ছুটিরঘণ্টা I মেঘমল্লারে রাগ মালহারে
কেরালা। ভারতীয় রাজ্য। অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতির এক উজ্জ্বল নমুনা। বর্ষণমুখর দিনে এর সবুজ দিগন্ত আর রুপালি জলপ্রপাতের হৃদয়স্পর্শী সঙ্গ নিয়ে এসে লিখেছেন ফাতিমা জাহান
ট্রেন সবে থেমেছে পালাক্কাড স্টেশনে। জানালা দিয়ে চারপাশ দেখছি। হঠাৎ শুনি একজন তারস্বরে চেঁচাচ্ছে, ‘চোর চোর চোর চোর…’। বেশ অবাক হলাম। এই দুপুরবেলায় চোর আসবে কোত্থেকে, তা-ও আবার দক্ষিণ ভারতের সবচেয়ে নিরাপদ রাজ্য কেরালায়! ‘চোর’ শব্দটি শুধু বাংলায়ই নয়, হিন্দিতেও ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এই ভরদুপুরে চোর কেন? আরেকটু খেয়াল করে দেখি, স্টেশনের একজন হকার হাতে ট্রে ভর্তি প্যাকেট নিয়ে প্ল্যাটফর্মে হাঁটছেন আর ‘চোর চোর’ বলে চিৎকার করছেন। মালয়ালম ভাষায় ‘চোর’ শব্দের অর্থ খাবার। এ শব্দ আমি বহুবার শুনেছি কেরালার বন্ধুদের বাড়িতে গিয়ে। এখানে বহুদিন পর শুনে ওলটপালট করে ফেলেছি!
আমি ট্রেন ধরেছি বেঙ্গালুরু থেকে। পালাক্কাড জেলায় ট্রেন ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই প্রকৃতি নিজের গোপন সবুজ সতেজ ঝাঁপি খুলে দিয়েছে। যেদিকে তাকাই, সবুজের আঁচল বিছানো। পথজুড়ে সারি সারি নারকেলবাগান। কেরালাকে কখনোই নারকেলবাগান থেকে আলাদা করার উপায় নেই। সাগর, নদী, সমতল, লোকালয়—কোথায় নেই নারকেলগাছের চিরল চিরল পাতার ঝাপটা দেওয়া বাতাস! কেরালাকে বলা হয় ‘গডস ওন কান্ট্রি’ বা ‘ঈশ্বরের নিজস্ব দেশ’। এখানকার প্রকৃতি এবং অধিবাসীদের আতিথেয়তা, নম্র আচরণ যেন সেই সাক্ষ্যই বহন করে। আমি এবার ইচ্ছে করেই বর্ষাকালে কেরালায় এসেছি। শীত ও গ্রীষ্মের যে রূপ দেখেছি, বর্ষা নিশ্চয় আমাকে হাত ধরে নিয়ে যাবে আগে যেখানে যাইনি এমন কোথাও।
বাইরে প্রকৃতি এতই মেঘতাড়িত, আবেগে আপ্লুত যেন আকাশ বেয়ে ঝরে ঝরে পড়ছে কারও কথা ভেবে! কখনো টিপ টিপ, কখনো অঝোর ধারায়। কখনো গাঢ় সবুজে মাখামাখি, কখনো হালকা সবুজে বুজে যাওয়া। কখনো আবার টিয়া সবুজ রং মেখে পার করে দিচ্ছে দিগন্তের পর দিগন্ত। কাঁচা সবুজ ধানখেতে নারকেলগাছের বেড়া দেওয়া আর আরও দূরে মাতাল করা সবুজ রঙের পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে হাত বাড়িয়ে।
পথের কোথাও কোনো খেতে নিড়ানি দেওয়া হয়ে গেছে, আবার কোনো খেতে কচি মাথা তুলে তাকিয়ে আছে সদ্য ফুটে ওঠা ধানগাছ। একেক সবুজের একেক রকমের সুগন্ধ। একটার পর একটা ধাক্কা দিয়েই যাচ্ছে। তার সঙ্গে আছে মেগমেদুর বৃষ্টির ঘ্রাণ আর রাগ মালহার তোলা সুর।
এর আগে যতবার কেরালায় এসেছি, প্রতিবারই অন্যতম আকর্ষণীয় ট্যুরিস্ট স্পটগুলো দেখতেই এসেছিলাম। কিন্তু এবার এসেছি বর্ষায় অন্য এক কেরালা আবিষ্কারের আশায়; ভ্রমণের নেশায় নয়, গ্রামের এক বন্ধুর অতিথি হয়ে। সাধারণত আমি কোনো শহরে বা গ্রামে গেলে সেখানকার হোটেল বা গেস্টহাউসে উঠি। এবার আমার ভ্রমণ জীবনের ব্যতিক্রম করে ফেললাম। কেরালাজুড়ে আমার বন্ধুবান্ধব বসবাস করে। কাকে ছেড়ে কার বাড়িতে আগে যাই!
