টেকসহি I সচেতন চেতন
প্রতিদিনকার জরুরি ছোট ছোট কেনাকাটার সিদ্ধান্তে সবার স্বতন্ত্র মূল্যবোধের এমন সম্মিলিত প্রকাশ অর্থপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে পৃথিবীতে
জিনিসপত্রের দামের যে ঊর্ধ্বগতি, টুকটাক কেনাকাটা করতে গেলেও হাজার টাকা গুনতে হয়। অনলাইন শপিংয়ের ব্যাপক উত্থানের দরুন শুধু যতটুকু দরকার, ঠিক ততটুকু কেনাকাটা করা এখন প্রায় সবার জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্যানডেমিকের পর অনলাইন কেনাকাটা যতটা সহজ হয়ে উঠেছে, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে হয়ে দাঁড়িয়েছে বিভ্রান্তির কারণও। তাই ফ্যাশন হান্ট আর অহেতুক কেনাকাটার মাঝে একটি রেখা টানতে মাইন্ডফুল শপিংয়ের খুঁটিনাটি জেনে নেওয়া এ যুগে ভীষণ দরকার।
মাইন্ডফুল শপিং কী? সহজ কথায়, কেনাকাটার সময় শুধু এখনকার প্রয়োজনকে মাথায় রাখা। কেনাকাটার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক কিছু অভ্যাস যেমন ইম্পালস বায়িং, অহেতুক অতিরিক্ত খরচ কিংবা অনৈতিক কোনো ব্র্যান্ডকে সমর্থন—এর সব কটিই মাইন্ডফুল শপিং থেকে ক্রেতাদের দূরে সরিয়ে দিতে পারে। তাই কম বাজেটে শপিং করার ক্ষেত্রে কাজে আসতে পারে ছোট ছোট কিছু উপায়।
বি অথেনটিক
ক্রেতাদের কেউ কেউ প্রতি মাসে কেনাকাটার জন্য আগে থেকেই একটি বাজেট নির্ধারণ করতে পছন্দ করেন। আবার কাউকে দেখা যায় কেনাকাটার কোনো হিসাব নেই। দুটি ক্ষেত্রেই ব্যক্তি ফ্যাশন অনুযায়ী ঠিক কী এবং কতটুকু এই মুহূর্তে প্রয়োজন, তা নিয়ে আগে থেকে ছক কেটে নেওয়া জরুরি। এটি যেমন নিজস্বতা বজায় রাখতে সাহায্য করবে, তেমনি মাইন্ডফুল শপিংয়ের যাত্রা করবে সহজ। নিজের প্রয়োজনের তালিকা তৈরি করতে নিজেকে কিছু প্রশ্ন করা যেতে পারে:
এই মুহূর্তে ওয়্যারড্রবে ঠিক কোন জিনিসের অভাব রয়েছে?
কোন জিনিস এই মুহূর্তে কিনতে ইচ্ছা করছে?
প্রতিটি আইটেমের জন্য কতটুকু খরচ করতে রাজি আছেন? অর্থাৎ শুধু কি সাধারণ পণ্য কেনার পরিকল্পনা, নাকি বিলাসবহুল বিনিয়োগও হতে পারে?
কেনাকাটার সময় এমন কিছু উত্তরের তালিকা হাতে থাকলে মাইন্ডফুল শপিংয়ের দিকে একধাপ এগিয়ে যেতে পারেন যে কেউ। কারণ, এমন তালিকা অথেনটিক স্টাইল অনুযায়ী ফ্যাশনেবল হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে স্পষ্টতা দেয়। আর একটি নির্দিষ্ট বাজেট অহেতুক খরচের লাগাম টেনে ধরে। নিজের পছন্দ ও প্রয়োজনের জিনিসটি অফ সিজনে কেনা মাইন্ডফুল শপিংয়ের একটি বড় কৌশল—তা কিন্তু প্রমাণিতও। এই নিয়মে চললে অনেক সময় খুব হাই এন্ড প্রোডাক্টও হাই স্ট্রিট বাজেটে মিলে যেতে পারে। আবার অনলাইনে এমন অনেক পণ্যই দেখা যায়, যেগুলো রানওয়ে কিংবা ফ্যাশন শোতে ভালো দেখালেও স্টাইল স্টেটমেন্টের সঙ্গে ঠিক যায় না। তাই আগেই এই তালিকা করে নিলে নিজস্বতা বজায় রাখার পাশাপাশি অযথা জিনিসে খরচও কম হবে। চেষ্টা করা যায় এমন কিছু জিনিসও কেনার, যেগুলো সব ঋতুতেই ব্যবহার করা যাবে। ভিন্ন ভিন্ন স্টাইল মেনে। এটিও মাইন্ডফুল শপিংয়ের আরেকটি কৌশল। এ ছাড়া হাই এন্ড বিলাসবহুল ব্র্যান্ডে তখনই বিনিয়োগ করা উচিত, যখন মনে হবে সেটি বছরের পর বছর টিকে যাবে ট্রেন্ডে।
বি ক্রিয়েটিভ
