এই শহর এই সময় I অতীত অন্বেষণ
বর্তমানের পথচলাকে শাণিত করতে কখনো কখনো ফিরে তাকাতে হয় অতীত পানে। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের নানা বাঁকের সঙ্গে করতে হয় বোঝাপড়া। এমনই কিছু আয়োজনে মে মাসজুড়ে সরব ছিল রাজধানীর সাংস্কৃতিক বলয়।
গৌরবের সাক্ষ্যবহ ও শহীদের রক্তস্নাত বাংলা নামের নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে বাঙালির। গত ১০০ বছরে সেই বাংলা বর্ণমালার ঘটেছে অক্ষরবিন্যাস ও রূপের বিবর্তন। চিত্রশিল্পী ও লেখক সব্যসাচী হাজরা মানবজাতির বিবর্তনের মতোই বর্ণমালার এই বিবর্তনের নান্দনিকতা নিয়ে কাজ করছেন। বাংলা বর্ণমালার শৈল্পিক যাত্রাকে দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন গবেষণার মাধ্যমে। বাংলা বর্ণমালার বিবর্তনের সেই নান্দনিকতা নিয়ে, ৩ থেকে ১৮ মে, ফরাসি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকার লা গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিশেষ প্রদর্শনী। ‘প্রাইমার টু প্রেস’ শিরোনামে। তাতে ঢুঁ মেরে রাজধানীবাসী পেলেন বাংলা ভাষার বিবর্তন কিংবা শৈল্পিক যাত্রা অবলোকন করার অনবদ্য সুযোগ। বাংলা বর্ণমালা বইয়ের আলোকিত ইতিহাস তুলে ধরে সেকালের মুদ্রণশিল্পের আকর্ষণীয় বিভিন্ন নিদর্শনের পাশাপাশি নির্বাচিত মূল বর্ণমালার বইগুলোও জায়গা পেয়েছিল প্রদর্শনীতে। মুদ্রণ কৌশলের বিবর্তন সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে কাঠের ব্লক প্রিন্টিং এবং মুভেবল টাইপ সেটের মতো ঐতিহাসিক সরঞ্জামাদি দেখার সুযোগ ছিল তাতে। আরও ছিল নানা নকশা ও চিত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন বাংলা বর্ণমালা শিল্পে শৈল্পিক বিবর্তনের যাত্রার উপস্থাপন। ছিল সব্যসাচীর লেখা, বর্ণমালা সম্পর্কে ঐতিহাসিক উপাত্ত এবং তথ্যের গবেষণা ও বিশ্লেষণসমৃদ্ধ নতুন বই ‘বর্ণমালা: বাংলা বর্ণ পরিচয় সংকলন’-এর উন্মোচন। লেটারিং, সম্পাদনা এবং মুদ্রণ কৌশলের বিবর্তনের ইতিহাসও তুলে ধরা হয়েছে প্রদর্শনীটিতে।
২০১৪ সাল থেকে প্রতি বুধবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়মিতভাবে ‘ভাবনগর সাধুসঙ্গ’ আয়োজন করছে ভাবনগর ফাউন্ডেশন। গেল মাসের ১ তারিখে পূর্তি হয় সেই আসরের ৫০০তম আসর। এ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল তিন দিনব্যাপী ‘চর্যাপদ পুনর্জাগরণ উৎসব ২০২৪’। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাবসাধকদের চর্যাসংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে। ৮ মে বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের খোলা চত্বরে দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে শিল্পীদের চর্যাপদের গান পরিবেশনার মধ্য দিয়ে এর সূচনা ঘটে। শেষ দিন, অর্থাৎ ১০ মে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে বেলা তিনটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত আয়োজিত হয় চর্যাপদ প্রশিক্ষণ কর্মশালা। তাতে সূচনা বক্তব্য দেন সাইমন জাকারিয়া। প্রধান অতিথি ছিলেন নাট্যনির্দেশক, চলচ্চিত্রকার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ। তিনি বলেন, ‘চর্যাপদের চর্চার মাধ্যমে আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারি। যে ঐতিহ্যে গান, নাচ ও নাটকের পাশাপাশি সংগীত পরিবেশনের বাদ্যযন্ত্র ও নাটকের আহার্য সম্পর্কেও তথ্য পাই, সেই সঙ্গে বাউল-ফকির সাধনার প্রাচীনত্বের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি।’ প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অর্ধশতাধিক শিল্পীকে পাঠ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইম রানা, সাধিকা সৃজনী তানিয়া, শাহ আলম দেওয়ান ও বাউল অন্তর সরকার। সেদিন সন্ধ্যা সাতটায় শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় পর্বে চর্যাপদের পুনর্জাগরণ আসর। তাতে সমবেত কণ্ঠে চর্যাপদের প্রথম পদ পরিবেশন করেন সাধক শিল্পীরা। এরপর পর্যায়ক্রমে চর্যাপদের বিভিন্ন পদ সংগীত আকারে পরিবেশন করেন চুয়াডাঙ্গার আবদুল লতিফ শাহ, সাধিকা সৃজনী তানিয়া; বরিশালের শাহ আলম দেওয়ান; ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের বাবুল আক্তার, আফজাল হোসেন, ফারুক হোসেন, বেল্লাল হোসেন; মানিকগঞ্জের বাউল অন্তর সরকার; শরীয়তপুরের শিলা মল্লিক, ইউসুফ মিয়া, আবদুল কাদের সিদ্দিকী; কুমিল্লার বাউল তাহমিনা; ঝিনাইদহের জ্ঞানহীন নাইম, ফতেহ কামাল; কিশোরগঞ্জের আল আমিন সরকার সিপাহী, সিদ্দিক ফকির, উজ্জ্বল মিয়া, জাকির চিশতি, রোকনউদ্দিন; পটুয়াখালীর আনিস মুন্সী; পাবনার ফকির আবুল হাশেম; পঞ্চগড়ের রবিউল হক প্রমুখ।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের প্রখ্যাত আলোকচিত্রী রঘু রাই নেমে পড়েছিলেন ক্যামেরা নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের আনন্দ-বেদনার বহু ছবি ধরা পড়েছিল তার ক্যামেরায়। সেগুলো নিয়ে দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন একটি বই প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। ‘রাইজ অব আ নেশন’ শিরোনামে। একই শিরোনামে, বইটি থেকে বাছাই করা আলোকচিত্রের প্রদর্শনী হয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে, ৫ থেকে ১৯ মে। চারুকলা অনুষদের ৭৫ বছর পূর্তি উদ্যাপনের অংশ হিসেবে। পুরো গ্যালারি কালোয় মুড়িয়ে দেওয়ায় সাদাকালো ছবিগুলোতে বাঙালির ক্রান্তিকাল আরও তীব্রভাবে ফুটে ওঠা এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে গৌরবময় ইতিহাসের কিছু বিরল স্থিরচিত্রের সাক্ষী হওয়ার সুযোগ পান নগরবাসী।
লাইফস্টাইল ডেস্ক
ছবি: সংগ্রহ