কভারস্টোরি I নন্দনের ব্যাকরণে
হ্যাশট্যাগিংয়ের এ যুগে এর প্রভাব প্রবল। ইনস্টা-টিকটকে ‘ফুল সুয়িং’। অথচ আনকোরা নয়। শিকড় গভীরে প্রোথিত, দর্শনশাস্ত্রে। সুন্দরকে আরও সুন্দর করে তোলার ধারার সূত্র খুঁজেছেন সারাহ্ দীনা
‘অ্যাসথেটিক ইন ফ্যাশন’। সহজ বাংলায় ফ্যাশনে নন্দনতত্ত্ব। যার ব্যাকরণের বিশ্লেষণ আর সূত্রের সমীকরণের সহজ প্রকাশে মুখর সাম্প্রতিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো।
অ্যাসথেটিক ইন ফ্যাশন—ট্যাগলাইনে ইনস্টা আর টিকটকের ছোট ছোট ভিডিও কনটেন্ট মনোযোগ কাড়ছে সবচেয়ে বেশি। আলোকচিত্র, চালচিত্র—দুই ধরনে দেখা যাচ্ছে ফ্যাশন অ্যাসথেটিকের হ্যাশট্যাগ। সঙ্গে কেউ কেউ যোগ করে দিচ্ছেন চেনা গানের সুর, কবিতা কিংবা মনোলগ। এমনকি অ্যাসথেটিক ফিল্টারের ব্যবহারও বেড়েছে। র ছবির বদলে কুইক ফিল্টারিংয়ে আগ্রহ বাড়ছে। মনমতো লিরিক, কবিতার লাইনও লিখছেন কেউ কেউ।
অ্যাসথেটিক ইংরেজি শব্দ। কিন্তু এর শিকড় গ্রিক শব্দভান্ডারে। বাংলা করলে অর্থ দাঁড়ায় ‘নান্দনিক’ কিংবা ‘শিল্প রুচিসমৃদ্ধ’। ফ্যাশন দুনিয়ার সঙ্গে মিল রেখে বলা যেতে পারে, ‘ফ্যাশনকে শিল্পবোধের সাহায্য নিয়ে প্রকাশ করার দর্শন’। ১৮৫০ সালে ইংরেজি অভিধানে ‘অ্যাসথেটিক’ প্রথম জায়গা করে নেয়। মজার বিষয় হচ্ছে, শব্দটির গভীর সম্পর্ক রয়েছে গণিতের সঙ্গে। গাণিতিক সূত্রের বিভিন্ন খটমট দিক প্রকাশে ব্যবহার করা হয়। মানচিত্র তৈরিতেও প্রয়োগ করা হয়। আধুনিক প্রযুক্তিতে আলাদা আধিপত্য রয়েছে এর। ওয়েবসাইট ডিজাইন করেন যারা, তাদের কাছে আবার অর্থ ভিন্ন।
এবার ফ্যাশনের প্রসঙ্গে আসা যাক। মূলত ফ্যাশন অ্যাসথেটিকে পোশাক ও অনুষঙ্গ প্রকাশিত হয় সুন্দরতার মোড়কে। পরিধানকারীর দর্শন, বিশ্বাস, জীবনযাপন সেখানে বিকাশিত হয়। ফ্যাশন অ্যাসথেটিক মানুষের নজর কাড়তে ভূমিকা রাখে। লিরিক্যাল বিউটি এই অ্যাসথেটিকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ছন্দময়তার সৌন্দর্যের যথাযথ ব্যবহারে নিজেকে আনকোরা রূপে সাজিয়ে তোলার যথার্থ প্রকাশ যেন। টপের সঙ্গে বটমের সম্মিলন, কালার স্কিমের সিলেকশন, চুল বেঁধে নেওয়ার ঢং, অলংকারের নিখুঁত বিন্যাস—সবকিছুতে পরিমিতি বোধের প্রয়োজনীয়তা জানার বিষয়ও বটে।
ফ্যাশন অ্যাসথেটিক
যা তৈরি হয় একাধিক এলিমেন্টের সহাবস্থানে। একটির সঙ্গে অন্যটির ভারসাম্য, অনুপাত ও সাদৃশ্য এখানে গুরুত্বপূর্ণ। আবার রং, টেকশ্চার, রেখার ব্যবহার, পোশাক-অনুষঙ্গ-মোটিফের আকৃতিও তাৎপর্যপূর্ণ। ফ্যাশন অ্যাসথেটিক মূলত একটি দর্শন এবং এটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। চিরদিন টিকে থাকার মতো কোনো কথা এখানে দেওয়া নেই; বরং পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন দ্রুত হতে পারে, আবার অনেক ক্ষেত্রে ধীর।