সাসটেইনেবিলিটির এই যুগে ‘আপসাইক্লিং’ একটি বহুল ব্যবহৃত পরিভাষা। সহজ কথায় এ হলো পুরোনো কিংবা ব্যবহার করা হয় না এমন পোশাককে নতুন রূপে রূপান্তর করা। এই প্রক্রিয়ায় কাটা এবং সেলাই, নতুন অলংকরণের যোগ, বা একটি নতুন পোশাকের ফ্যাব্রিককে পুনরায় তৈরি করা হয়। এর ফলে অনন্য সব পোশাক তৈরি করা যেতে পারে, যা টেকসইও হবে। যেহেতু আপসাইক্লিংয়ের কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই, তাই নিজের সৃজনশীলতা ব্যবহারের মাধ্যমে তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে এমন কোনো পোশাক বা অ্যাকসেসরি, যা নিজস্ব ফ্যাশন স্টেটমেন্টের সঙ্গে মানানসই। উদাহরণস্বরূপ, শীতকালে ব্যবহার করা কোনো পুরোনো জিনস কেটে গরমকালের শর্টস বানানো সম্ভব। পুরোনো কাপড় কেটে নতুন ফ্যাব্রিকে প্যাচওয়ার্ক করে নেওয়া যেতে পারে। ব্যবহার করা যেতে পারে লেইস কিংবা কাপড়ের চারপাশে। সহজ কোনো সেলাইয়ের সূক্ষ্মতায়। আপসাইক্লিংয়ের সবচেয়ে বড় সুবিধা এটিই, এতে সম্ভাবনার কোনো শেষ নেই; রয়েছে হাজারটা বিকল্প, আর সেটাও একেবারে ন্যূনতম খরচে।
বি ভিনটেজ স্যাভি
পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে সেকেন্ড হ্যান্ড কালচার কিংবা থ্রিফট কালচার অনেক আগে থেকে খুব জনপ্রিয় হলেও ধীরে ধীরে বাংলাদেশেও এর চল তৈরি হচ্ছে। এ জন্যই দোকানে গিয়ে কিংবা অনলাইনে—উভয় ধরনের কেনাকাটার ক্ষেত্রে ভিনটেজ শপিং জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে বাংলাদেশে সেকেন্ড হ্যান্ড ফ্যাশনের চল কিছুদিন আগে শুরু হলেও, পোশাক রেন্ট করার বিষয়টি চলে আসছে অনেক বছর ধরে। ইদানীং প্রায় সব স্তরের মানুষই বিয়ের শাড়ি, লেহেঙ্গা কিংবা শেরওয়ানি থেকে শুরু করে যেকোনো পার্টিওয়্যার এক দুদিনের জন্য ভাড়া করে নিয়ে পরছেন। এতে মাইন্ডফুল শপিং যেমন পরিপূর্ণতা পাচ্ছে, তেমনি ওয়্যারড্রব এমন সব জিনিসে বোঝাই হচ্ছে না, যা কিনা কখনোই এক দুদিনের বেশি ব্যবহার করা হবে না। এ ছাড়া ভিনটেজ শপিংয়ের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মও আপসাইক্লিংয়ের ব্যাপারে সচেতন হবে। তাই ভিনটেজ স্যাভি হওয়ার ব্যাপারটি বাজেটের মাঝে মাইন্ডফুল শপিংয়ের এমন একটি কৌশল, যা উপেক্ষার কোনো অবকাশ নেই।
মাইন্ডফুল শপিংয়ের ক্ষেত্রে একটি বিষয় মনে রাখা জরুরি, যেকোনো ফ্যাশন ট্রেন্ডই ঘুরে ঘুরে আবার ফিরে আসে। অর্থাৎ আজকে যে ফ্যাশনের চল নেই বলে সব পোশাক ফেলে দেওয়ার কথা ভাবা হয়, হয়তো সেগুলোই আবার কয়েক বছর পরে ফ্যাশনে ফেরত আসবে। তার মানে যে কাপড় আজ ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে, হতে পারে সামনের বছর ওই একই কাপড় সবচেয়ে বেশি ট্রেন্ডি হয়ে ফেরত আসছে। তাই সংরক্ষণের অভ্যাস গড়ে তোলা যেতে পারে। আরেকটি খুব কার্যকরী কৌশল হলো একই পোশাকের ভিন্ন ভিন্ন স্টাইলিং। একটি সাদা শার্ট হয়তো একইভাবে পরা হয়েছে সব সময়, তবে সেটি স্টাইল করার বিভিন্ন উপায় আছে। কেননা যখন এটি স্কার্ট দিয়ে পরা হবে, তখন এক রকম, আবার জিনস বা ট্রাউজার দিয়ে পরলে হয়ে যায় একদমই ভিন্ন কিছু। তাই যেকোনো পোশাক কিনে আনার পরই সবার একটু সময় নিয়ে ভাবা উচিত, এটি কতগুলো ভিন্ন স্টাইলে পরা যেতে পারে।
শিরীন অন্যা
ছবি: ইন্টারনেট