মনোজাল I ফ্যাশনিস্ট ফেমিনিস্ট
দুইয়ের মাঝে দ্বন্দ্বের সুযোগ নেই; বরং সফল সন্ধির উদাহরণ মিলবে মেলা। তবু জনমনে অবস্থান বিপরীত। ফেমিনিজম সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা, নাকি ফ্যাশনকে চটকদার হিসেবে গণ্য করার মানসিকতার চাদর—করা যাক সন্ধান
ফেমিনিজম। সমতার দর্শন। অধিকারের ক্ষেত্রে সব লৈঙ্গিক সমতার মতবাদ এটি। এই ফিলোসফিতে বিশ্বাসীদের বলা হয় ফেমিনিস্ট। সমতার সঙ্গে যেহেতু অধিকারের সম্পর্ক তীব্র, তাই তা আদায়ের উদ্দেশ্যেও কাজ করেন ফেমিনিস্টরা। নারী-পুরুষনির্বিশেষে যে কেউ হতে পারেন ফেমিনিজমে বিশ্বাসী। এটি কোনোভাবেই শুধু মেয়েদের বিষয় নয়।
আবার ফ্যাশনে প্রকাশিত হয় পোশাক-সাজ-অনুষঙ্গের সামগ্রিক রূপ। ফ্যাশন ও ফেমিনিজম—দুটি শব্দই মিশে আছে জীবনযাপনের দর্শনের সঙ্গে। ফ্যাশন মোটা দাগে নজর কাড়ে; কিন্তু ফেমিনিজম স্থান করে নেয় ভাবনায়, যা দৃশ্যমান নয়।
ফেমিনিজম আর ফ্যাশন—একটি দর্শন, অন্যটি আত্মপ্রকাশের পন্থা। ‘দুটি দুই মেরুর গল্প’—এভাবে বলে সহজে এক লাইনে যুক্তিতর্ক শেষ করে দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, পোশাক একজন মানুষের বাহ্যিক প্রকাশ, আর ভাবনা ব্যক্তির মস্তিষ্কের অন্দরমহলের গল্প। দুইয়ের বন্ধুত্ব হোক না হোক, দ্বন্দ্ব নেই। কিন্তু দাগ হয়ে আছে সমাজের তৈরি কলহ! যেন একজন ফেমিনিস্ট কোনোভাবেই ফ্যাশনিস্ট হতে পারেন না। আবার ফ্যাশনের সঙ্গে তাল মেলানো মানুষটি হতে পারেন না ফেমিনিজমে বিশ্বাসী।
ফ্যাশনের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক গাঢ়। শুধু ফ্যাশন সেক্টরে নারী শ্রমের উদাহরণেই কেচ্ছা শেষ নয়। ফ্যাশন বাজারের প্রসারেও থাকে নারীর ভূমিকা। মেয়েরা ফ্যাশন আইটেম কেনাকাটায় পুরুষের চেয়ে ২২৬ শতাংশ বেশি ব্যয় করেন। এই বিপুল কেনাকাটায় চিন্তা-দর্শন-শিক্ষার শক্তি প্রতিফলিত হয়। অর্থাৎ ফেমিনিজমের দর্শন ধারণ পোশাক-অনুষঙ্গ-সাজে প্রকাশিত হয়। কিন্তু ফেমিনিজম কোনোভাবেই নতুন পোশাক, পোশাকের রং, নকশার বিষয়ে নির্দেশনা দেয় না; বরং স্বাধীনভাবে জীবনধারণে উৎসাহ দেয়, যা একজন মানুষকে চলতি ফ্যাশন ট্রেন্ড মানতেই হবে এমন সামাজিক চাপে পড়তে দেয় না। আবার কেউ চাইলে যেকোনো ট্রেন্ডমুখী হতেই পারেন। সেখানেও বাধা নেই।
লন্ডন ফ্যাশন কাউন্সিলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্যারোলিন রাশ একটি লেখায় আলোকপাত করেছেন, কেন ফ্যাশন মেয়েদের জন্য অন্যতম শক্তিশালী ফেমিনিস্ট টুল। বহুল পরিচিত ফ্যাশন ম্যাগাজিন হারপার’স বাজারের মাধ্যমে তার সেই বয়ান জানা যায়। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘ফ্যাশন শুধু একটি কাপড় নয়, প্রতিটি স্টাইলের পেছনে রয়েছে গল্প। একজন ব্যক্তি কিংবা একটি জাতির ক্ষমতায়নের দলিল। পোশাকে স্টাইল, রং আর আকারের পাশাপাশি দর্শনও ফুটে ওঠে।’
প্রশ্নোত্তর-সংক্রান্ত ওয়েবসাইট কোরা ডট কমে দেখা যায়, এক ব্যক্তি জানতে চেয়েছেন, কীভাবে তিনি একজন ফেমিনিস্টকে চিনতে পারবেন। সেখানে উত্তর দিয়েছেন ৫৫ জন। যাদের একটি বড় অংশ মনে করেন, ফেমিনিস্টদের পোশাক অথবা সাজসজ্জা দেখে চিনে নেওয়ার উপায় নেই। একজন ফেমিনিস্ট লিখেছেন, ‘আমাদের কোনো ইউনিফর্ম নেই, যা দেখে আপনি চিনতে পারবেন।’ তার কথার যুক্তি মেলে অন্যদের কমেন্টেও। ফেমিনিজম একটি দর্শন, যা একে অন্যকে মানুষ ভাবতে শেখায়। জেন্ডার সেখানে কোনো বৈষম্য তৈরি করে না। সম-অধিকার, চাহিদার সমতা, অবস্থানের সুসমতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা—যা কিছু একজন মানুষ হিসেবে প্রাপ্য হতে পারে, তার যথাযথ প্রয়োগ।
