক্যানভাস: কোনো পরিকল্পনা আছে থিয়েটার নিয়ে?
ঊষা গাঙ্গুলি: অনেক। চট্টগ্রামে একটা প্রডাকশনের কথা হয়েছে। একটা নাটক ‘আত্মজ’ লিখে শেষ করেছি আমার স্টুডিও থিয়েটারের জন্য। তারপর আমার নিজের বড় একটা নাটক করবো। বাইরে যাচ্ছি, ফিরে এসে জুনে শো করবো।
ক্যানভাস : ক্যানভাসের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
ঊষা গাঙ্গুলি : ক্যানভাসকে ধন্যবাদ।