আমেরিকান পলিটিক্যাল অ্যান্ড কালচারাল রাইটার ভার্জিনিয়া ইনমান পোস্ট্রেল তার ‘দ্য সাবস্টেন্স অব স্টাইল: হাউ দ্য রাইজ অব অ্যাসথেটিক ভ্যালু ইজ রিমার্কিং কমার্স, কালচার অ্যান্ড কনশাসনেস’ বইয়ে একটি বিষয় তুলে ধরেছেন, যা অ্যাসথেটিক ফ্যাশনের চলমান পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো সূক্ষ্ম নকশা অনেক বেশি ব্যবহৃত হয়, তখন পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কারণ, ফ্যাশন ডিজাইনাররা নতুন মোটিফ, নতুন প্যাটার্নের খোঁজে নিরলস কাজ করেন। একই নকশা বহুবার ব্যবহারে স্বভাবতই তাদের অনীহা থাকে। সৃষ্টিশীলতায় বিঘ্ন ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে তারা যথাযথভাবে বহুল প্রচলিত নকশাটি ব্যবহার করতে জটিলতার সম্মুখীন হন। অন্যদিকে উৎপাদনকারীরা জনপ্রিয় নকশা বহুবার ব্যবহারে আগ্রহী হন। কারণ, তা তাদের কাছে সহজ। তখন তারা প্রতীক এবং সেলাইয়ের কাটগুলো নিজেদের মতো ব্যবহার করতে থাকেন।
ইতিবৃত্ত
১৯৩০ সাল থেকে ফ্যাশন অ্যাসথেটিকের গুরুত্ব বাড়তে শুরু করে। কারণ, তখন থেকে ‘মুভিং পিকচার’ অর্থাৎ ভিডিও ধারণের চল শুরু। সে সময়ে মূলত মেয়েদের কাছে ‘ফ্যাশন অ্যাসথেটিক’ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে সুন্দর পোশাক, অনুষঙ্গ, মেকআপ ব্যবহারের প্রতি আগ্রহ দেখা যায়। হলিউড তারকাদেরকে স্টাইল ইনস্পিরেশন হিসেবে অনুকরণ করতে শুরু করেন তখনকার ট্রেন্ড-সচেতনেরা। এখানে নির্ধারিত কোনো তারকার জনপ্রিয়তা ছিল না; বরং দেখা যেত, নিজের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মিলে যায় এমন সেলুলয়েড ব্যক্তিত্বকে অনুসরণ করতেন নারীরা। খেলাধুলায় আগ্রহী নারীরা সে সময়ে আমেরিকান অভিনয়শিল্পী জিনজার রজার্সের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। এই অভিনেত্রী ১৯৪০ সালে ‘কিটি ফয়েল’ চলচ্চিত্রের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন। যেখানে তিনি ফুটিয়ে তোলেন সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির একজন নারীকে, যার ব্যক্তিত্ব শক্তিশালী। শতভাগ ফেমিনিন নন। চেনা সমাজের সঙ্গে বেমানান। স্ট্রাকচারড ডিজাইনের পোশাকে দেখা যায় তাকে। হেয়ারস্টাইলিং ফ্রন্ট সেটিং ছিল বেশির ভাগ সময়। এ সবকিছু মিলিয়ে একজন শক্তিশালী নারীর রূপ চিত্রিত হয়েছে। চরিত্রটির স্টাইল ফ্যাশন অ্যাসথেটিক হিসেবে মন জয় করেছিল সে সময়ের স্পোর্টি উইম্যানদের।
