ফিচার I ফুড মিথ
শিশুদের কলিজা খাওয়া বারণ, কিংবা পাখির জিব খেলে কথার জড়তা পালাবে—সবই মিথ। এই ভ্রান্তিগুলোর শিকড় বেশ গভীরে। এমনকি বাংলাদেশের সঙ্গে সুদূর আমেরিকা ও আফ্রিকার মিথ হুবহু মিলে যায়
মিথ হলো মিথ্যার যমজ! যেমন কোনো নারী জোড়া লেগে থাকা কলা খেলে যমজ সন্তান প্রসব করবেন—এটি যেমন মিথ, তেমনই মিথ্যা। কিছু মিথের শিকড় পুথিবীজুড়েই ছড়িয়ে থাকে। যমজ কলাবিষয়ক এই মিথ শুধু উপমহাদেশে নয়, চর্চিত হতো আদি ইউরোপেও। অষ্টাদশ শতাব্দীতেও সেই মহাদেশের কিছু নারীর বদ্ধমূল ধারণা ছিল, যমজ কলা খেলে যমজ সন্তান প্রসব হবেই।
খাদ্যের সঙ্গে মিশে থাকা এ ধরনের মিথের উৎপত্তি ঠিক কবে, কোথায়—দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে প্রাচীনকালের বিভিন্ন জাদুবিশ্বাসে এর শিকড় পোতা। সেকাল থেকে একালে খাবারের সঙ্গে মিশে বেশ কিছু মিথ এগিয়েছে। আধুনিক যুগে এসবে বিশ্বাস অবশ্য অনেকটা কমে এসেছে। ভারতবর্ষে বৈদিক যুগেও নানা মিথ ছিল বেশ রমরমা। সে যুগে রাজ্য হারানো কোনো রাজা তার রাজত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য যত কাণ্ড করতেন, সেগুলোর একটি হলো—কাঁটাযুক্ত গাছের কাণ্ড জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে খাবার রেঁধে খাওয়া।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীতে খাদ্যবস্তুর ওপরই মিথের প্রলেপ বেশি। আদিম ও প্রাচীনকালের মানুষ প্রকৃতিতে বিচরণরত বিভিন্ন শক্তিকে নিজের শরীরে আয়ত্ত করতে চাইতেন। হরিণের মতো দ্রুতগতি, বুনো মোষের মতো শক্তি, বাঘের মতো আক্রমণাত্মক হতে চাইতেন তারা। তাদের ধারণা ছিল, গুণসম্পন্ন প্রাণী বধ করে নিয়মিত খেলে একদিন সেই প্রাণীর গুণে তার শরীরও গুণান্বিত হবে। তারা মনে করতেন, প্রকৃতির শক্তি খাবারের মাধ্যমে মানবশরীরে সঞ্চার হয়।
প্রাচীন আমেরিকার উত্তরাঞ্চলের ক্রিক ও চেরোকি জনগোষ্ঠী দু শ বছর আগেও হরিণের মাংস খাওয়ার জন্য উতলা থাকত। ক্ষুধা নিবারণের জন্য নয়; বরং প্রাণীটির দ্রুত চলনক্ষমতা নিজের শরীরে লাভের আশায়। এর মাংস খেয়ে শরীরে গতি লাভ করলে শিকারজীবী মানুষ খুব সহজে কাঙ্ক্ষিত শিকারটি ধাওয়া করে ধরে ফেলতে পারবেন—এমনটাই বিশ্বাস করা হতো। ওই অঞ্চলের বয়োজ্যেষ্ঠরা তাদের গোষ্ঠীর তরুণদের ধীরগতিসম্পন্ন প্রাণী, যেমন কাছিম খেতে বারণ করতেন। এই প্রাণী খেলে তরুণদের মধ্যে আলস্য ও স্থিরতা ভর করবে বলে মনে করা হতো। তবে অকেজো বৃদ্ধদের কাছিম খাওয়া নিষেধ ছিল না। কেননা, তাদের তো শিকার ও যুদ্ধে যাওয়া লাগত না। একই কারণে ইকুয়েডরের কিছু জনগোষ্ঠীর মধ্যে টাপিরের মাংস খাওয়া মানা। তারা খায় হরিণ, মাছ ও বানর। কেননা, এই তিন প্রাণীর চলনেই রয়েছে তীব্র গতি। তবে সব মাছ খাওয়া হতো না। ব্রাজিলের কিছু গোত্রের লোকেরা ধীরগতিসম্পন্ন মাছ খাওয়া এড়িয়ে চলতেন।
আমেরিকান প্রাচীন কারিব গোত্রের মধ্যে প্রচলিত মিথ হলো, শূকরের মাংস খেলে নাকি চোখ ওই প্রাণীটির মতোই হয়ে যাবে। তারা এ ধরনের চোখ চান না; তাই শূকর খাওয়া ওই গোষ্ঠীতে বারণ। প্রাচ্যেও এমন একটি মিথের ধ্বংসাবশেষ টিকে আছে। চোখের জ্যোতি বাড়াতে উত্তর ভারতের কেউ কেউ খেয়ে ফেলেন প্যাঁচার চোখের মণি! অন্ধকারে ভালো দেখার প্রত্যাশায় এমন কাণ্ড করেন তারা।