ততক্ষণে বাইরের দৃশ্যপট বদলানোর নাম নেই। মাঝেমধ্যে হঠাৎ একরাশ অরণ্যের মাঝে একটা সাদা রঙের চারচালা ট্যালি দেওয়া একতলা বা দোতলা বাড়ি জানালা থেকে সরে যাচ্ছে। এর বাইরে আর সব উপচে পড়া সবুজের মেলা।
ত্রিশূর রেলস্টেশনে আমার জন্য গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। এখানে গ্রামে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি মেলে না। আর কেরালায় মূল শহর মোটে দুটি; বাকি সব গ্রাম পর্যায়ে পড়ে। বিদেশে বা অন্য রাজ্যের বড় বা ছোট শহরে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েও কেরালাবাসীর মনে এতটুকু হীনম্মন্যতা আসেনি। যত সফল বা পয়সাওয়ালা হোক না কেন, যেকোনো কেরালাবাসীকে আমি বলতে শুনেছি, ‘আমার বাড়ি গ্রামে।’ বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার পথে অবশ্য এই জনপদকে কোনোমতেই গ্রাম মনে হচ্ছিল না। পাশাপাশি লাল বা ধূসর ট্যালির চারচালা ছাদ করা সাদা রঙের আলিশান ডুপ্লেক্স ভিলা, তার সামনে নিদেনপক্ষে দুটো গাড়ি পার্ক করা—একে আমি কোনোভাবেই গ্রামের দৃশ্য বলতে পারি না। বেশির ভাগ বাড়ি একটা থেকে আরেকটা বেশ দূরে। মাঝে গাছগাছালি, নারকেলবাগান। গ্রামের রাস্তাও খুব উঁচু আর পিচ ঢালা পথ করা। কোথাও কাদা, ময়লা নেই। কেউ কোথাও আবর্জনা ফেলে রাখেনি। পথে কোনো প্লাস্টিকের কাগজ কিংবা খালি বোতল গড়াগড়ি খাচ্ছে না। সত্যি বলছি, আমাদের ঢাকা শহরের দু-একটা বাড়ি ছাড়া এ রকম গ্রামজুড়ে আলিশান প্রাসাদের মতো বাড়ি আমি দক্ষিণ এশিয়ার আর কোথাও দেখিনি।
বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বৃষ্টি নামল। আমার বন্ধুটি বিদেশে থাকে। সারা বছর বাড়ি ফাঁকা পড়ে রয়। আমার সুবিধার জন্য বন্ধুর বোন এসে থাকবেন সঙ্গে, সে রকমই কথা হয়েছে। বন্ধুটির বাড়ি দেখে তাক লেগে গেল। এত যত্ব নিয়ে শৈল্পিকতায় নিজে নকশা করে বানিয়েছে, অথচ একেবারেই ফাঁকা। আর আমরা বড় বড় শহরে কত লোক একসঙ্গে একই ভবনে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে ঠাসাঠাসি করে বসবাস করি। বাড়ির দুদিকের এবং উল্টো দিকের মোট ছয়-সাতটি প্রতিবেশী বাড়িও ডুপ্লেক্স ভিলা; সেগুলোতেও কেউ থাকে না। এরা এ রকম স্বর্গ তৈরি করে চলে গেছে কোন মর্ত্য,ে কে জানে! এ রকম নির্জন, জনমানবহীন তল্লাটে থাকব আর বর্ষাযাপন করব ভাবতেই আনন্দ উথলে পড়ছে আমার।
বাড়ির গৃহকর্মী চা ও স্ন্যাকসে টেবিল ভরে দিলেন। আমরা কেউ কারও ভাষা বুঝি না। চা নিয়ে বাইরের বাগানে বৃষ্টি দেখতে গেলাম। বাড়ির মতো এদের বাগানও বিশাল। এ বাড়ির কোথায় কী আছে, কিছুই জানা নেই আমার। শুধু জানি, এ রকম স্বর্গে একবার ঢুকে পড়লে আর বের হবার নাম করতে নেই!