সে সময়ে আরও কিছু ফ্যাশন অবতারের দেখা মেলে। তরুণ তুর্কিদের আগ্রহ ছিল জ্যানেট গাইনোরের প্রতি। তিনি ছিলেন নির্বাক চলচ্চিত্রের নামীদামি তারকা। অস্কার পাওয়া ‘সেভেন হ্যাভেন’ চলচ্চিত্রে তিনি হাজির হয়েছিলেন বাহুল্যহীন পোশাকে। একই তারকার ‘স্ট্রিট অ্যাঞ্জেল’ মুভিতে তারুণ্যের দীপ্তির দেখা মেলে। সার্কাস আর্টিস্ট রোলে দারুণ ফ্যাশনেবল করে দেখানো হয় তাকে।
প্রেমে ডুবে থাকা নারীরা মজেছিলেন কানাডিয়ান-আমেরিকান অভিনেত্রী নরমা শিয়েরার সৌন্দর্যগুণে। সাহসী চরিত্রে পারদর্শী ছিলেন। তার লাস্যময়তার উপস্থিতি ছিল মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো।
একই সঙ্গে এই তিন সিলভার স্ক্রিন জয়ীর ফ্যাশন সেন্স তখনকার নারীদের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। তৎকালীন পুরুষদের মাঝে ফ্যাশনে নির্লিপ্ততা ছিল প্রবল। তাই শুধু ফিমেল ফ্যাশন অ্যাসথেটিক আলোচনার বিষয় হয়েছে। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত হয় এই ধারা। তারপরে আসে বৈচিত্র্য।
১৯৭০ সাল থেকে পোশাকের নকশায় ভারসাম্য এবং অনুপাতের ওপরে কম জোর দেওয়ার চল আসে। কোনো নকশার ব্যাকরণ নয়, সেখানে জায়গা করে নেয় শৈল্পিকতা। ১৯৭০-এর দশকে ফ্যাশন নিয়ে ‘ড্রেস ফর সাকসেস’ আন্দোলন হয়। এই মুভমেন্টের সমর্থকেরা বিশ্বাস করতেন, একজন ব্যক্তি কীভাবে পোশাক পরেন, তার ড্রেস সেন্স কেমন—এ সবের ওপর তার সাফল্য নির্ভর করে। আবার স্কিন টোনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রঙের পোশাক পরা নিয়ে সচেতনতা তৈরিও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই আন্দোলনের মূলে ছিল ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত ড্রেস ফর সাকসেস এবং ১৯৭৭ সালের ‘উইমেন: ড্রেস ফর সাকসেস’ বই দুটি। লেখক ছিলেন গবেষক জন টি মলয়। বইয়ের শিক্ষা রূপ নেয় আন্দোলনে। সমর্থনকারীদের মধ্যে পাওয়ার স্যুট পরার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তখনকার ফ্যাশন অ্যাসথেটিক হিসেবে পোশাকটি জায়গা করে নেয়।
গুরুত্বপূর্ণ নাকি গুরুত্বহীন
ফ্যাশন অ্যাসথেটিক গুরুত্বপূর্ণ। মূল কারণ এই ফিলোসফি শুধু পোশাক পরে থাকা ব্যক্তির একার বিষয় নয়। এটি তাদেরও বিষয় যারা ব্যক্তিকে দেখতে পান। অর্থাৎ, পরিধানকারী ও দর্শনকারী—দুজনের জন্যই ফ্যাশন অ্যাসথেটিক গুরুত্ববহ। একজন মানুষ যখন আরেকজনকে দেখেন, তখন তার পোশাক, সাজসজ্জা, অনুষঙ্গ—সবকিছুই যিনি দেখছেন, তার ওপরে প্রভাব ফেলে। মস্তিষ্কের আবেগের জায়গা অনুরণিত হয়ে ওঠে। এ কারণে ছন্দময়-সুসমন্বিত ফ্যাশন মস্তিষ্কে ইতিবাচক প্রভাব রাখে। নিজের আউটফিট প্ল্যানিংয়ের সময় দেখতে কেমন লাগবে, বিষয়টি ভাবলে ফ্যাশন অ্যাসথেটিক