skip to Main Content

এডিটর’স কলাম I অগ্রগতি অগ্রগণ্যে

দুর্ভাগ্যজনকভাবে লৈঙ্গিক সমতা এখনো সবচেয়ে বড় মানবাধিকার চ্যালেঞ্জ। আর তা কাটিয়ে উঠতে নারীদের কাজে অর্থলগ্নি করা একটি অপরিহার্য মানবাধিকার এবং সকলের অংশগ্রহণমূলক সমাজ গড়ে তোলার ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে বিবেচিত

জীবন ফুলের বিছানা নয়, খুবই জানা কথা। এর নানা বাঁকে ছড়িয়ে থাকে বিবিধ কণ্টক। সন্তর্পণে সেই সব কাঁটা সরিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। সব সময় নিপুণভাবে পারা যায়, তা নয়। কখনো কখনো রক্তাক্ত হতে হয় কাঁটার আঘাতে। তবু জীবন বহমান, জীবনেরই নিয়মে। আর সেই বহমানতাকে দৃঢ় করে তুলতে কাঁধে কাঁধ রাখা চাই সবার। বিশেষত নারী ও পুরুষের সমানভাবে। কেউ পিছিয়ে পড়লে মানবসভ্যতার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাতে সমগ্র মানবজাতির অগ্রগতিই হয়ে পড়ে মন্থর। আর যেহেতু নানা কারণে পুরুষের তুলনায় নারীর জীবনযাত্রা বৈষম্যবহুল, তাই এদিকে আরও বেশি গভীর মনোযোগ সব সময় দাবিদার। তা কাটাতে অংশগ্রহণ করা চাই নারী, পুরুষ—সকলের।

দুই
লৈঙ্গিক সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউএন উইমেন বেশ জোরের সঙ্গেই জানিয়েছে, বর্তমান পৃথিবী যখন অসংখ্য সংকটের মুখোমুখি, এই পরিস্থিতিতে লৈঙ্গিক সমতা অর্জন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জীবনের সকল পর্যায়ে নারীর অধিকার সুনিশ্চিত করাই হতে পারে এই গ্রহের অধিবাসীদের অর্থনৈতিক ও সমৃদ্ধিশালী এবং একই সঙ্গে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের প্রধান উপায়। ২০৩০ সালের মধ্যে লৈঙ্গিক সমতা অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে ইউএন উইমেন, তাতে বাধা হয়ে চোখরাঙানো সমস্যাগুলোর অন্যতম হলো অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। সংস্থাটির তথ্যমতে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লৈঙ্গিক সমতা সুনিশ্চিতের পেছনে প্রয়োজনীয় বার্ষিক ব্যয়ের ঘাটতির সংখ্যাটি ভীষণ উদ্বেগজনক; প্রায় ৩৬০ বিলিয়ন ইউএস ডলার। সহজ কথায়, নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা সমন্বয়ের পেছনে প্রয়োজনীয় অর্থলগ্নি করতে এখনো অনেক প্রতিষ্ঠান তথা ব্যক্তিমানুষ অনাগ্রহী। অথচ সময় হয়েছে এমন মনোভাব পরিবর্তনের। তাই অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে নারীদের কাজে অর্থলগ্নির আহ্বান জানিয়ে চলতি আন্তর্জাতিক নারী দিবসের থিম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘ইনভেস্ট ইন উইমেন: অ্যাকসিলারেট প্রগ্রেস’। এ নিয়ে ‘ইনভেস্টইনউইমেন’ হ্যাশট্যাগও সক্রিয়। তা যেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই সীমিত না থেকে বরং জীবনের সকল পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে ও কার্যশীল হয়, সেই দায়িত্ব নেওয়া চাই সবার।