চা পান করতে করতে দেখি, বন্ধুর বোন বৃষ্টি মাথায় করে অফিস থেকে ফিরলেন। তার নাম সুগতা। আগে কখনো দেখা হয়নি আমাদের। চলনসই ইংরেজি জানেন তিনি। মুখে মাতৃস্নেহের হাসি ঝরে পড়ছে। আমার জন্য রান্নার লোক ঠিক করা আছে, সঙ্গ দেওয়ার সঙ্গী আছে। এই ইডেন গার্ডেন থেকে কোথাও যাবার প্রশ্নই আসে না! এখানেই বসে বসে আমি এক মাস কাটিয়ে দিতে পারি। সুগতা চেচি (বড় বোনকে মালয়ালম ভাষায় চেচি বলে) আমাকে বাড়ি ঘুরিয়ে দেখালেন। ছয় বেডরুমের বিশাল বাড়ি। দোতলায় ওপেন টেরাস। আমার সবচেয়ে ভালো লাগল নিচতলায় বসার ঘরের একাংশে ওপেন রুফ। অত্যাধুনিক, সুরুচিসম্পন্ন সোফায় বসে ওপেন রুফ থেকে বৃষ্টি ঝরে পড়ার ফোঁটা গোনা যাচ্ছে এখান থেকে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, কেউ না থাকলেও এ বাড়িতে মডিউলার কিচেন, এলইডি টিভি, সাজানো-গোছানো শোবার ঘরে সব আসবাব রয়েছে। এরা এত যত্ব করে বাড়ি বানায়, দেখে তাক লেগে যায়; আর একেকটি বাড়ির পেছনে জীবনের সমস্ত সঞ্চয় ঢেলে দেয়। কেরালায় শিক্ষিতের হার ভারতের সব রাজ্যের মধ্যে বেশি। অধিবাসীদের আচার-ব্যবহার ভীষণ নম্র, চেহারায় এক আভিজাত্য ধরা। এখানকার বাস কিংবা অটোরিকশাচালক স্পষ্ট ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন। কেরালার কিংবা এর অধিবাসীদের গল্প করতে বসলে দিন পার হয়ে যাবে, তবু গল্প ফুরোবে না।
রাতের খাবার ছিল ভাতের সঙ্গে কেরালা ফিশ ফ্রাই, নারকেল দিয়ে সামুদ্রিক মাছ, দুই রকমের সবজি ভাজি, সাম্বার ও পাঁপড়। আমি কেরালার খাবার বেঙ্গালুরু বন্ধুদের বাড়িতে খেয়েছি। তবে পাশের সমুদ্রসৈকত থেকে ধরে আনা তাজা মাছ আজ বহু বছর বাদে খাওয়া হলো এই গ্রামে আসার সুবাদে।
এ গ্রামে সকাল হলো বৃষ্টির শব্দে। একটানা ঝরেই যাচ্ছে; মেঘমালা আর বড় বড় গাঢ় মালা বিলিয়ে যাচ্ছে আকাশকে। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখতে দেখতে সকালের চা চলে এলো। এমন রাজকীয় আতিথেয়তা পাব এক নির্জন প্রাসাদে, তা কে জানত! দোতলার ওপেন টেরেসে একমনে বর্ষা গেয়ে যাচ্ছে রাগ মালহার। চারদিকের প্রকৃতি চকচকে সবুজ, যেন কেউ গাছপালা ধুয়ে দেওয়ার জন্যই বর্ষাকালের আয়োজন করেছে। ঘন গাছপালার জন্য আশপাশের রাজপ্রাসাদগুলোও দেখা যাচ্ছে না। নারকেল, সুপারি, আম, কাঁঠাল…আরও কত যে গাছগাছালিতে ভরা এই মহল্লা, চারদিকে নবীন পাতার সতেজ ঘ্রাণ।