বেশ সুন্দর করে প্রকাশ করা সম্ভব। অন্তর্জালে পাওয়া ফ্যাশনিস্তাদের বিভিন্ন মত যাচাই করলে বোঝা যায়, এই অ্যাসথেটিকে আগ্রহীরা একজন অপরজনকে দেখলে বুঝতে পারেন যে তারা একই ‘ফ্যাশন কোর’-এর অনুসারী। একজন যখন নিজের মনমতো সুন্দর পোশাক পরেন, স্বাভাবিকভাবে তার ভালো অনুভূতি হয়। কারণ, নিজেকে সুন্দর দেখালে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। আবার, একই সঙ্গে যখন সুন্দরতার সম্মিলনে চোখ আটকে যায়, প্রশান্তি অনুভূত হয়, তখন ভালো লাগা ছুঁয়ে যায় মনে।
শুধু অ্যাসথেটিকের গুণে অন্যের কাছে পৌঁছে যেতে পারে বিভিন্ন বার্তা; যা ফ্যাশন-সচেতন ব্যক্তির নানা বিষয়ে জানান দিতে ভূমিকা রাখতে পারে। তিনটি বিষয় এখানে কার্যকরী হয়ে থাকে—পোশাক, পরিস্থিতি, সামাজিক অভিজ্ঞতা।
পোশাক: বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালীন আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের জার্সি চোখে পড়ে অহরহ। আকাশি-সাদা অথবা উজ্জ্বল হলুদের ঝলকে বোঝা যায়, সামনে কোন দলের সমর্থক রয়েছে। সহজ-সরল হিসাব। আবার এই ম্যাচ দেখতে যদি কোনো ব্যক্তি কাউবয় শার্ট পরে আসেন, তবে তাকে দেখে মনে হতে পারে, তিনি ফুটবল ম্যাচ পছন্দ করেন। উপভোগের আগ্রহে এসেছেন। কিন্তু কোন দলের সমর্থক, তা নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয় না।
পরিস্থিতি: বর্তমানে ইন ট্রেন্ড এমন বেশ কয়েকটি ফ্যাশন কোরে শর্ট স্কার্টের উপস্থিতি আছে। বটমে শর্ট স্কার্ট আর বডি হাগিং টপের কম্বিনেশনে কেউ যদি আলোক সজ্জিত, ঝলমলে একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাহলে একঝলকে মনে হতে পারে, বাড়িটিতে কোনো পার্টির আয়োজন করা হয়েছে; যেখানে ডিজের তালে তাল মেলানোর জন্য হাজির সেই তরুণ তুর্কি।
সামাজিক অভিজ্ঞতা: সাদা পোশাক, নকশার সামান্যতা এবং মিনিমালিস্ট মেকআপে কয়েকজনকে একসঙ্গে দেখলে মনে হতে পারে, তারা যাচ্ছেন কোনো প্রিয়জনের বিদায়ে শামিল হতে। আবার ট্র্যাকস্যুটে পথ অতিক্রমকারী কোনো দলকে হেঁটে যেতে দেখলে মনে হতে পারে, তারা সবাই প্রফেশনাল অ্যাথলেট।
কোনো ব্যক্তিকে প্রথমবারের মতো দেখে তার বিষয়ে ধারণার ক্ষেত্রে ফ্যাশন অ্যাসথেটিকের ভূমিকা দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই কয়েক মুহূর্তে নেওয়া সিদ্ধান্ত সব সময় ঠিক না-ও হতে পারে। কাউবয় শার্টের দর্শক ব্রাজিলের ডাই হার্ট ফ্যান হতে পারেন। যিনি জার্সিতে নিজেকে উপস্থাপনের প্রয়োজন বোধ করেননি। ফ্যাশনেবল শর্ট স্কার্টের মেয়েটি বন্ধুদের সঙ্গে লং ড্রাইভে যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতে পারেন। সাদা পোশাকের দলটি কম সাজে নিজেদের মতো করে ঘুরতে বেড়ানো বন্ধুদের দল হতে পারে। ট্র্যাকস্যুটে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়া গ্রুপটি হতে পারে অফিস কলিগদের জোট। যারা ছুটির দিনে একসঙ্গে স্বাস্থ্যসচেতন হওয়ার পরিকল্পনা করছেন।