আমেরিকান যে কারিব গোত্রের কথা বলা হচ্ছিল, তারাও আলস্য ও স্থবির স্বভাব থেকে বাঁচতে কাছিমের মাংস এড়িয়ে চলে। তবে আমেরিকান এসব মিথের ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যায় আফ্রিকায়। তাদের আদি বাসিন্দারা বেছে বেছে ধীরগতিসম্পন্ন প্রাণীর মাংসই খান। দ্রুতগতির প্রাণীগুলোর মাংস খাওয়া খুব কড়াকড়িভাবে এড়িয়ে চলেন। তাদের প্রচলিত ধারণা, শিকারির উদরে থাকা মাংস শিকারকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ কোনো শিকারি যদি হরিণের মাংস খেয়ে শিকারে বের হন, তাহলে প্রাণীটির সেই গতি তার শরীরে নয়, বরং তিনি যে বুনো মোষকে তাড়া করেছেন, সেটির শরীরে সঞ্চার হবে। মানে বুনো মোষের শরীরে হরিণের গতি যোগ হয়ে শিকার ফসকে যাবে। তাই কাছিমের মাংস খেয়ে শিকারে বের হওয়ার রেওয়াজ এদের অনেকের।
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের কিছু বাসিন্দা বাড়ির শিশুদের মুরগির কলিজা খেতে দেন না। তাদের ধারণা, তা খেলে শিশু ভীরু হয়ে বেড়ে উঠবে। মানে ভীরু প্রাণীর কলিজা মানুষকে ভীরু করে দেয়, সাহসী প্রাণীর কলিজা করে তোলে সাহসী—এমন একটি মিথ ছড়িয়ে আছে বিশ্বজুড়ে। প্রাণীর কলিজার ওপর আরোপিত এমন মিথ রয়েছে আফ্রিকান বুশম্যানদের মধ্যেও। তারা তাদের শিশুকে শিয়ালের কলিজা খেতে দেন না। তবে চিতার কলিজা খেতে উৎসাহিত করেন, যাতে শিশুরা ওই প্রাণীর মতোই সাহসী হয়ে ওঠে; শিয়ালের মতো ভীরু নয়। আফ্রিকার ওয়াগগো গোত্রের মানুষ কিছু বাংলাদেশির মতো তাদের শিশুদের মুরগির কলিজা খেতে বারণ করেন।
জ্ঞানবুদ্ধি বাড়াতেও কলিজা খাওয়ার চল আছে। আইনোর নামের এক আদিবাসী গোষ্ঠী নিজেদের জ্ঞান বাড়াতে পানকৌড়ির কলিজা কাঁচা খেয়ে নেয়। এখানে প্রশ্ন ওঠে, প্রাণীর মাংস ছেড়ে কলিজার ওপরেই কেন এত মিথ? মূলত প্রাচীনকালে কলিজাকেই প্রাণীর আত্মার ধারক মনে করা হতো। তাই এই অঙ্গ খাওয়ার ব্যাপারে বিশ্বজুড়ে এত চল ও বিধিনিষেধের ছড়াছড়ি। কলিজার ওপর এসব মিথ একপ্রকার কাকতালীয়ভাবেই জুড়ে গেছে। নরওয়েতে প্রচলিত আছে, তাদের প্রাচীন এক রাজার ছেলে ছিল ভীষণ ভীরু। ছেলেকে সাহসী করার কোনো উপায়ই খুঁজে পাচ্ছিলেন না রাজা। নেকড়ের কলিজা খাওয়ানোর পর সেই রাজপুত্র নাকি প্রচণ্ড সাহসী হয়ে উঠেছিল।
কলিজা খেতে যে শুধু শিশুদেরই বারণ করা হয়, তা নয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের কিছু অঞ্চলের মানুষ নারীদেরও নিষেধ করেন। আগেই বলা হয়েছে, প্রাচীন মানুষ প্রাণীর কলিজাকেই আত্মা মনে করতেন। তাদের মধ্যে আরও একটি ধারণা ছিল, নারীর কোনো আত্মা নেই। ফলে যার আত্মাই নেই, তার কলিজা খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই বলে মনে করতেন তারা। বিশেষত আফ্রিকার শিকারজীবী মানুষের মধ্যে এই ধারণা প্রকট ছিল। এ কারণে প্রাণীর কলিজা শুধু পুরুষেরাই খেতেন। নারীদের তা খাওয়া বারণ ছিল। এর চর্চা এখনো রয়েছে মহাদেশটির কোথাও কোথাও, কোনো কোনো জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে।
রোগ নিরাময়ের পথ্য খুঁজতে গিয়েও খাবারের সঙ্গে বেশ কিছু মিথ জুড়ে গেছে। পিঁপড়া খেলে সাঁতার শেখা যাবে—এ ধরনের কথা শোনেননি, বাংলাদেশে এমন মানুষের সংখ্যা সম্ভবত কমই। কিন্তু এই পিঁপড়াই ছিল পুরুষত্বের দাওয়াই। হারানো পুরুষত্ব ফিরে পেতে মরক্কোর মানুষ পিঁপড়া গিলে খেতেন। অন্যদিকে তুরস্কের মানুষ তাদের কিছু শিশুকে পাখির জিব কেটে খেতে দিতেন। বয়স হওয়ার পরও যেসব শিশুর বোল ফুটত না, তাদেরকেই খাওয়ানো হতো ওই জিব।
খাবারের সঙ্গে মিশে থাকা মিথের পূর্ণাঙ্গ বয়ান করতে গেলে পেটমোটা একটি বই হয়ে যেতে পারে! কৌতূহলীরা জেমস জর্জ ফ্রেজারের ‘গোল্ডেন বাউ’ বইয়ে এসব মিথের আরও দীর্ঘ বর্ণনা পাবেন। মূলত শিকারসংগ্রাহক প্রাচীন মানুষের নানা কল্পনার প্রতিফলন এসব মিথ, যেগুলো নানা যুগ পেরিয়ে আধুনিক সভ্যতায় ঢুকে পড়েছে।
আহমেদ সজিব
ছবি: ইন্টারনেট