নাশতায় পরিবেশন করা হলো ইদিয়াপ্পাম। চালের গুঁড়া দিয়ে চিকন সেমাই হাতে তৈরি করে গোল গোল রুটির মতো আকার বানিয়ে ভাপে সেদ্ধ করে পরিবেশন করা হয় এ খাবার। সঙ্গে চিকেন এবং ভেজিটেবল স্টু। এতই দারুণ স্বাদ, টেবিল ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না! এমন খাওয়ার বহর থাকলে আর বাইরে যাওয়া যাবে না; ঘরে শুয়েবসে, খেয়েদেয়ে সময় চলে যাবে। বৃষ্টি একটু কমতেই কাছাকাছি এক ছোট নদীর ধারে চলে এলাম। গাড়ি প্রস্তুতই ছিল। চালকের নাম শারজিল। চব্বিশ বছর বয়স; বকর বকর করেই যাচ্ছেন! আশপাশের প্রকৃতি আমাকে এমন আবিষ্ট করেছে, শারজিলের কথা কিছুই কানে ঢুকছে না। এক জায়গায় থেমে আমি নিচের নদীর দিকে নেমে গেলাম। নদীর ওপর একটি সেতু। আগের দিন এই সেতু পার হয়েই রেলস্টেশন থেকে এসেছি। তখনই ঠিক করেছিলাম, এই অপার্থিব জায়গায় আমাকে আসতেই হবে।
সেতুর পাশ দিয়ে নিচু এক মেঠো পথ নেমে গেছে। সরু পথের দুধারে সারি সারি নারকেলগাছ। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে, তবে ছাদ হয়ে আছে এই নারকেলবাগান। নদীর ধারে এখন কেউ নেই। এপাশে নারকেলবাগান, ওপাশে চিরহরিৎ নারকেলগাছের জগৎ আমাকে হাতছানি দিচ্ছে। মাঝখানে ঘন গাছপালার রঙের সবুজ নদী। নদীর ওপাশের জগৎ দেখে মনে হচ্ছে, সত্যিই বোধ হয় ঈশ্বর এখানে ঘুমাবার ব্যবস্থা করেছেন! নির্জন, মগ্ন, একাগ্রতায় পরিপূর্ণ নির্মল এ প্রকৃতি। নদীর জলে পড়ছে নারকেলগাছের ছায়া; মনে হচ্ছে যেন জলের আয়নায় ঝুঁকে ঝুঁকে গাছগুলো নিজের রূপ দেখে নিচ্ছে। এ অপরূপ দর্শন যেন শেষ হতেই চায় না। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার এক অনন্য সংযোগ গড়ে দেওয়ার পবিত্র আবহ এ যেন। আমার খুব ইচ্ছে করছে নৌকা নিয়ে এই নদীতে ঘুরে বেড়াতে।
সমতলভূমির সবুজে একধরনের মাধুর্য ভর করে থাকে; পাহাড়ের সবুজে আরেক ধরনের। তবে ঘন নারকেল বনের সবুজে থাকে শুধু মোহময়তা; কোথাও কোনো লুকোচুরি নেই, তবু কী যেন না দেখতে পাওয়ার ব্যাকুলতা। আমি এই নারকেল বনে আরও কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম। পাশেই একটি মন্দির; তবে এখন তালাবদ্ধ। বিকেলে খুলবে, পূজার সময়। এ রাজ্যের মসজিদ, মন্দির, গির্জা—সবই দেখতে এক রকম। সাদা দেয়াল আর ট্যালির লাল চারচালা ছাদ। গ্রামের বাড়িগুলোও মন্দির বা মসজিদের আকারে বানানো। এখানকার গ্রামকে আমার এখনো গ্রাম বলতে বাধছে! এমন সমৃদ্ধ, সব সুযোগ-সুবিধায় ভরপুর জায়গা যেন ভারতবর্ষে নয়, ভিন্ন কোনো মহাদেশে বলে ভ্রম হয়।
আমি গাড়িতে গিয়ে বসতেই শারজিল আবার বকবক শুরু করলেন! অন্য সময় হলে থামিয়ে দিতাম। হয় এখানকার প্রকৃতি, নয় মানুষের নম্রতা, আতিথেয়তা আমাকে এতই মুগ্ধ করেছে, ওর বকবকানি তেমন খারাপ লাগছে না। পথে পড়ল দিগন্তজোড়া ধানখেত। যত দূর চোখ যায়, ধানখেতের রাজত্ব। নারকেল বন কোথায় উধাও! টিয়া সবুজ রং দেখে গাড়ি থামিয়ে আমি দিলাম দৌড়—খেতের আল ধরে। আকাশে মেঘ ছেয়ে আছে থোকায় থোকায়। ইচ্ছে করছে এই মেঘের পেছন পেছন দৌড়ে যাই ধানখেতের শেষ প্রান্ত অবধি। ভারতের এ এক আজব রাজ্য, দারুণ নির্জন। যেভাবে মন চায় সেভাবেই প্রকৃতির কাছে, গাছপালার কাছে যাওয়া যায়। নবীন ধানখেতের মাথাগুলো দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি টিয়া পাখি হয়ে উড়ে চলে যাবে দূরে।