ফ্যাশন অ্যাসথেটিক ২০২৪
চলমান সময়ের ফ্যাশনে অ্যাসথেটিকের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে বেশি। এর পেছনেও যথারীতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। জেনারেশন জেডদের কাছে জনপ্রিয় টিকটক থেকে অনুপ্রাণিত বিভিন্ন ফ্যাশন কোর বর্তমান সময়ের ট্রেন্ড সেট করেছে। এর মাঝে কয়েকটি সরাসরি ফ্যাশন অ্যাসথেটিক জনরার প্রতিনিধিত্ব করে। নিয়মিত টিকটক ট্রেন্ড নিয়ে সচেতন থাকেন এমন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় প্রতিদিন নতুন নতুন ট্রেন্ড আসছে প্ল্যাটফর্মটিতে। আপডেটেড থাকতে হলে ফ্যাশন আইকনদের প্রোফাইলে যেমন চোখ রাখতে হচ্ছে, তেমনি প্রয়োজনীয় সবকিছু ওয়্যারড্রোবে সংগ্রহও করতে হচ্ছে। আবার ‘গুডবাই’ বলতে হচ্ছে অনেক কিছুকে। কারণ, এখন মাইক্রো ট্রেন্ডের সময়। লাইফ স্প্যান ক্ষুদ্র। আজ যা ট্রেন্ডি, কাল তা চোখের পলকেই আউট অব দ্য ট্রেন্ড।
সোশ্যাল মিডিয়া থেকে উৎসাহিত অ্যাসথেটিক নির্দিষ্ট করতে ‘কোর’ শব্দটির বহুল ব্যবহার দেখা গেছে কয়েক বছর ধরে। বারবিকোরের আগ্রাসন দেখা গেছে ২০২৩ সাল জুড়ে। ‘বারবি’ চলচ্চিত্রটি মুক্তির আগে থেকে পরবর্তী দীর্ঘ সময় ‘বারবি পিংক’ নিয়ে ফ্যাশন দুনিয়ায় প্রচুর কাজ হয়েছে। ক্রেতাচাহিদা আকাশ ছুঁয়েছে। এ রকম বিভিন্ন অ্যাসথেটিক আসা-যাওয়ার মাঝে অল্প কিছু টিকটক ফ্যাশন কোর বছরজুড়ে টিকে যাবে বলে ধারণা পাওয়া যায় দ্য এভরিগার্লস ম্যাগাজিনের লাইফস্টাইল জার্নালিস্ট এমিলি জ্যানেটজের লেখা আর্টিকেল থেকে। সেগুলো হচ্ছে:
টেনিসকোর: নাম শুনেই বোঝা যায়, টেনিস জড়িয়ে আছে দারুণভাবে। কুঁচি দেওয়া স্কার্ট, ভি-নেক সোয়েটার আর ফুটওয়্যারে স্নিকার—এই তিনই গুরুত্বপূর্ণ টেনিসকোরে। এই ফ্যাশন কোরকে অভিহিত করা হয় ‘বেস্ট অব বোথ ওয়ার্ল্ড’ হিসেবে। কারণ, মান আর নকশার কলেবরের বিশালতা আগ্রহীদের সুযোগ দেয় নিজের মতো করে স্টাইলিংয়ের।
ব্যালেকোর: ফেমিনিন ফ্যাশন অ্যাসথেটিক। বারবিকোর ট্রেন্ডের রোমান্টিক ভার্সন বলা যায়। ফ্যান্টাসি ভাইব প্রকাশিত হয়। মোলায়েম সিল্ক ফ্যাব্রিক, সুইটহার্ট নেকলাইন এবং রিবনের ব্যবহার—সবই এই কোরের অবদান। ফুটওয়্যারে প্রাধান্য লেইস-আপ ব্লাশ স্যাটিন পাম্প, ব্যালে ফ্ল্যাটের। বো টাইয়ের বো বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়। কখনো হেয়ার ডুতে, কখনো টপের অলংকরণে।