ফেমিনিজম যে শুধু মেয়েদের বিষয়, তা-ও কিন্তু নয়। এটি একটি মতবাদ; যেকোনো মানুষ ধারণ করতে পারেন। ব্যক্তি তার চাহিদা অনুযায়ী নিজেকে সাজিয়ে তোলেন। সেখানে তার চিন্তা-ভাবনা, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের যেমন প্রতিফলন ঘটে, তেমনি জীবনযাপন, পেশা, ধর্মবিশ্বাস, রাজনৈতিক অবস্থানসহ সবকিছুর প্রভাব থাকে। আবার এ সবকিছুই ছাপিয়ে যেতে পারে ব্যক্তির নিজস্বতা বোধ। তিনি চাইলে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নিজের মতো। কোনো একটি নির্দিষ্ট ট্রেন্ড ফলো না-ও করতে পারেন। সমাজে এমন অনেককে দেখা যায়, যিনি সব সময় নিজের মতো করে নিজেকে সাজিয়ে নেন; যা ধীরে ধীরে তার স্টেটমেন্ট স্টাইলে পরিণত হয়। সেখানে বর্তমান হালচাল গুরুত্ব পায় না। ইন ট্রেন্ডের সঙ্গে জুতে মেলে না সেভাবে। কারণ, তিনি নিজের মতো করে চলতে ভালোবাসেন। ফ্যাশন ধারার চেয়ে নিজস্বতা বোধ তাকে বেশি তাড়িত করে। এমন স্টাইলিশদের অনেকে ধ্যানধারণায় ফেমিনিজমের অনুসারী হতে পারেন, না-ও পারেন।
ফেমিনিজমে বিশ্বাসী মানুষ নতুনকে গ্রহণে আগ্রহী হন না, এমনও নয়। নতুনে বেশির ভাগ মানুষের আগ্রহ থাকে, সেই তালিকায় নারীবাদে বিশ্বাসীরাও আছেন। আবার যারা রাজনীতি-সচেতন, তাদেরকে চলমান ঘটনাবলি নিয়ে সচেতন হতে দেখা যায়, যার প্রভাব তাদের ফ্যাশনেও পড়ে। স্লোগানসমৃদ্ধ টি-শার্ট, ব্যাগে বেরিয়ে পড়তে দেখা যায়। তাদের মধ্যে ফেমিনিস্ট যদি কেউ থাকেন, তবে তিনিও গায়ে জড়াতে পারেন এসব পোশাক; যা সরাসরি পলিটিক্যাল স্ট্যান্ডের সঙ্গে জড়িত হতে পারে।
২০ শতকে ফ্যাশন আর ফেমিনিজম পাশাপাশি পা ফেলেছে। উদ্দেশ্য, নারীদের ভোটাধিকার। এই আন্দোলনের সময় সাদাকে নির্দিষ্ট করা হয় সমমনাদের পোশাকের রং হিসেবে। মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় একে বলা হয়েছে শুদ্ধতার রং। অল হোয়াইট ড্রেসে এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন প্রতিবাদীরা। ২০১৬ সালে আবারও আলোচনায় আসে এই ‘সম্পূর্ণ সাদা পোশাক’। তবে কারণ ছিল ভিন্ন। হিলারি ক্লিনটন তখন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী। যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো কোনো নারীকে এই পদে লড়তে দেখেছে। হিলারি গণসংযোগের উদ্দেশ্যে হাজির হয়েছিলেন হোয়াইট প্যান্ট-স্যুটে। তার সমর্থকেরাও সাদা পোশাকে জড়ো হয়েছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তখন দুটি হ্যাশট্যাগের দারুণ দাপট। #ওয়্যারহোয়াইটটুভোট এবং #প্যান্টস্যুটন্যাশন। এই সাদা স্যুটের দৌরাত্ম্য দেখা গেছে আমেরিকার বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের বিজয়েও। তিনি জনসাধারণকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য প্রথমবার সামনে এসেছিলেন হোয়াইট প্যান্ট-স্যুটে।
ফাস্ট ফ্যাশনের বিপক্ষে মতবাদ দিয়েছেন ফেমিনিস্টরা। ‘লেবার বিহাইন্ড দ্য লেবেল’ শিরোনামে জানিয়েছেন প্রবল আপত্তি। এর কারণ নারীদের শ্রমের অবমূল্যায়ন, স্বাস্থ্যহানিসহ বিভিন্ন সমস্যা। এমন গুরুতর বিষয় ফাস্ট ফ্যাশনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় মডেলটির বিপক্ষে অবস্থান নেন নারীবাদে বিশ্বাসীরা। এ কারণে ফাস্ট ফ্যাশন মডেলের মাধ্যমে উৎপাদিত পোশাকের ক্রেতা না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারেন তারা। কিন্তু এতে ট্রেন্ড থেকে ছিটকে পড়ার আশঙ্কা সেভাবে নেই বললেই চলে। এর বিকল্প হিসেবে আছে টেকসই তত্ত্বে উৎপাদিত পোশাকের বিভিন্ন লাইন।
ফ্যাশন নারীবাদী আন্দোলনে সহায়ক হতে পারে। ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তনের জন্য হতে পারে কার্যকরী প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু ফেমিনিজম ধারণ করা মানে রংহীন পোশাক কিংবা ট্রেন্ডে বিগ নো কোনোভাবেই নয়। লাল-নীল-সবুজ-হলুদ—যেকোনো রঙের পোশাক পরে স্বাধীনভাবে সম-অধিকার নিয়ে পথচলাই তাদের উদ্দেশ্য।
সারাহ্ দীনা
ছবি: ইন্টারনেট