যতই উড়ে উড়ে, ঘুরে ঘুরে বেড়াই না কেন, আহারের সময় কেরালার ঐতিহ্যবাহী খাবার ও তাজা মাছ খাওয়ার বাসনা দমিয়ে রাখা ঘোরতর অন্যায়! আজ এ বাড়িতে আমার জন্য করা হয়েছে সাদইয়া। কেরালার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উৎসব ওনাম বা হিন্দু বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠানে সাধারণত এ খাবার পরিবেশন করা হয়। সাদইয়া হলো ১০-১২ রকমের ভাজি সবজির সঙ্গে কয়েক পদের সাম্বার, পাঁপড়, আচার, চাটনি; শেষ পাতে মিষ্টান্ন ইত্যাদি। পুরোটাই শাকাহারি খাবার হলেও এত স্বাদের যে, এক বসায় অনেকখানিই খেয়ে ফেলা যায়। দক্ষিণ ভারতে বসবাসের কারণে শাকাহারি খাবারে আমার কখনোই অরুচি ধরে না। মাসের পর মাস এ ধরনের খাবার খেয়ে অনায়াসে পার করে দিতে পারি!
ফিরতে ফিরতে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। ভাবগতি দেখে মনে হচ্ছে, আজ আর থামবে না। তাতে আমার বিশেষ সুবিধাই হলো। গহিন গাঁয়ে, সুনসান নীরবতায় বর্ষা যাপন করতে এসেছি। মনে হলো, নির্জনে বর্ষা যাপনের জন্য এ জায়গার চেয়ে ভালো ভূস্বর্গ আর কোথাও নেই! যখন যেখান থেকে ইচ্ছে মুখর বাদল দেখতে পাওয়া যাবে। কখনো ছাদ থেকে, কখনো পোর্চে দাঁড়িয়ে, কখনোবা বসার ঘরের মাঝের খোলা ছাদ থেকে। এ বাড়ির বসার ঘরের মাঝখানে খোলা ছাদটি আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। বৃষ্টির ফোঁটা সরাসরি ঘরের মেঝেতে এসে পড়ছে। যে অংশে পড়ছে, সেখানে অনুচ্চ পুল করে দেওয়া আছে। ঘরে পানি গড়িয়ে পড়ছে না; আবার পুলের পানিতে বৃষ্টির জলতরঙ্গ অন্য এক জগতে নিয়ে চলেছে।
পরদিন সকালেও দেখি, টেবিল ভরতি নাশতা। আজকের মেনুতে আছে আপ্পাম। খেতে প্রায় দোসার মতোই। সঙ্গে তিন রকমের সাম্বার আর স্টু। নাশতা সেরে আমি চললাম ১০০ কিলোমিটার দূরে, আতিরাপাল্লি জলপ্রপাত দেখতে। জলপ্রপাত দেখা মূল বিষয় নয়। সেখানে যেতে হবে এক গভীর জঙ্গল পার হয়ে। আমার সেই জঙ্গল আর লোকালয় দেখার সাধ (যদিও লোকালয় ও লোকজনের কদাচিৎ দেখা মেলে)। গাড়ি ছুটছে ত্রিশূর মূল এলাকা ছেড়ে আরও দূরে। ত্রিশূর মূল লোকালয় দেখলে মনে হবে অল্প কয়েকটি পরিবার এখানে বিলাসবহুল বাংলোয় অবকাশ যাপনে এসেছে। গাড়ি হাইওয়ে ছেড়ে এখন জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে আর ঝপ করে কে যেন চারদিক থেকে সবুজের ঝাঁপি খুলে দিয়েছে। হুড়মুড় করে পৃথিবীর সব সবুজ অমূল্য রত্বখনি চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। এই গভীর বনাঞ্চলে ঘন গাছপালার কারণে আকাশ দেখতে পাওয়া যায় না ঠিকমতো। নারকেল, সুপারিগাছ ছাড়াও সেগুন, ইউক্যালিপটাস, বাঁশঝাড় প্রচুর আছে এই বনাঞ্চলে। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে; ভিজে যাচ্ছে বনভূমি। বনভূমির ভেতর দিয়ে মাঝেমধ্যে হাতি, হরিণ প্রভৃতি প্রাণী রাস্তা পার হয়। হয়তো আজ তাদের দেখা পাব; হয়তো পাব না। খানিক এগোনোর পর দেখি, পিচঢালা পথের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে রুপো দিয়ে মোড়ানো রূপের এক নদী; নাম চালাকুডি। এই নদী আসলে আতিরাপাল্লি জলপ্রপাতেরই একটি অংশ।
এই ঘন বন যেন শেষ হতে চায় না। অনেকখানি পথ চলার পর এসে পড়লাম পামগাছের বাগানে। সরকার থেকেই জঙ্গলের মাঝে পাম প্ল্যান্টেশন তৈরি করা হয়েছে। এসব পামের তেল বিদেশে রপ্তানি করা হয়। পাম প্ল্যান্টেশন এলাকা শেষ হলে আবার শুরু হলো ঘন বনাঞ্চল। বনভূমির ঘন গাছপালার মাঝেই লুকিয়ে আছে জলপ্রপাত। তার কাছে এসে আমাকে গাড়ি থেকে নেমে খানিকটা হেঁটে যেতে হবে। হাঁটতে হবে বনের পথ ধরেই। এখানে বেশ কিছু ট্যুরিস্ট দেখা যাচ্ছে। ত্রিশূর জেলার অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট এটি। কেরালা তো বটেই, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আগ্রহীরা এসেছেন জলপ্রপাত দেখতে। কেরালার পুরুষেরা ধবধবে সাদা শার্ট, সাদা লুঙ্গি পরে ক্ষেত্রবিশেষে লুঙ্গি ভাঁজ করে হাঁটুর কাছাকাছি তুলে নিচের অংশ কোমরে বেঁধে হেঁটে প্রপাতের দিকে যাচ্ছেন। এখানে এ দৃশ্য স্বাভাবিক।
জলপ্রপাত যেদিকে ধেয়ে নিচে নেমে গেছে, সেদিকে পাহাড়ের ওপর একই স্রোত নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে। নিরেট পাথরে শক্ত শরীরের ওপর দিয়ে কলকল বয়ে চলছে নদী। কে বলবে কয়েক ফুট পার হয়েই সে প্রবল বেগে নেমে গেছে কয়েক শ ফুট নিচে! সেকি গর্জন তার। মনে হচ্ছে বিশাল বিশাল মেঘ প্রবল গর্জনে ফুঁসে উঠে জল হয়ে তারও তীব্র বেগে নিচে নামছে। আর এর চারপাশে পরম মমতায় তাকে আঁকড়ে ধরে আছে সবুজ প্রকৃতি, পাহাড়ের আলিঙ্গন।
পাহাড়ের নিচে যেখানে জল আছড়ে পড়ছে, সেখানে চলে গেলাম আমি। এখানে একেবারে জলের কাছাকাছি না যাওয়া গেলেও যতখানি দেখা যায়, তাতে জলের যে রূপান্তর, তা নিয়ে বেশ গল্প করা সম্ভব। কোথাও অবোধ, কোথাও চঞ্চল, কোথাও সৌম্য, কোথাও বিহ্বল। জলপ্রপাত থেকে নদীর ধারায় কত ধরনের রুপালি রূপে যে সে ধরা দেয়। আর এই নদীই জলের অভাব মেটায় বনভূমিতে। এদের একসঙ্গে পথচলা বহুদিনের। এর মাঝেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। আর তা একসময় রূপ নিল ঝমঝম বৃষ্টিতে। এই বৃষ্টির সঙ্গে নদীর স্রোত, বনের ঝিঁঝিঁ পোকা, অবুঝ পাখি একসঙ্গে শুরু করে দিল রাগ মালহার!
আকাশের মান ভেঙেছে; ঝরিয়ে দিচ্ছে অবিরত বরিষণ—এই রাগ মালহারের সঙ্গে।
ছবি: লেখক ও ইন্টারনেট