কোয়াইট লাক্সারি: অ্যান্টি ট্রেন্ড ফলোয়ারদের ট্রেন্ড। উচ্চ গুণমানসম্পন্ন। মিনিমালিস্ট। শুধু ২০২৪ সাল নয়, সব সময়ই ইন ট্রেন্ড। কালার প্যালেট নিরপেক্ষ; অর্থাৎ ‘নিউট্রাল’। স্টাইল ক্ল্যাসিক। ব্লেজার, টেইলরড বটম, বাটন ডাউন শার্ট, লেদার অ্যাকসেসরিজ রয়েছে এই কোরের তালিকায়।
কোস্টাল গ্র্যান্ডমা: চোখ বন্ধ করে যদি কল্পনা করা যায় সমুদ্রতীর ঘেঁষে একটি বাড়ি। বারান্দায় বসে আছেন বয়সের ঔজ্জ্বল্যে স্নিগ্ধ এক বয়োজ্যেষ্ঠ। প্রজ্ঞা, আত্মবিশ্বাস আর স্নিগ্ধতার পাশাপাশি কাব্যিক উপস্থিতি—এ রকম থিম নিয়ে ‘কোস্টাল গ্র্যান্ডমা’ ফ্যাশন অ্যাসথেটিক তৈরি হয়েছে। ২০২২ এ প্রথম দেখা মেলে। নিটিংয়ের সুচারু বুনন, লিনেনের কোমলতা আর মুক্তার প্রশান্তির সম্মিলনে তৈরি হয় কোস্টাল গ্র্যান্ডমা ফ্যাশন কোর।
কটেজকোর: পাফড স্লিভ, ফ্লোরাল প্রিন্ট, হেয়ার রিবন, স্মল হাইটের প্র্যাকটিক্যাল বুট, বাস্কেট ব্যাগের সমন্বয়ে রোমান্টিক কটেজকোর। কোজি লাইফস্টাইলের সুন্দর প্রকাশ। যেখানে প্রযুক্তির ছোঁয়া কম; বরং নস্টালজিয়ার মাদকতা বেশি।
ইলেকট্রিক গ্র্যান্ডপা: ‘গ্র্যান্ডপাকোর’ও বলা যেতে পারে। ‘ক্যাচ ফর অল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। আনকোরা নতুনের সম্ভাষণ নয়; বরং চেনা-জানা পুরোনোতে নতুন করে ছন্দ মেলানো। বুননে নিটিংয়ের প্রাধান্য। সোয়েটার ভেস্ট, বেসবল ক্যাপ, ভিনটেজ লোফার, কার্ডিগান, ব্লেজার, টেইলরড ট্রাউজার, ড্যাড স্নিকার—এসব নিয়ে গ্র্যান্ডপা ইন ফ্যাশন।
কার জন্য কোন কোর
মানুষমাত্রই যে নিজ নিজ ফ্যাশন অ্যাসথেটিক সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, এমন কিন্তু নয়। আবার ফ্যাশন-সচেতন হলেই প্রতিটি ট্রেন্ড মেনে চলতে হবে এমনটাও কোথাও লেখা নেই। কারও কাছে একঘেয়েমি কাটিয়ে ওঠার মন্ত্র হতে পারে এই ফ্যাশন অ্যাসথেটিক। আবার কারও কাছে মনে হতে পারে ‘একদম অযথা’! তবু যদি কখনো কারও নিজের ফ্যাশন অ্যাসথেটিক খুঁজে পেতে ইচ্ছা করে, তাহলে সপ্তসুরেই মিলবে সমাধান! মানে কী? মানে ৭টি টিপসে খুঁজে পাওয়া যাবে নিজের ফ্যাশন কোর।
ইউনিকনেস কালার প্যালেট: ঠিক কিসে মানায়? কোন রং পরলে আয়নায় নিজেকে দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়? কালার প্যালেটের কোন সারিটি মন কাড়ে? একটু ভাবলে উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
ইনস্পিরেশন: অনুপ্রেরণার উৎসে একজন অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কোন পরিস্থিতি অনুপ্রাণিত করে, উৎসাহ ঠিক কিসে পাওয়া যায়—এসব প্রশ্নের উত্তর আছে মনের আড়ালে। নিজের সঙ্গে একান্তে সময় কাটালে জানা যাবে। সে অনুযায়ী পোশাক খুঁজে নিলে আত্মবিশ্বাস বাড়বে। সময় কাটবে উৎফুল্লতায়।