তিন
নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা, কিংবা বলা ভালো, বহুকাল ধরে বিভিন্ন ছলচাতুরীতে পিছিয়ে রাখা নারীদের লৈঙ্গিক সমতার দৌড়ে সহযাত্রী করার এবং তাদের অগ্রগতিকে অগ্রগণ্য বিবেচনার জন্য মোটাদাগে পাঁচটি বিষয়ে জোর দিয়েছে জাতিসংঘ। মানবাধিকার ইস্যু, দারিদ্র্য দূরীকরণ, লৈঙ্গিক সংবেদনশীল অর্থলগ্নি বাস্তবায়ন, সবুজ অর্থনীতি ও যত্নবান সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং নারীবাদী পরিবর্তনকামীদের সহায়তা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে লৈঙ্গিক সমতা এখনো সবচেয়ে বড় মানবাধিকার চ্যালেঞ্জ। আর তা কাটিয়ে উঠতে নারীদের কাজে অর্থলগ্নি করা একটি অপরিহার্য মানবাধিকার এবং সকলের অংশগ্রহণমূলক সমাজ গড়ে তোলার ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে বিবেচিত। কেননা, নারীর অগ্রগতি সমাজের সবার জন্যই কল্যাণকর। অন্যদিকে, কোভিড অতিমারি, ভূরাজনৈতিক সংঘাত, জলবায়ু বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা পৃথিবীব্যাপী ২০২০ সাল নাগাদ আরও বাড়তি ৭৫ মিলিয়ন মানুষকে দারিদ্র্যের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। আশু পদক্ষেপ না নেওয়া হলে ২০৩০ সাল নাগাদ ৩৪২ মিলিয়ন নারীকে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতে হবে বলে আশঙ্কা জাতিসংঘের। তা ছাড়া বিভিন্ন সংঘাত এবং জ্বালানি ও খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে আগামী বছর নাগাদ ৭৫ শতাংশ দেশই প্রাত্যহিক ব্যয়ভার যথাসম্ভব সংকোচন করতে বাধ্য হবে। আর তাতে জনসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের মতো অপরিহার্য খাতগুলোতে ব্যয় কমে যাবে; যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বিশেষত নারীদের জীবনযাত্রায়। শুধু এটুকুই নয়! বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে দারিদ্র্য ও বৈষম্য বৃদ্ধি, পরিবেশগত অবনতি এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণতার জন্য দায়ী করে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। এই ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় শিকার নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। তাই বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জাতিসংঘের। সে ক্ষেত্রে নমুনা হিসেবে একটি সবুজ অর্থনীতি (গ্রিন ইকোনমি) ও যত্নবান সমাজে (কেয়ার সোসাইটি) রূপান্তরের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যেখানে নারীদের কণ্ঠস্বর যথাযোগ্য মর্যাদা ও বিকাশ লাভ করবে। নারীকে দারিদ্র্য ও বৈষম্য থেকে মুক্তি দিতে কাজ করে যাওয়া নারীবাদী সংগঠনগুলোকে সহায়তা করার ওপরও গুরুত্ব দিচ্ছে জাতিসংঘ। এককথায়, বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে নারীর অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করার জন্য অতি প্রয়োজনীয় অথনৈতিক সহযোগিতা সুনিশ্চিত করা অপরিহার্য।

চার
কোনো পরিবর্তন বা পরিমার্জন ইতিবাচক হলেও মানুষ যদি অন্তর থেকে গ্রহণ না করে, কেতাবি কাঠামোর জোরে সেটির যথাযোগ্য প্রয়োগ ঘটানো এবং সুফল অর্জন দুরূহ। ব্যক্তিভেদে মতভেদ থাকা স্বাভাবিক; কিন্তু কাউকে পিছিয়ে রেখে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালানো মানবসভ্যতার পক্ষে মঙ্গলজনক নয়। তাই নারী-পুরুষনির্বিশেষে নারীর অগ্রযাত্রায় এবং লৈঙ্গিক সমতা অর্জনে অবদান রাখা আবশ্যক। সেই চর্চা শুধু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সীমিত থাকলে চলবে না; ব্যক্তিজীবনেও প্রয়োজন এর আলো ছড়ানো।

পাঁচ
বলা হয়ে থাকে, কবিরা বরাবরই দূরদৃষ্টির অধিকারী। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘নারী’ কবিতায় রেখে গেছেন এর বহুল প্রচারিত ও অনবদ্য সাক্ষ্য: ‘সাম্যের গান গাই—/ আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।/ বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
প্রতিটি পরিবার ও ব্যক্তিমানুষের জীবনে গাওয়া হোক সমতার জয়গান। নারীর অগ্রযাত্রা পাক অগ্রাধিকার। জীবন আরও সুন্দর হয়ে উঠুক সবার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top