ক্যাটাগরি: আলমিরার থাকা পোশাক মনোযোগ দিয়ে ঘাঁটলে একটির সঙ্গে অপরটির মিল-অমিল খুঁজে পাওয়া যায়। সাধারণত একজন ব্যক্তির ক্লজেটে থাকা কাপড় একই ঘরানার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কেউ হয়তো কালো ছাড়া ভাবতে পারেন না। বেশির ভাগ কাপড়ের রং কালো। আবার কারও হয়তো কালো ভালো লাগে না। প্যাস্টেল পারফেক্টই সই। কারও তাকেভরা শাড়ি। কারও কাছে আবার পাশ্চাত্যের পোশাকের বিশাল আয়োজন। নিজের জন্য ফ্যাশন অ্যাসথেটিকের সূত্রের খোঁজ মিলতে পারে ঘরের আলমিরায়। কারণ, কমফোর্টের খোঁজ ওই আলমিরাই বেশ জানে।
লাইকিং ডিজলাইকিং: প্রত্যেকের থাকে একান্ত পছন্দের পোশাক। একটাই যে হতে হবে এমন নয়। একাধিকও হতে পারে। প্রিয় পোশাকগুলো পাশাপাশি রেখে খেয়াল করে দেখলে বেশ খানিকটা বুঝতে পারা যায়, কোন ফ্যাশন কোর বেছে নিলে নিজের সঙ্গে মানিয়ে যাবে।
ডিক্লাটার: জমিয়ে রাখলে জমতেই থাকবে। কিন্তু খুঁজে পাওয়া যাবে না পারফেক্ট ড্রেস। তাই যা কিছু দীর্ঘদিন পরা হচ্ছে না, পুনরায় গায়ে জড়ানোর সম্ভাবনাও কম, সেগুলো বাদ দিলে পছন্দের বিষয়ে সহজে বোঝা সম্ভব।
ওয়্যার হোয়াট ইউ লাভ টু ওয়্যার: প্রিয় পোশাকে মন ভালো হয়। অপ্রিয়তে হয় অস্বস্তি। সেটাই স্বাভাবিক। যে পোশাকে আত্মবিশ্বাস বাড়ে, যে পোশাকে মনে হয় বিশ্ব জয় তো কোনো ব্যাপারই না, সে পোশাকেই নিজস্বতা লুকিয়ে আছে।
এমব্রেস ইওরসেলফ: পৃথিবীর কাছে সমর্থন-হাততালি চাওয়া হয়ে যায় মনের অজান্তেই। সমাজের গণ্ডি বুঝে পোশাক নির্বাচন, সেজে ওঠার প্রবণতাও অচেনা নয়। কিন্তু নিজের কাছে নিজেকে কতটা ভালো লাগে, তা নিয়েও ভাবা যেতে পারে। অন্যের চোখে সুন্দর হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মনমতো নিজেকে সাজিয়ে নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ; যা পরলে নিজেকে ভালো লাগে, তা আপন করে নিলে সাধারণ সাজও হয়ে ওঠে অসাধারণ স্টাইলিংয়ের শামিল।
ফ্যাশন অ্যাসথেটিক পরিবর্তনশীল হওয়ায় ট্রেন্ড-সচেতন ক্রেতাদের মাঝে কেনাকাটা এবং বাজারের কলেবর স্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালের শেষে বাংলাদেশের পোশাকবাজারের আকার দাঁড়াতে পারে ১০ দশমিক ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। একই সঙ্গে আরও জানা যায়, মেয়েদের পোশাক এর বড় অংশ দখল করবে। সংখ্যাটা ৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি।
মডেল: মিথিলা ও নাহিদ
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: ক্লোদেন
ছবি: তানভীর খান